—প্রতীকী ছবি।
শিক্ষিত মানুষজনকে ভোট দাও, অশিক্ষিত রাজনীতিকদের চাই না— এই মত পোষণ করেছিলেন শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের এমন কথা বলার জন্য তাঁর চাকরি গিয়েছে। দিল্লিতে এক সংস্থার অনলাইন টিউটোরিয়াল ক্লাস নেওয়ার সময় মন্তব্যটি করেছিলেন করণ সাঙ্গোয়ান, অতঃপর সংস্থার কর্তারা তাঁকে বরখাস্ত করলেন। কর্তৃপক্ষের তরফে কারণও দেখানো হয়েছে— সংস্থার নিয়মবিধি অনুযায়ী শিক্ষার্থীর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ও রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ। বৌদ্ধিক মহলে এই ঘটনায় তোলপাড়— অনেকেরই ধারণা, দেশের সরকারে বসে থাকা ক্ষমতাবানদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কটাক্ষের মুখে পড়েছে বলেই আসলে শিক্ষকের চাকরিটি গেল। আইপিসি, সিআরপিসি ইত্যাদির পরিবর্তে বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের আনা বিল তথা আইনের প্রসঙ্গেই করণ বলেছিলেন ‘শিক্ষিত’ নেতাদের ভোট দেওয়ার কথা।
আমাদের দেশে সব কিছু নিয়েই রাজনীতি হয় বা হতে পারে, তাই সম্ভাবনাদের বাতিল করতে নেই। করণকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার পিছনে হয়তো রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, হয়তো নেই৷ তবে দেশের অগণিত মানুষের সঙ্গে রাজনীতির কেষ্টবিষ্টুরাও এই শিক্ষকের চাকরি হারানোর সমালোচনা করেছেন। কংগ্রেসের মুখপাত্র জোরগলায় প্রশ্ন করেছেন, সত্যের মুখোমুখি যাঁরা দাঁড়াতে অক্ষম, নবীন প্রজন্মকে তাঁরা কী শেখাবেন? শিবসেনা সাংসদের মতে, ছাত্রদের সঙ্গে ইতিবাচক কথোপকথনের জন্য শিক্ষকের চাকরি যাওয়া একেবারেই অনুচিত। অরবিন্দ কেজরীওয়াল বলেছেন, নিরক্ষর ব্যক্তি সম্মানের পাত্র হতেই পারেন, কিন্তু রাজনীতিতে জনপ্রতিনিধিত্ব করা ব্যক্তির কি শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন নেই? অশিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে কি এই সময়ে দাঁড়িয়ে দেশ গড়ার কাজ করা সম্ভব?
গণতন্ত্র মাথা গোনে, মগজ নয়, এ কথা বহুলপ্রচলিত। এর সমর্থনে বহু যুক্তি আছে, বিপক্ষেও মত কম নেই। তবে ‘শিক্ষা’র সঠিক সংজ্ঞা আর ‘শিক্ষিত’ শব্দের যথার্থ মূল্যায়ন আজও তর্কাতীত নয়৷ এ ক্ষেত্রে যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথাই ধরে নিই তা হলে বলতে হয়, ভারতের আইনসভায় প্রবেশের জন্য এর কোনও বেড়া বেঁধে দেওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানের নিরিখে শিক্ষিত এবং স্বশিক্ষিত মানুষের সেখানে অবাধ প্রবেশ, শুধু নির্দিষ্ট একটি বয়স এবং ভারতের নাগরিকত্বই এ ক্ষেত্রে ছাড়পত্র। মাথা থেকে মগজের দূরত্ব পেরোতে না পারলে রাজনীতির পাশায় চতুর দান দিয়ে আইনসভায় ঢোকার জন্য জনাদেশপ্রাপ্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া দারিদ্র ও নিরক্ষরতায় আকীর্ণ এ দেশে যদি শিক্ষার মানদণ্ড দিয়ে আইনসভায় প্রবেশাধিকার মাপতে যাওয়া হয়, সে দণ্ড রাজদণ্ড হয়ে বহু জনপ্রতিনিধিকেই বৈষম্যের শিকার বানাবে।
তবু করণ সাঙ্গোয়ানের কথা কি বাতিল করে দেওয়া চলে? এই মুহূর্তে ভারতের লোকসভায় এমন অনেক সদস্য আছেন যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির মধ্যে। বিশেষত গুজরাত যে সব নেতাকে গত নির্বাচনে ভোটে দাঁড় করিয়েছিল, তাঁদের পঁয়ষট্টি শতাংশই স্কুলের গণ্ডি পেরোননি। দুই শতাংশ সম্পূর্ণ নিরক্ষর, তিন শতাংশ শিক্ষার জায়গায় লিখেছেন ‘আদার্স’। স্কুল না পেরোনো, এমনকি স্কুলে না যেতে পারা জনপ্রতিনিধিরা এক বিরাট অংশের ভারতের প্রতিনিধি: যে ভারত দরিদ্র, নিরন্ন, নিরক্ষর। তাঁদের সঙ্গে না নিলে ‘সবাই রাজা’র গণতান্ত্রিক গল্প পূর্ণ হবে না। এই যুক্তির উল্টো পিঠও আছে। এই স্বল্পশিক্ষিত বা নিরক্ষর ব্যক্তিরা কি সত্যিই আজকের দিনে দেশ চালানো, দেশের আইন প্রণয়নে সদর্থক ভূমিকা নেওয়ার অধিকারী? না কি তথাকথিত অধিক-শিক্ষিত নেতারা তাঁদের ব্যবহার করেন শুধুই ‘হাত তোলা’র কাজে? স্ববিরোধী সিদ্ধান্তকেও সমর্থনের সম্ভাবনা কি এ ক্ষেত্রে থেকে যায় না? মহাকাশ গবেষণা নিয়ে যদি লোকসভায় কোনও বিল আসে, ভোটাভুটি হয়, তথাকথিত নিরক্ষর সদস্যের তো হুইপ-নির্ভর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই কোনও?
ভারতের গণতন্ত্রে হাজারো বৈচিত্র ও জটিলতা। অর্থনীতি, সামাজিক বিষয়, প্রতিরক্ষা, বিজ্ঞানচর্চা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে এই সব জটিলতা মাথায় রেখে আইন প্রণয়ন করতে গেলে, তাকে সমর্থন বা বিরোধিতা করে বিতর্কে যোগ দিতে গেলে কি ন্যূনতম শিক্ষার প্রয়োজন নেই? যদি কোনও সদস্য তা না করেন, তিনি কি তাঁর নির্বাচকদের প্রতি অবিচার করছেন না? অবশ্য এ ক্ষেত্রে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই দোষ দিলে চলবে না: আইনসভার রীতিনীতি শেখা, বিল নিয়ে আলোচনার আগে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া, এ সব কাজে ক’জনেরই বা আগ্রহ? অনেক সদস্য আইনসভার অধিবেশন চলাকালীন নিজ কাজে ব্যস্ত থাকেন, এঁদেরও কি ‘শিক্ষিত’ জনপ্রতিনিধি বলা চলে? আইন প্রণেতারা যখন পারস্পরিক অশালীন ভঙ্গি বা কটূক্তি করেন, সেও তো শিক্ষার অভাব— সেই অশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শংসাপত্রের পরোয়া করে না। বৈষম্যমূলক, অবৈজ্ঞানিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন উক্তি ও আচরণে গণতন্ত্রের পীঠস্থান আজকাল প্রায়ই পর্যুদস্ত হয়।
শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশ্নটির পুনর্জাগরণকে তাই স্বাগত জানানো দরকার। আইনসভায় কিছু বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কি প্রতি দল থেকে ন্যূনতম নির্দিষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন কয়েকজনকে পৃথক ভাবে সুযোগ দেওয়া যায়? আইনসভায় প্রবেশাধিকারপ্রাপ্তদের জন্য কি বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা যায়? করণ সাঙ্গোয়ান এক টিউটোরিয়াল ক্লাসেই আলোড়ন তুলে দিয়েছেন। দেশ নিরক্ষর নেতার হাতে সুরক্ষিত কি না, তথাকথিত শিক্ষিত নেতার হাতেও স্বাধীন কি না, এই আলোচনার কেন্দ্রে চাকরি-হারানো শিক্ষকের আবেদনটি থেকেই যাবে। সময় বদলাচ্ছে, প্রশ্নের উত্তরগুলো বদলাবে না?