দিশারি: গুরুগ্রামে দুই ইতিহাসবিদ ফ্রেডরিক ও ক্যাথরিন অ্যাশার। ছবি সৌজন্য: আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান স্টাডিজ়।
চার পর্বে খান-ত্রিশেক আলাদা আলাদা লেখকের বই নিয়ে যখন দ্য নিউ কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া-র পরিকল্পনা করা হয়, তখন সম্পাদকেরা ভেবেছিলেন, বই লেখার সময় পর্যন্ত জ্ঞাত তথ্যের সংক্ষিপ্তসার করে দিলেই যথেষ্ট। লেখকদের সে ভাবেই এগোতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা-র শিল্প ইতিহাস বিভাগের বছর চুয়াল্লিশের এক শিক্ষককে যখন মোগল স্থাপত্যের খণ্ডটি লেখার বরাত দেওয়া হল, তিনি বাঁধা পথে হাঁটতে রাজি হলেন না। ক্যাথরিন এলা ব্লানশার্ড অ্যাশার (১৯৪৬-২০২৩) তত দিনে ডেভিড লেলিভেল্ড-এর কাছে ‘ষোড়শ শতকের ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্য: শের শাহ সুরির পৃষ্ঠপোষণা’ নিয়ে পিএইচ ডি তো করেই ফেলেছেন, তার সঙ্গে ভারতের ইসলামি স্থাপত্য নিয়ে তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। মিনেসোটারই শিক্ষক, দক্ষিণ এশিয়ার শিল্প ইতিহাস বিশেষজ্ঞ স্বামী ফ্রেডরিক অ্যাশার-এর (১৯৪১-২০২১) সঙ্গে ভারতে এসে এই বিষয়ে আগ্রহ জন্মাল। যুক্ত হয়েছেন আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান স্টাডিজ়-এর সঙ্গে, যে সম্পর্ক আজীবন অটুট থাকবে। ইতিমধ্যেই চষে ফেলেছেন ভারতের নানা প্রান্ত— কেন্দ্র ও প্রান্তের টানাপড়েন তখন তাঁর চোখে নতুন ভাবে আলোকিত। হাতে জমেছে প্রচুর নতুন তথ্য। তিনি কেন চর্বিতচর্বণ করবেন?
১৯৯২-এ প্রকাশিত হল ক্যাথরিনের আর্কিটেকচার অব মুঘল ইন্ডিয়া। নামটা খেয়াল করা দরকার, ভারতের মোগল স্থাপত্য নয়, মোগল ভারতের স্থাপত্য। ১৫২৬ থেকে ১৮৫৮, এই ৩৩২ বছরের মোগল শাসনকালে ভারতের স্থাপত্য কী ভাবে গড়ে উঠল, কী চেহারা নিল, কী ভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাল, আর পরবর্তী সময়ের উপরেই বা তার কেমন ছাপ পড়ল, এই বইতে তারই খোঁজ করেছেন ক্যাথরিন। কিন্তু এর পঞ্চাশ বছর আগেই তো পার্সি ব্রাউন তাঁর ইন্ডিয়ান আর্কিটেকচার (ইসলামিক পিরিয়ড) বইতে সে কাজ করেছিলেন। তা হলে নতুন কী করলেন ক্যাথরিন? আর বই বেরোনোর তিন দশক পেরিয়ে সে কথা আবার বলতে বসা-ই বা কেন? ক্যাথরিন সদ্য প্রয়াত হয়েছেন বলে?
না, ক্যাথরিনের প্রয়াণ নিছক সমাপতন। তাঁর স্মৃতিচারণের জন্য এ লেখা নয়। আজ তাঁকে বার বার মনে পড়ছে, কারণ আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভারতের ইতিহাসের ওই ৩৩২টা বছর সম্বন্ধে ভবিষ্যতে কতটুকু জানার সুযোগ পাবে, তা নিয়ে সম্প্রতি সংশয়ের কারণ তৈরি হয়েছে। বহু দিন ধরেই তো এক শ্রেণির মানুষ ওই কালপর্বটিকে ভারত-ইতিহাসের অন্ধকারময় যুগ বলে প্রচার করে আসছেন। কাকতালীয় ভাবে যে বছর ক্যাথরিনের বই প্রকাশ পেল, সেই বছরেই ধ্বংস করা হল বাবরি মসজিদ। দ্বাদশ শতকের শেষ থেকে আর যা স্থাপত্য এখনও টিকে আছে, তাদের আয়ুই বা কত দিন, কেউ জানে না। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর প্রতিহিংসা নিতে দিল্লি ও লখনউয়ের বহু স্থাপত্য গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। সেই প্রতিহিংসা যেন অন্য আকারে আবার উঁকি দিচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। তাই মনে হচ্ছে, ক্যাথরিনের বইটা আবার খুলে দেখি, আগ্রহীদের নতুন করে পড়তে বলি, তথাকথিত অন্ধকার যুগকে কতটা আলোকিত করতে পেরেছিলেন তিনি।
মোগল স্থাপত্যের সূচনা হল কী ভাবে? আদতে আজকের উজ়বেকিস্তানের ছোট্ট রাজ্য ফরগনার শাসক, তৈমুরবংশীয় জহির অল-দিন মুহম্মদ বাবর ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে হারিয়ে দিল্লি দখল করেন, এ ইতিহাস সবারই জানা। পাঁচ বছরও পুরো রাজত্ব করতে পারেননি বাবর, যুদ্ধে যুদ্ধেই সময় কেটে গেছে। তবে বাবর বাগান গাছ ফুল ফল ভালবাসতেন, তৈমুরি রীতির বাগান ‘চার বাগ’ তিনিই এখানে সূচনা করেন— যা পরে মোগল স্থাপত্যের অঙ্গাঙ্গি হয়ে ওঠে। আর নিজে তৈরি করান একটিই মসজিদ, পানিপথের কাছে, আজকের হরিয়ানার কার্নালে। দু’টি মসজিদ তাঁর অমাত্যরা তৈরি করান, একটি সম্ভলে, অন্যটি (ছিল) অযোধ্যায়। তৈমুরি রীতির স্থাপত্যের কিছু উপাদান এগুলিতে থাকলেও সেই জটিল প্রযুক্তিতে কাজ করার মতো দক্ষ স্থপতি তাঁর হাতে ছিল বলে মনে হয় না, ছিল না বড় আকারের স্থাপত্য তৈরির মতো অর্থবল, সেনাদের বেতন দিতেই টাকা খরচ হয়ে যেত। কাজেই স্থানীয় শিল্পী-কারিগরদের দিয়েই কাজ করতে হয়েছে, যাঁরা সুলতানি আমলের নির্মাণশৈলীতে অভ্যস্ত ছিলেন। হুমায়ুনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, পালিয়ে বেড়ানোর ফাঁকে যেটুকু সময় পেয়েছেন তাতে বড় আকারের স্থাপত্য গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। দিল্লির ‘পুরানা কিলা’য় শের মণ্ডল, আর আগরায় কাচপুরার বিধ্বস্ত মসজিদ ছাড়া হুমায়ুনের তৈরি করা আর কিছুই রক্ষা পায়নি। তৈমুরি রীতির শেষ উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য দিল্লিতে হুমায়ুনের সমাধি, যা সরাসরি বুখারার স্থপতি মির্জা গিয়াস তৈরি করেন। তবে মোগলদের পরবর্তী সমাধিসৌধের উপর এর প্রভাব যথেষ্ট। বস্তুত ১৫৬৫-তে আগরা দুর্গ তৈরি শুরু করার মধ্যে দিয়ে আকবর যে বিপুল নির্মাণ-প্রকল্পে হাত দিলেন, সেটা নতুন এক ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর সূচনা করল, যাকে নিছক মোগল বলে চিহ্নিত করা ভুল হবে।
দ্বাদশ শতকের শেষ থেকে ষোড়শ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত দিল্লির সুলতানি আমলে যে সব স্থাপত্য তৈরি হয়েছে, পূর্ববর্তী ভারতীয় শৈলীর অনেক কিছুই সেখানে মিলেমিশে গিয়েছিল। একেবারে গোড়ার দিকের মসজিদে মন্দির স্থাপত্যের নানা অংশ ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে দিল্লির কুতুব মসজিদ (১১৯১-৯২) আর অজমেরের আড়াই দিন কা ঝোপড়া (১১৯২) সম্বন্ধে এই অভিযোগ সবচেয়ে জোরালো। আর এক স্থাপত্যবিদ মাইকেল মেস্টার ১৯৭২ সালেই এক প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, অন্তত অজমেরের মসজিদে ব্যবহৃত সব স্তম্ভই হিন্দু বা জৈন মন্দিরের অংশ নয়। ভারতীয় কারিগররা মন্দিরের অলঙ্কৃত স্তম্ভের অনুকরণে প্রচুর সাদামাটা স্তম্ভও তৈরি করেছেন, যেগুলো বসানো হয়েছে চোখের উচ্চতায়, আর তার উপরে আছে দু’সারি অলঙ্কৃত স্তম্ভ। এ রকম নজির আরও অনেক আছে, তা নিয়ে পরে (২০০৯ সালে) বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ফিনবার ব্যারি ফ্লাড, তাঁর অবজেক্টস অব ট্রান্সলেশন বইয়ে। রাজস্থানের বড়ি খাটু-তে এমনই এক মসজিদ দেখার সুযোগ বর্তমান লেখকের হয়েছে, যেখানে সরাসরি মন্দিরের স্থাপত্যাংশের ব্যবহার ন্যূনতম (শাহি মসজিদ, ১২০৩)। তা ছাড়া এগুলিতে কোথাও প্রকৃত খিলান বা গম্বুজের ব্যবহার হয়নি, মন্দিরের মতোই থাম, লিন্টেল আর করবেল পদ্ধতিতে গম্বুজ বসানো হয়েছে। আর পশ্চিমবঙ্গের মালদহে পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদের (১৩৭৪-৭৫) পাথরের মিহরাবগুলি যে একটি বাদে সব ক’টিই মন্দির-কুলুঙ্গির অনুকরণ, সরাসরি মন্দির থেকে তুলে আনা নয়, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন নাসিম আহমেদ বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০২)। কাজেই মন্দির ভাঙা নিয়ে নতুন করে ভাবার অনেকটাই পরিসর তৈরি হয়েছে। ক্যাথরিন দেখিয়েছেন,রাষ্ট্রের নির্দেশে মন্দির ভাঙার ঘটনা তখনই ঘটেছে, যখন সম্রাটের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। একে ধর্মীয় উন্মাদনা বলে ব্যাখ্যা করলে ভীষণ ভুল হবে।
মেস্টার-এর প্রসঙ্গ তুলে অন্য এক প্রবন্ধে ক্যাথরিন এই বিষয়টিও আলোচনা করেছেন। প্রাক্-দ্বাদশ শতকের মন্দির-স্থাপত্যের নানা দিক কী ভাবে মুসলিম শাসকদের নির্মাণ-প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল, সুলতানি আমল হয়ে তা পৌঁছল আকবরের জমানায়, তা এই সব আলোচনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। ভারতীয় স্থাপত্যের এই নতুন রূপ এক দিকে মধ্য এশিয়া ও পারস্য, অন্য দিকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে নানা উপাদানে পুষ্ট হয়েছে, যার শিকড় কিন্তু ভারতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই নিহিত। অন্ধকার যুগ তো নয়ই, কেউ কেউ একে ভারতীয় স্থাপত্যের নবজাগরণ বলেও চিহ্নিত করেছেন।
মোগল যুগের ভারতীয় স্থাপত্যের এই বহুত্ববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি ক্যাথরিন আরও দু’টি দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। একটি হল রাজধানী বা রাজকীয় শাসনকেন্দ্রের বাইরে তাকানো। লাহোর, দিল্লি, আগরা, ফতেপুর সিক্রি ইত্যাদি ছাড়াও সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে রাজপ্রতিনিধি বা উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা যে বিপুল স্থাপত্যকর্মের পৃষ্ঠপোষণা করেছেন, যেখানে আঞ্চলিক প্রভাব নানা ভাবে স্পষ্ট, তার অনেকটাই এর আগে অনালোচিত ছিল। একে ক্যাথরিন ‘সাব-ইম্পিরিয়াল পেট্রনেজ’ বা উপ-রাজকীয় পৃষ্ঠপোষণা আখ্যা দিয়েছেন, এবং এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন রাজা মানসিংহের প্রাসাদ, মন্দির ও মসজিদ নির্মাণের কথা। আর অন্যটি হল মোগল সাম্রাজ্যের অন্ত্যপর্বের স্থাপত্যের কথা, যাকে পূর্ববর্তী গবেষকরা আলোচনার অযোগ্য বা অপজাত শৈলীর উদাহরণ বলে গুরুত্ব দেননি।
শুধু তা-ই নয়। ক্যাথরিন তাঁর অনুসন্ধানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ইসলামি স্থাপত্যের যে বিপুল ঐতিহ্যের সন্ধান দিয়ে গেছেন, তা পরবর্তী গবেষকদের পথ দেখাবে। তাঁর লেখাগুলি খুঁটিয়ে পড়ার এটাই উপযুক্ত সময়।