—প্রতীকী ছবি।
গত কয়েক দশক ধরে গোটা দুনিয়া একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে— দূষণমুক্ত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কী করে আনা সম্ভব? ক্রমবর্ধমান বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে প্রশ্নটা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞানীরা আমাদের সতর্কবাণী দিয়ে চলেছেন যে, প্রাক্-শিল্পবিপ্লব সময়ের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যদি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি বাড়ে, তা হলে পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা একটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির উপর রেখে যাব। উৎপাদনে যত তেল বা কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার হবে, পরিবেশ আরও কার্বন-আকীর্ণ হয়ে উঠবে। একটি সময় আসবে, যখন আমাদের ফেরার রাস্তা সব বন্ধ। তাই বোঝা দরকার যে, কী ভাবে পরিবেশ দূষণমুক্ত রেখে একটি অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি আসতে পারে, এবং সেই পথে কী কী অন্তরায় আছে।
অর্থনৈতিক বৃদ্ধির উৎস হল উৎপাদন। উৎপাদন বাড়লে জাতীয় আয় বাড়বে। কিন্তু শুধু সামগ্রিক আয় বাড়লেই চলবে না, এর সঙ্গে মাথাপিছু আয়ও বাড়তে হবে। প্রশ্ন হল, এই বৃদ্ধি কি সাসটেনেব্ল বা সুস্থায়ী? সুস্থায়ী বৃদ্ধি কথাটি সারা পৃথিবী জুড়ে অর্থশাস্ত্রীদের মুখে মুখে ঘুরছে। বিভিন্ন লোক এর বিভিন্ন অর্থ করেন। পরিবেশসচেতন লোকেরা বলবেন, যে বৃদ্ধির ফলে ভূপৃষ্ঠের উত্তাপ সমানে বাড়ছে, সেটি কখনওই সুস্থায়ী নয়। প্রশ্ন হল, কী করে দেশে সুস্থায়ী দূষণহীন অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হবে? এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। উৎপাদনের জন্য শ্রমশক্তি, যন্ত্র আর প্রযুক্তি লাগে। এখনও পর্যন্ত আমাদের যন্ত্র আর প্রযুক্তি জীবাশ্ম জ্বালানির উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। এর ফলে দু’টি সমস্যা হচ্ছে। প্রথমত, উৎপাদনের জীবাশ্মভিত্তিক উপাদানগুলি পুনর্নবীকরণযোগ্য নয়, কারণ এগুলি তেল আর কয়লার উপর নির্ভরশীল, যা এক দিন ফুরিয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের উৎপাদনের উপাদান থেকে যা কার্বন নিঃসরণ ঘটে, তা বিশ্বের জলবায়ুর পক্ষে মারাত্মক। সুতরাং জীবাশ্মভিত্তিক বৃদ্ধি সুস্থায়ী নয়।
তা হলে উপায়? প্রথম কাজ হল বৃক্ষরোপণ করে সবুজায়নের চেষ্টা করা। গাছ পরিবেশ থেকে কার্বন শুষে নেয়। কিন্তু, সবুজায়নের একটি সীমা আছে, কারণ জমির পরিমাপ সীমিত। যে শহর কংক্রিটের জঙ্গল, সেটির সবুজায়ন করা সহজ নয়, যদিও দিল্লিতে এখন এই রকম উদ্যোগ চোখে পড়ে।
উৎপাদনের যে অংশ অপচয় হচ্ছে সেগুলিকে কোনও ভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনাও সুস্থায়ী উন্নয়নের পথ। উৎপাদনের ফলে পরিবেশে যে কার্বন ছড়িয়ে পড়ে, তাকে কোনও পদ্ধতিতে ধরে আবার কারখানায় যদি ফিরিয়ে আনা যায়, তবে উৎপাদন আরও বাড়বে, পরিবেশও কার্বনমুক্ত হবে। এই পদ্ধতি, যাকে বলে কার্বন ক্যাপচার, তা বর্তমানে ইউরোপের অনেক দেশেই হচ্ছে।
তৃতীয় উদাহরণ হল প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার। প্লাস্টিক এক বার পরিবেশে মিশলে তা মিলিয়ে যেতে প্রচুর সময় লাগে। বিশেষত প্লাস্টিকচূর্ণ— যাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলে— মাটির দীর্ঘমেয়াদি দূষণের জন্য দায়ী। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, ব্যবহৃত ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক জলের সঙ্গে মিশলে সেই জল বিষাক্ত হয়ে যায়। যে সব জীব মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, তাদের জন্য মারক হয়ে দাঁড়ায় এই প্লাস্টিকচূর্ণ। এ ছাড়া প্লাস্টিক-সঞ্জাত রাসায়নিক, যেমন থ্যালেট বা বিসফেনল-এ (বিপিএ) প্রাণিদেহে মারাত্মক ক্ষতি করে। সুতরাং প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার জরুরি। সে কাজ অবশ্য সারা বিশ্ব জুড়েই কম-বেশি হচ্ছে।
জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে, বাতাস, সৌরশক্তি আর জল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সুস্থায়ী উন্নয়নের পথে অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বাতাস আর সৌরশক্তির ব্যবহারে ইউরোপ অনেক এগিয়ে আছে। বাড়িঘর গরম রাখতে সেখানে অনেকেই সোলার প্যানেল ব্যবহার করেন। অনেক ভারী শিল্পে সৌরশক্তির ব্যবহার হচ্ছে। বাড়িতে গ্যাসের স্টোভ বদলে ইলেকট্রিক স্টোভ ব্যবহার হয়। জল থেকে বিদ্যুৎ তৈরি অবশ্য পৃথিবীতে বহু দিন ধরেই আছে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিবেশগত কিছু খারাপ দিক আছে— তাতে ভয়ঙ্কর প্লাবনের আশঙ্কা থাকে, যার ফলে মানুষ এবং জীবজন্তু বাস্তুচ্যুত হতে পারে। এর কিছু নজির ভারতে আছে।
দূষণহীন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন উৎপাদনে পুনর্নবীকরণ-অযোগ্য উপাদান কমিয়ে পুনর্নবীকরণযোগ্য উপাদানের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ানো। কথাটা বলতে সহজ, কিন্তু করা কঠিন— কারণ, এর জন্য উৎপাদন প্রযুক্তির খোলনলচে বদলানো প্রয়োজন, যেটি অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষে করা সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ। ইদানীং ধনী দেশগুলিতে পেট্রল আর ডিজ়েলের গাড়ি ছেড়ে বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ি তৈরি হচ্ছে। এই গাড়িগুলির দাম জীবাশ্ম জ্বালানি-চালিত গাড়ির তুলনায় অনেক বেশি। বৈদ্যুতিক গাড়ি চলে পুনর্নবীকরণযোগ্য দামি লিথিয়াম ব্যাটারি দিয়ে। টেসলা এ রকম একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি। যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁরা সমাজের রহিস লোক। গরিব দেশগুলিতে মুষ্টিমেয় মানুষ এ ধরনের বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার সামর্থ্য রাখেন।
দূষণহীন বৃদ্ধির আরও একটি অন্তরায় হল, যে দেশগুলি এই ব্যাপারে আগ্রহী, তারা নিজেরাই পরিবেশ দূষণহীন রাখতে পারছে না। বিবিসি-র একটি সমীক্ষা বলছে যে, আমেরিকা পৃথিবী জুড়ে দূষণের তালিকায় প্রথম সারিতে আছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষা বলছে যে, উন্নত দেশগুলির প্লাস্টিক ব্যবহার অনুন্নত দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এই পুনর্ব্যবহার-অযোগ্য উপাদানগুলি আমেরিকা এবং ইউরোপের অনেক দেশ তৃতীয় বিশ্বে চালান করে দেয় একটি মূল্য ধার্য করে।
তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি দেশের গল্প আলাদা। সুতরাং একই দাওয়াই সব দেশের জন্য কাজ করবে না। ভারতের কথাই যদি ধরি, এখানে ভারী শিল্পের উৎপাদনে প্রচুর কয়লার ব্যবহার হয়। বিদ্যুৎ এবং পরিবহণ সংস্থাতে প্রভূত পরিমাণে কয়লা, গ্যাস আর তেলের ব্যবহার হয়। অনেক মানুষের জীবিকা কয়লার উপর নির্ভরশীল। এই রকম একটি দেশকে যদি বলা হয় যে, ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বনমুক্ত হতে হবে, সেটি কী করে সম্ভব হবে? তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, আজ যা অসম্ভব মনে হচ্ছে, দশ বছর বাদে তা সম্ভব হতেই পারে। ইদানীং ভারতেও বিভিন্ন উপকূল অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে উইন্ডমিলের ব্যবহার দেখা যায়। ব্যাটারি-চালিত রিকশা, টোটো বেশ কিছু দিন হল চালু হয়েছে। তবু প্রয়োজনের তুলনায় তা এখনও যৎসামান্যই।
তবু এ কথা মানতেই হবে যে, ধীর লয়ে হলেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ষাটের দশকের গোড়াতে আমরা কখনও কি ভেবেছিলাম যে, আমাদের প্রত্যেকের পকেটে একটি মোবাইল ফোন থাকবে, সেটি আমাদের জুড়ে রাখবে গোটা দুনিয়ার সঙ্গে! কৃত্রিম মেধা-চালিত চ্যাটজিপিটি-র সঙ্গে বসে আড্ডা দেব! এই ঘটনাগুলি ঘটেছে উদ্ভাবনী শক্তির দাক্ষিণ্যেই। হয়তো আর দশ বছরের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির একটি সুলভ বিকল্প আবিষ্কার হবে। এর ফলে কত মানুষ বেকার হবেন, অর্থনৈতিক অসাম্য বাড়বে না কমবে, তা সময়ই প্রমাণ করবে। তবে পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে তো কোনও ক্ষতি নেই! ছোটবেলায় দেখতাম মধ্য কলকাতায় আমার বাড়ির পাশে আবর্জনার স্তূপ, উনুনের ধোঁয়ায় বাতাস ভারী। আজ সরকার ও জনসাধারণ, দু’পক্ষেরই সচেতনতা কিছু হলেও বেড়েছে। দোকান-বাজার করতে প্লাস্টিক ব্যাগ বর্জন করে কাপড়ের বা কাগজের ব্যাগের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। নেট জ়িরো কার্বন এমিশন নিয়ে ভাবনাচিন্তা, গবেষণা, মিটিং, সেমিনার হচ্ছে। জনমানসেও তার কিছুটা প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। ভাবতে ভাল লাগে, আগের সেই দিনগুলি বোধ হয় আমরা পার হয়ে আসছি।