— ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গে তখন বাম সরকার; তৎকালীন মুখ্যসচিব অমিত কিরণ দেব আধিকারিক ও পরিবেশবিদদের নিয়ে একটি মিটিং ডাকলেন কলকাতা শহরের কিডনি বলে খ্যাত বিশ্ববন্দিত পূর্ব কলকাতার জলাভূমি সংরক্ষণের রাস্তা খুঁজতে। মিটিংয়ে প্রশ্ন উঠল, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি বুজিয়ে রাজারহাটের পিছন দিকে তৈরি হওয়া যে হাউজ়িং কমপ্লেক্সটি কলকাতা হাই কোর্ট ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল, সেই আপাদমস্তক বেআইনি নির্মাণকে বাঁচাতে কেন আদালতের বাইরে সমঝোতা করে নিল সরকার?
সম্প্রতি গার্ডেনরিচ বিপর্যয়ের পর নানা চর্চায় জলা ভরাটের কথা উঠতে দেখে মনে হচ্ছে, যেন বাঙালি সদ্য রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ জানতে পারল যে, কলকাতা ও রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় জলা ভরাট করে বহুতল তৈরি করা হয়! নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকারের আমলে জলা বোজানো বেড়েছে; কিন্তু বাম জমানার মাঝামাঝি নব্বইয়ের দশক থেকেই এই প্রবণতার ঢাকে কাঠি পড়ে। নব্বইয়ের দশকে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি বুজিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার তৈরি হয়ে যেত সরকারি মদতে, যদি না হাই কোর্ট ওই বেআইনি নির্মাণ বন্ধ করত! তথ্য এও বলছে যে, ১৯৮৬ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে বৃহত্তর কলকাতায় জলাভূমির পরিমাণ ১৪ থেকে ৬ শতাংশে এসে ঠেকেছিল। হাওড়ার জয়পুর বিল, হুগলির ডানকুনি ও হিন্দ মোটরের বিস্তীর্ণ জলাভূমি, উত্তর ২৪ পরগনার কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে লাগোয়া বিলকান্দা জলা— এ সব অঞ্চল জুড়ে একের পর এক অবৈধ নির্মাণ হয়েছে। খাস দক্ষিণ কলকাতায় সরকারি হিসাবেই প্রায় এক একরের উপরে বিক্রমগড় জলা বুজিয়ে তৈরি হয়েছে ঝাঁ চকচকে বহুতল। প্রশাসন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল প্রয়াত বাম নেতা সুভাষ চক্রবর্তীর ভাষায় নির্বিকল্প সমাধিতে।
বর্তমানেও প্রশাসন সেই সমাধিতেই। পূর্ব কলকাতার জলাভূমি বোজানোর জন্য সরকারি সংস্থার দ্বারা করা অভিযোগের সংখ্যাই এখন ৫০০ ছুঁইছুঁই। গার্ডেনরিচ, বেহালা, ঠাকুরপুকুর, ই এম বাইপাসের ধার ঘেঁষে চলছে জলা বুজিয়ে বহুতল করার প্রতিযোগিতা। কলকাতার মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম বার বার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও এবং কয়েক মাস আগে জলা বোজানোর জন্য পুরসভার এক শ্রেণির কর্মী ও পুলিশের দিকে আঙুল তুললেও কাজের কাজ বিশেষ হয়নি। এটা নিছক সমাপতন নয় যে, বাম আমলের একাধিক বিষয় নিয়ে এই জমানায় কমিশন ইত্যাদি বসলেও কোনও পরিবেশগত বিষয় বা জলা বুজিয়ে বেআইনি বহুতল তৈরির মতো দুর্নীতি নিয়ে কোনও তদন্তই বসেনি।
আসলে সর্ষের মধ্যেই ভূত। যে ‘পলিটিক্যাল রেন্ট সিকিং’ মডেলকে প্রাতিষ্ঠানিক বানিয়ে ইলেক্টোরাল বন্ড বাজারে ছেড়ে হাজার হাজার কোটি টাকা জমা করেছে বিজেপি-সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, তারই স্থানীয় এবং খানিকটা অপ্রাতিষ্ঠানিক মডেল হল কলকাতা ও আশপাশে জলা বুজিয়ে বাড়ি করার ঘটনা, যার সুবিধা নিয়েছে বা নিচ্ছে যে যখন ক্ষমতায় আছে, সেই-ই। আসলে সব রাজনৈতিক দলের এক অংশ সময়, সুযোগ ও প্রতিপত্তি অনুযায়ী নিজের ক্ষমতাকে কমবেশি ভাড়া দিয়ে বাজার থেকে বেআইনি টাকা তোলে। এ ক্ষেত্রেও তাই।
পাশাপাশি বিষয়টির সামাজিক অবস্থানটাও বুঝতে হবে। যে কলকাতা শহরে এক সময় ৮০০০-এরও বেশি জলাভূমি ছিল, সেটির সংখ্যা আদালতে পুরসভার দেওয়া সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ীই এখন প্রায় অর্ধেক; বছরে গড়পড়তা দেড়শোর মতো জলা ভরাট হয়েছে গত কয়েক দশক জুড়ে। অভিজ্ঞতা বলে, এই ভরাট মূলত হয় বস্তি অঞ্চলে বা এমন জায়গায়, যেখানে অপেক্ষাকৃত গরিব মানুষ থাকেন ও সামাজিক নজরদারি দুর্বল। আসলে যে মানুষটির কাছে কয়েক কাঠার একটি পুকুর বিনা আর কিছু নেই, তিনি আইনি পথে না পারলেও বেআইনি ভাবে সেটি বিক্রি করে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য কিনতে চাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক। এও স্বাভাবিক যে, এই সুযোগ নিয়ে নিম্ন ও মধ্য মধ্যবিত্ত এ সব বেআইনি বহুতলে ফ্ল্যাট কিনতে চাইবেন। এই প্রবণতা মহামারির রূপ নেয়, যখন তার সঙ্গে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যক্তিরা লাভের গুড়ের ভাগ পেতে যোগ দেন। প্রসঙ্গত গার্ডেনরিচের যে ১৩৪ নম্বর ওয়র্ডের বেআইনি নির্মাণ ভেঙে পড়া নিয়ে বিতর্কের শুরু, সেটি গত জনশুমারি অনুযায়ী, কলকাতার অন্যতম গরিব ও বস্তিপ্রবণ অঞ্চল। পাশাপাশি যে বিপুল সংখ্যক জলা সরকারি জমিতে আছে, যার একটা বড় অংশ বস্তি অঞ্চলে বা পূর্ব কলকাতায়; সেখানে তা ভরাট হয় অসাধু প্রোমোটার, স্থানীয় রাজনৈতিক দাদা-দিদি আর প্রশাসনিক কর্তাদের যোগসাজশে। অভিজ্ঞতা বলে, এখন কলকাতায় এমন কিছু জলাশয় আছে যা ইতিমধ্যে খাতায়-কলমে ‘বাস্তু’ হয়ে রয়েছে, যাতে পরে ভরাট হলে বলা যাবে ‘এটা তো জলা ছিল না’।
সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক সক্রিয়তার পাশাপাশি প্রয়োজন বাজারের ফর্মুলাই। প্রথমত চাই জলাগুলির দ্রুত ম্যাপিং; তার পর ব্যক্তিমালিকাধীন যে সব জলা বা পুকুর মানুষ রাখতে চান না বা পারবেন না, সরকারের উচিত বাজারের দামে সেগুলি অধিগ্রহণ করা ও জলা বাঁচিয়ে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা। সরকারি জলার ক্ষেত্রে কাজটা সহজতর। যদি স্বাস্থ্যসাথী বা লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্য সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করতে পারে, তবে কলকাতা ও রাজ্যের জলা ও জলাভূমিকে বাঁচাতে নয় কেন? বিশেষত যখন জানা আছে, জলা ও জলাভূমি না বাঁচলে শহরটাও বাঁচবে না?
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতিতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মধ্যে একটি পুকুর বোজানো নিয়ে লিখেছেন, “শেষকালে এল সেই পুকুরের কাল ঘনিয়ে, পড়ল তার মধ্যে গাড়ি গাড়ি রাবিশ।” কিন্তু গল্পটার সেখানেই শেষ নয়, পরবর্তী কালে ঠাকুর পরিবারই তাদের বাগানের মধ্যে আর একটি পুকুর খনন করে। এই ইতিহাস থেকে কি আমরা শিক্ষা নিতে পারি না?