আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্রতি বছর ১৫০টি দেশে পরিবেশপ্রেমীরা পালন করেন এই দিনটি। ‘ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম’ এ বছরের থিম হিসেবে বেছেছে ‘বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার’। বাস্তুতন্ত্রের চারটি মূল উপাদান: বায়ু, জল, মাটি এবং জীববৈচিত্র। বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই বলছেন, এই উপাদানগুলি তাদের গুণগত মান হারাচ্ছে। আমরা যে পরিবেশে বেঁচে আছি, সেখানে প্রতিটি প্রাণ ও উপাদান পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটি উপাদান ক্ষতিগ্রস্ত হলেই আঘাত লাগে প্রকৃতির ভারসাম্যে, এবং এর অন্তিম পরিণতিতে আমাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।
২০০৯ সালে প্রকৃতি-বিজ্ঞানী ইয়োহান রকস্ট্রম ও তাঁর সহযোগী গবেষকরা নেচার পত্রিকায় ‘আ সেফ অপারেটিং স্পেস ফর হিউম্যানিটি’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে তাঁরা বলেছিলেন, আমরা যে বাস্তুতন্ত্র থেকে নানা উপাদান সংগ্রহ করে বেঁচে আছি, তাদের প্রত্যেকটির ভারসাম্যের বাহ্যিক সীমা বা প্ল্যানেটারি লিমিট আছে। সেই নিরাপদ সীমা অতিক্রম করলেই বিপন্ন হবে আমাদের অস্তিত্ব। রকস্ট্রমরা যে নয়টি বিষয়ের কথা বলেছিলেন, সেগুলি হল— জলবায়ুর পরিবর্তন, ওজ়োন স্তরের অবক্ষয়, বাতাসে ভাসমান জলকণা ও ধূলিকণার পরিমাণ, সাগরের অম্লতার মাত্রা, ক্রমবর্ধমান জলের ব্যবহার, রাসায়নিক দূষণ, যথেচ্ছ ভূমি ব্যবহার, জীববৈচিত্রের অবক্ষয়, এবং নাইট্রোজেন ও ফসফরাস চক্রের বিঘ্ন ঘটা। তাঁরা দেখিয়েছিলেন, তিনটি ক্ষেত্রে প্ল্যানেটারি লিমিট ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত— জীববৈচিত্র, নাইট্রোজেন চক্র এবং জলবায়ুর পরিবর্তন। অন্য দিকে, সাগরের জলের অম্লতা বৃদ্ধির হারও উদ্বেগজনক।
জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়েও আলোচনা কম হয়নি। ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বা আইপিসিসি-র একাধিক প্রতিবেদনে বিষয়টির নানা দিক আলোচিত হয়েছে। ১৭৫০-২০১৯ সালের মধ্যে পৃথিবীর বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড ২৮০± ১০ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম) থেকে বেড়ে প্রায় ৪১০ পিপিএম হয়েছে। গত আট লক্ষ বছরে এত পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড বাতাসে কখনও ছিল না। এই সময়ের মধ্যে গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। আইপিসিসি বলছে, ২০১৭ সালে বাতাসে যত পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড ছিল, আগামী এক দশকের মধ্যে তাকে অন্তত ৪৯ শতাংশ কমাতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় উত্তাপ যদি আর ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তবে বাস্তুতন্ত্রে প্রবল আঘাত লাগবে। কিন্তু, এই লক্ষ্যমাত্রা অধরাই থেকে যাওয়ার আশঙ্কা তীব্র।
এই ঔদাসীন্য অব্যাহত থাকলে এই শতাব্দীর শেষে ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস উত্তাপ বাড়বে— এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও জানিয়ে দিচ্ছে যে, কতটা উষ্ণ হয়ে উঠছে আমাদের নীল পৃথিবী। আয়লা, বুলবুল, আমপান বা ইয়াস এমন ভাবে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে উপকূলে বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকা ও বাস্তুতন্ত্রকে, যা আগে কদাচিৎ হত। অল্প সময়ের মধ্যে অতিবৃষ্টির জন্য প্লাবন, তার পর দীর্ঘ সময় ধরে অনাবৃষ্টির ফলে খরা হচ্ছে। আইপিসিসি-র গবেষণা বলছে, কিছু এলাকার জল মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণ হয়ে ওঠার ফলে সামুদ্রিক প্রাণীরা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। উত্তাপ ও বৃষ্টিপাতের তারতম্য ফসলের উৎপাদনকে প্রভাবিত করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করা-সহ সুস্থায়ী উন্নয়নের যে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল, তা এখন অলীক কল্পনা বলেই মনে হচ্ছে।
লাগামছাড়া শিল্পায়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কৃষিক্ষেত্রে যথেচ্ছ রাসায়নিকের প্রয়োগ, বনাঞ্চলের সঙ্কোচন, যত্রতত্র দূষিত বর্জ্য নিক্ষেপ করার ফলে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড ফর নেচার বা ডব্লিউডব্লিউএফ প্রতি দু’বছর অন্তর লিভিং প্ল্যানেট রিপোর্ট শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই রিপোর্টে প্রকাশিত হয় লিভিং প্ল্যানেট ইনডেক্স নামে জীববৈচিত্রের একটি আবিশ্ব সূচক। কোনও অঞ্চলে জীববৈচিত্র কতখানি, এই সূচকে তা মাপা হয়, এবং সূচকের হ্রাস-বৃদ্ধি থেকে বোঝা যায়, অঞ্চলটিতে জীববৈচিত্র কমছে কি না। ২০২০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বিপন্ন জীববৈচিত্রের যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে, তা সচেতন নাগরিকদের উদ্বিগ্ন করবে। ডব্লিউডব্লিউএফ জানিয়েছে, ১৯৭০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে পৃথিবীর পাখি, মাছ, উভচর প্রাণী ও সরীসৃপদের সংখ্যা অন্তত ৬৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। নদী বা জলাভূমিতে থাকে, এমন প্রাণীর সংখ্যা প্রায় ৮৪ শতাংশ কমেছে। আমাজ়নের জঙ্গলের মহাদেশ দক্ষিণ আমেরিকার ক্রান্তীয় অঞ্চলে এই সূচক হ্রাস পেয়েছে ৯৪ শতাংশ; আফ্রিকা মহাদেশে ৬৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে ৪৫ শতাংশ, উত্তর আমেরিকায় ৩৩ শতাংশ এবং ইউরোপ-এশিয়ায় ২৪ শতাংশ। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল থেকে অন্তত ১০ লক্ষ প্রজাতি বিলুপ্ত হতে চলেছে।
মাটি জীববৈচিত্রের আঁতুড়ঘর। ৯০ শতাংশ স্থলচর প্রাণীর জীবন মূলত মাটি-নির্ভর। পৃথিবীর বসবাসযোগ্য ভূমির তিন-চতুর্থাংশ এলাকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য মানুষ ইতিমধ্যেই বদলে দিয়েছে। ইউরোপিয়ান কমিশন-এর জয়েন্ট রিসার্চ সেন্টার-এর গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে, ক্রমবর্ধমান উত্তাপ, আর্দ্রতার তারতম্য, বনাঞ্চলের সঙ্কোচন, সর্বোপরি কৃষিজমিতে লাগামছাড়া রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োগের ফলে মাটিতে বসবাসকারী অণুজীবদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। বিঘ্নিত হচ্ছে পুষ্টিচক্র। হারিয়ে যাচ্ছে কেঁচো, মৌমাছি, জোনাকি এবং জলাশয়ের গেঁড়ি, গুগলি, শামুক এবং নানা ধরনের মাছ। পৃথিবীর অন্তত ৫২ শতাংশ কৃষিজমি প্রাকৃতিক গুণ হারিয়ে বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতি বছর যত পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস বাতাসে মেশে, তার ২৯ শতাংশ আমাদের খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত। কৃষিব্যবস্থার এত প্রসারের পরও কিন্তু পৃথিবীতে অন্তত ৮২ কোটি মানুষ অর্ধাহারে বা অনাহারে আছেন। অথচ, উৎপাদিত খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ অপচয় হয়। পৃথিবীতে প্রতি বছর যত খাদ্য নষ্ট হয়, তার মূল্য প্রায় এক লক্ষ কোটি আমেরিকান ডলার।
মানুষ বাস্তুতন্ত্র থেকে নানা উপাদান নিয়ে বেঁচে থাকেন। এক জন মানুষ বাস্তুতন্ত্রকে যতটা প্রভাবিত করেন, তা হিসেব করা হয় তাঁর ‘ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট’ থেকে। পরিমাপ করার একক হল ‘গ্লোবাল হেক্টর’। কোনও দেশের জনসংখ্যা, ভোগ্যদ্রব্যের উৎপাদন, অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের আমদানি ও রফতানি এবং বর্জ্যের পরিমাণ ইত্যাদির নিরিখে ‘ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট’ পরিমাপ করা হয়। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এক জন মানুষের ‘ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট’ ১.৭ গ্লোবাল হেক্টর-এর মধ্যে থাকলে পৃথিবী তার প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ক্ষতি সংশোধন করে নিতে পারে। কিন্তু এখন উত্তর আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া-সহ উত্তর এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়াতে এক জন মানুষের ‘ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট’ ৫ গ্লোবাল হেক্টর অতিক্রম করেছে; ভারতে এখনও তা ১.৬ গ্লোবাল হেক্টর। বর্তমান পৃথিবীতে জনপ্রতি ‘ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্ট’ ২.৮ গ্লোবাল হেক্টর, অর্থাৎ আমরা প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সীমা বা ‘বায়ো-ক্যাপাসিটি’ অতিক্রম করে বেঁচে আছি।
ফলে, প্রতি দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে প্রকৃতির স্থায়ী আমানত বা ‘ন্যাচারাল ক্যাপিটাল স্টক’। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষয়িষ্ণু উপাদানগুলি হল— ভূগর্ভের জলভান্ডার, বহমান নদী, হিমবাহ, মাটি, বায়ু, বনাঞ্চল, জীববৈচিত্র ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হল, এ ভাবে আর কত দিন? এই অতিমারি বিজ্ঞানের অগ্রগতির অহঙ্কার ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। জীবনদায়ী গঙ্গা এখন শববাহিনী। মানুষ অক্সিজেনের সন্ধানে হন্যে। তবু শাসক উদাসীন। মানুষের জীবন নয়, অপ্রয়োজনীয় ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’ প্রকল্পের রূপায়ণ অগ্রাধিকার পায়!
এই সঙ্কটকালে আর এক বার স্মরণ করি রবীন্দ্রনাথকে। ১৯৩৪ সালে ‘উপেক্ষিতা পল্লী’ নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “প্রকৃতিকে অতিক্রমণ কিছু দূর পর্যন্ত সয়, তার পরে আসে বিনাশের পালা।”
সভাপতি, পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ