এলেখা পশ্চিমবঙ্গালের হিতার্থেই। এ মন-কি-বাত আদরণীয় তামাম বঙ্গালির শুভার্থেই। বঙ্গালি, মানে, যাদের নাকি হাজার বছরেরও বেশি হিলারিয়াস হিস্ট্রি, যারা বঙ্গালি হলেও মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি, এ-দাওয়াই তাদের জন্যই। সর্বভারতীয়-আন্তর্জাতিক-মহাজাগতিক হয়ে উঠতে গেলে বঙ্গালিকে হতেই হবে আত্মবিস্মৃত। শিরদাঁড়া বড় বিপজ্জনক অঙ্গ। সোজা থাকার প্রয়াস চালায়। তাই তাকে তুলতুলে করে ফেলতে হবে, যাতে ভিন্দেহভাবনায় প্রতিস্থাপনীয় হয়। এবং সে-কাজ বঙ্গালির একার কম্ম নয় বলেই যুগে-যুগে অবতার ডাউনলোড করা হয়েছে এবং সে ট্র্যাডিশন ‘সগৌরবে চলিতেছে’। এই যুগলাঞ্ছিত কর্মযোগে বঙ্গালি যে জ্ঞানযোগে উন্নীত হয়নি, এমনও নয়। অনেকটাই পেরেছে। কিন্তু মঙ্গলঘটটি ভরে ওঠেনি।
বাবু বলতে কী বোঝায়, বঙ্কিমের বৈশম্পায়ন তা বোঝাতে সক্ষম হলেও পরিস্থিতি এদৃশ গহনঘনায়মান না হইয়া ওঠায় বঙ্গালি বলতে কী বোঝানো হইবেক, সেটা বিবেচনার সুযোগ পাননি। তবে, আংরেজো-কে-জ়মানে-কে সাহিত্যসম্রাট তো! তাই ইঙ্গিত বিলক্ষণ ছিল। আজ সঙ্করায়ণ সুসম্পন্ন করারই সুলগ্ন। সহজ কিছু নিয়ম। মনে রাখতে হবে, ‘আনন্দ্’ ছবির কাল গিয়াছে। ‘বাবুমশাই’ আর সম্মাননীয় সম্বোধন নয়। ‘বাঙালি’ শব্দটিই অসম্মানজনক। তাতে লুকিয়ে জাতিসত্তার স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিপদ। সে-ভাবনা বৈচিত্রের পেসমেকারে ধুকপুকানো ঐক্য বা ঐক্যের আস্তিনে টুকি মারা বৈচিত্রের বিরোধী। তাতে ভোট-বৈতরণির সাঁকো নড়ে এবং আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠা যায় না। ভাবতে হবে শুদ্ধজাতীয়তা, বিশ্বনাগরিকতার নিরিখেই। মনে রাখতে হবে, বিশ্বনাগরিক রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় একটাই ‘পোয়েট্রি’ লিখেছিলেন— ‘হোয়্যার দ্য মাইন্ড ইজ় উইদাউট ফিয়ার’। কাজেই, সঙ্কটের সভ্যতায় মনোনিবেশ করতে হবে। এবং সে কার্যক্রম অবিলম্বে শুরুর বদলে ‘ইন-নো-টাইম’ ‘লাগু’ করতে হবে। ‘লাগু’ ব্রহ্মবাণীই। কারণ, পঞ্চম ব্যাদে আছে, হিন্দি দেশভাষা না-হলেও, হিট-হিন্দি মৌলিক ভাষা না-হলেও তা রাষ্ট্রনেতার ভাষা এবং বিদ্বান নয়, রাজাই সর্বত্র পূজ্যতে।
মাছের চোখ তাই, বাঙালিত্ব বিস্মরণ। ‘এক পলকের একটু দেখা’ নয়, গাইতে হবে ‘এক ঝলকের একটু ঝাঁকি’ বা ‘ঝলক দিখলা যা’। এখন বাংলাতেই হিন্দি সোপ-সিরিয়াল হচ্ছে। তাতে বাড়াতে হবে বলিউডি গানের ব্যবহার। সংলাপে ‘বেটা’ ‘ড্যাড’, ‘মম’ ছড়াতে হবে হরির লুটের মতো। বেংলিশ-বান্দি শব্দ ‘বনাতে’ হবে ‘কিঁউ-কি’ থেকে ‘কেন-কি’র মতো। ইউটোপিয়া-ইকুয়েশনে তুলে ধরতে হবে গয়না-বেনারসি-শেরওয়ানি পরে ঘুমোতে যাওয়া কলহকুশল একান্নবর্তী পরিবার। গয়না জরুরিই। কারণ, ওটির সঙ্গে রয়েছে বাৎসরিক ধনত্রাসের অবাঙালি বাণিজ্যিক সম্পর্ক। যে অলঙ্কার সংস্থা সিরিয়ালে গয়না সরবরাহ বেশি করবে, দেওয়ালিতে তাদের গদিনদে মক্ষিকাও গলন্তি হবে না। পণ্যের বিজ্ঞাপনে ভুল বাংলাই বাঞ্ছিত। কাঙ্ক্ষিত বিকৃত উচ্চারণই। কর্তব্য বিজ্ঞাপনী-বার্তায় ইংরেজি-হিন্দি শব্দের মারকাটারি।
বিপ্লবে সর্বাগ্রে শত্রু চিনতে হয়। অবাঙালি হয়ে ওঠাও রাষ্ট্রবিপ্লব। ক্ষাত্রনীতি একই। যে বাঙালি গোটা বাক্য অবিমিশ্র বাংলায় বলতে পারে, তাকে শত্রু চিহ্নিত করতে হবে। বাংলা গান শোনা যাবে না। এফএম বাংলা বাজিয়ে ফেললে রেডিয়ো ভাঙতে হবে। বাংলা গান লিখতে একান্ত বাধ্য হলেও তাতে বাংলা শব্দ না রাখা শ্রেয়। রূপচাঁদ পক্ষীর নিহিত-শ্লেষ ঘিলুতেলে না ভেজে ‘লেট মি গো ওরে দ্বারী/ আই ভিজিট টু বংশীধারী’র মতো লিরিককে আদর্শ মানা যেতে পারে। নিজেকে আমির খসরু ভাবতে হবে। মনে করতে হবে, হিন্দি-ইংরেজি-বাংলার বকচ্ছপ মিশেলে আপনি উর্দুপ্রতিম ঐতিহাসিক কাব্যভাষ তৈয়ারির গুরুদায়িত্বলব্ধ। আর হ্যাঁ, বাংলা ‘নাইট্য’ দেখা যাবে না। বাংলা মুভি অবাঙালি না হয়ে উঠতে পারলে বর্জনীয়। বালবাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়ামেই পড়াতে হবে, ইংরেজি শব্দের অপব্যবহারে পারদর্শী করে তুলতে হবে। ‘ভোরে মর্নিংওয়াক’ করাতে হবে। ‘সাধারণ কমনসেন্স’ থেকেই ‘আপ টু শ্যামবাজার পর্যন্ত’ যাওয়াতে হবে। একই বাক্যে ‘বাই চান্স’ এবং ‘যদি’র একত্র-ব্যবহার বিস্মৃত হলে বোঝাতে হবে, বিশুদ্ধ বাক্যটি হতে পারে— ‘টেনশন হচ্ছে, ধরো, বাই চান্স যদি বিজেপি ক্ষমতায় না আসে!’ আলাপে ‘আই থিঙ্ক’ এবং ‘ইন ফ্যাক্ট’ বাড়াতে হবে। ব্যাঙ্ক-কলসেন্টার বাংলা বলে ফেললে হিন্দি-ইংরেজিতে শুধরে দিতে হবে। বাংলায় সই মা-কুরু। বাংলা তারিখ মনে রাখা দিদিমা-কুরু। নববর্ষকে হ্যাপি নিউ ইয়ার বলতেই হবে। ‘হ্যাপি’ শব্দটিকে জন্মদিন, ইদ, বিবাহবার্ষিকী, বিজয়া, ক্রিসমাস, ফ্ল্যাটপ্রবেশ মায় মহরম বা বাইশে শ্রাবণেও ব্যবহার করতে হবে। বেছে নিতে হবে আলুর চপের বদলে পাওভাজি। পিঠেপুলিকে ‘সাবস্ট্যান্ডার্ড’ ভাবতেই হবে। ‘মোমো’কে জীবন-যৌবনে অখিলভুবন করে তুলতে পারেন। জিলিপি শিঙাড়াকে অবশ্য বলবেন ‘জলেবি’ ‘সামোসা’।
এমনিতেই বাঙালি এখন আর প্রাতরাশ করে না, ব্রেকফাস্ট করে। দুপুরে খায়ও না, লাঞ্চ করে। ডিনার খেলেও রাতে খায় না মোটে। এই আল্ট্রা-ইভোলিউশনের এন্ডাবধি দেখে ছাড়তে হবে। ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’-ই হল ক্যাচলাইন। ‘বাংলা খুব কঠিন’ ভাবনাটিকেও চেতনাপ্রোথিত করতে হবে, যাতে নব্যবাঙালি ‘প্রাতরাশ’ লিখতে গিয়ে ঘেঁটে-ঘ হয়ে ‘প্রাতঃকৃত্য’ লেখে। সমাজমাধ্যমের সুচারু ব্যবহারও কাম্য। বাংলায় লেখারই দরকার নেই। একান্ত লিখতে হলে রোমান হরফে। এবং ‘হাই, উইকএন্ড প্ল্যান কী’ গোছের অনুপাত বজায় রেখেই। গোটাটাই অভ্যেস। রেস্তরাঁয় বাংলা না বলে-বলে এমনাবস্থা তৈরি করতে হবে, যেন বাংলায় বললে খাবারই না দেয়। ট্যাক্সি বা রিকশাচালকের সঙ্গে বাংলা বলা যাবে না। বিশ্বাস করতে হবে, তারা হিন্দিভাষী। বয়স্করা যেমন দোরের মাছবিক্রেতাকে বলতেন— ‘আজ কী কী মাছ হ্যায়?’ সেই লেজবিশিষ্ট হিন্দি কাঙ্ক্ষিত না-হলেও আজও কেউ বললে ওই ‘হ্যায়’টির জন্যই প্রশংসা মাস্ট।
ইষ্ট দেবদেবীও কিন্তু বদলাতে হবে। হনুমানে খুশি থাকলে চলবে না। হিন্দি-বলয় চুন-চুনকে দেবদেবী সার্চাতে হবে। যাতে নিরঞ্জনের চেয়ে, তাজিয়ার চেয়ে ঢের বেশি গণজোয়ার নামে গণেশচতুর্থীর জনসমুদ্রে। সবই বাংলায় মোদীয় বেদিনির্মাণের প্রস্তুতিপর্ব। রামমন্দির নিমিত্তমাত্র! আশু কর্তব্য এটা দেখা, যাতে বাঙালি নিজঘর ভেঙেচুরে ইট সাপ্লাইটা ঠিকঠাক পারে। মনটারে বাঁধতে হবে। কোনও অর্থের নবান্নেই থেমে থাকলে চলবে না! সংস্কৃতি এক ধরনের মিলনক্ষেত্রই। তবে, এ ক্ষেত্রে শুধু ‘নিবে’, ‘দিবে’ নয়।
মিলনক্ষেত্র বিয়েবাড়িতে লেখা ‘কৃষ্ণ ওয়েডস রাধা’। ভোজ ‘মেনু’ হয়ে ওঠার যাত্রামোড়ে পানিপুরির স্টল। সেটা অবশ্য অল্প-বড় ব্যাপার। পানের বদলে পানমশলা খানিক-বড় ব্যাপার। গূঢ়-বড় বিষয় পোশাক। ক্রিয়াকর্মে ধুতি পরতেই হয়। তবে, সাদা ধুতি চলবে না। লাল-মেরুন-নীল চলবে। তুঙ্গ-ভাল গেরুয়া হলেই। পাঞ্জাবিটাও এমন হতে হবে, যাতে তা গর্জমান ডিজে-র মানানসই হয়। কারণ, বিসমিল্লার সঙ্গে নাচা না গেলেও ডিজে-র তালে তো নাচাগানা হতেই পারে। আরও একটি জরুরি নীতি— হাতেগোনা উৎসব আর ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করার সময় ছাড়া ধুতি পরা যাবে না। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় ধোপাখানা থেকে ফিরিয়ে না এনে হাফপ্যান্টে দোকান-বাজারই শ্রেয়। কারণ, হাফপ্যান্টেই সঙ্ঘবদ্ধ দেশোদ্ধার সম্ভব।
সূক্ষ্ম রণকৌশল জরুরি। শ্রেণিশত্রু বাংলা বললে তাকে যেমন বাংলাদেশে থাকার নিদান শোনাতে হবে, তেমনই দরকারে বলতে হবে, মুসলমানরা বাঙালি নয়। প্রয়োজনে মনীষীর বিচ্যুতিরও সাহায্য নিতে হবে। ‘শ্রীকান্ত’ কোটাতে হবে— ‘ইস্কুলের মাঠে বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল ম্যাচ’। ‘এ-গাঁর ও-গাঁর দুধার হতে পথ দুখানি এসে/ জলীর বিলের জলে তারা পদ্ম ভাসায় হেসে’— এ সব দু’ধার, পথ দু’খানি— চলবে না। ধার একটাই। আন্ধার। পথ একটাই। রং একটাই, গেরুয়া। বাঙালিকে হিন্দি-হিন্দু করে তুলতে গেলে পদ্মকে জসিমউদ্দিনের আঁচল থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে। বাউলের গেরুয়া খুলে গৈরিক ‘পকাতা’ ওড়াতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ধনোনিবেশ করতে হবে। ‘ধামাকা মচা’তেই হবে।
অনুকরণ জরুরি হলেও অনুসরণ-আত্তীকরণ নয়। কোনও ভাষাই শেখার মতো শিখে ওঠা বিপজ্জনক। ‘জানি-জানি’ ভাবটুকু থাকলেই চলবে। কুকুরকে ডগি বলতে হবে, বরফকে আইস, পাউরুটিকে ব্রেড, টককে খাট্টা, লঙ্কাকে মির্চি, চিনিকে শুগার, আগ্রাসনকে অ্যাগ্রেশন, আন্দোলনকে মুভমেন্ট। নিজেকে খাটো করার তপস্যা জরুরি। শ্রেষ্ঠ বাঙালি রসিকতা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে ‘অ্যাই গরু, সর’ অপভাষাকে। আপনার নাম পাশের বাড়ির পল্টু না জানলেও গো-বলয়ের দিকের জাগতিক জানালাটা খুলে রাখতে হবে। কারণ, ওখানে গোষ্পদের নিখিল-বাতাস খেলা করে। শ্রেণিশত্রুরা বলবেই, সংস্কৃতি বাঁচে মাতৃভাষায়। মাতৃদুগ্ধটুগ্ধও বলবে। বলতে হবে— সংস্কৃতি টিকবে গ্রামে। তখন শ্রেণিশত্রুরা ফাটা রেকর্ডে গ্রামপতনের শব্দ শোনাবেই। ঘাবড়ে না গিয়ে কান ফেরাতে হবে কোকিলের দিকে।
কোকিল কে? বসন্তদূত। বসন্ত কী? অবাঙালিত্ব। সে গুটিরোগ সম্প্রকাশ হলে ছবিটাই আমূল মাখন হয়ে যাবে! কোনও লালমোহনবাবু আর বলবেন না— ‘হিন্দি কি কেউ সাধে বলে নাকি!’ আদালতে ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে বলা সেই অবিশ্বাস্য বাংলা ‘যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য-বই মিথ্যা বলিব না’ গোছের নির্ভেজাল মিথ্যেটাও বলতে হবে না উন্নততর বাঙালিকে। চিড়িয়াখানায় প্রাচীন বাঙালি দেখতে না পেয়ে হতাশ দর্শনার্থী জাদুঘরে ডাইনোসরের পাশে বাঙালি-কঙ্কালে তৃপ্ত হবেন।
গোখলে ফিরিয়ে নেবেন ‘হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে’ গোছের প্রাগৈতিহাসিক উক্তি। ‘কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’ গাওয়ার সাহস পাবেন না রবিবাউলও। এবং বঙ্গালি পড়ুয়া খসখসিয়ে লিখে ফেলবে একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক তাৎপর্য— ‘টেলিস্টার স্মিতা বনশলের হ্যাপি বার্থ-ডে’।