—ফাইল চিত্র।
গত তিন বছরে শুধুমাত্র কার্শিয়াং ডিভিশনেই গাড়ি চাপা পড়ে দশটি চিতাবাঘের মৃত্যু হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে চিতাবাঘ চা বাগানের ঝোপেই আশ্রয় নেয়, সন্তানের জন্ম দেয়। চা-গাছের ঝোপ তার কাছে অরণ্যের সম্প্রসারিত বাসস্থান মাত্র। চিতাবাঘ সংরক্ষণযোগ্য প্রাণী হিসাবে তালিকাভুক্ত, তবু কাগজ খুললেই তাকে নখ জিভ উপড়ে পিটিয়ে মারা, চা বাগানে বিষ দেওয়া, ফাঁদে ফেলে মেরে ফেলার খবর নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ইদানীং এক বাগান থেকে আর একটি চা বাগানে যাতায়াত করতে গিয়ে তারা নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। উল্টো দিকে ভ্রান্ত ধারণায় মানুষ ভাবছে, চিতা তার দখল ছাড়ছে না। বাগান সংলগ্ন অঞ্চল থেকে হাঁস মুরগি ছাগল তার কাছে সহজ শিকার। সেগুলি বাঁচাতে বা সংগ্রহ করতে যে মানুষের মুখোমুখি হচ্ছে, তার কাছ থেকে বাধা পেলে বা মুখোমুখি পড়ে গেলে আত্মরক্ষার্থে আক্রমণ করছে সে।
আর এক দিকে চলছে মানুষ ও হাতির নিত্য বিচিত্র সংঘাত। নিয়মিত ভাবে রেললাইনে গর্ভবতী হাতির মৃত্যুর খবর আসছে। এখানেও এমন ভাবে খবর তৈরি হচ্ছে যেন হাতিও পাল্টা লড়াই জারি রেখেছে! তারা মিড-ডে মিলের চাল খায়, পথ অবরোধ করে, আটার বস্তা কাঁধে নিয়ে রওনা দেয়, চা-বাগানের কুলিদের গাছে টাঙিয়ে রাখা টিফিনবাক্স নিয়ে চলে যায়। বোঝা কি এতই কঠিন যে, বন্য জন্তুর এলাকায় ঢুকে পড়া মানুষের সঙ্গ তাদের বিরক্ত করছে, উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে তাদের? অনভিপ্রেত সংঘর্ষে মানুষটি মারা গেলে খবর হচ্ছে ‘বাঘের বা হাতির হানা’। আসলে হানা তো দিচ্ছি আমরা মানুষেরা।
শুধু খাবার থাকলেই হয় না, হাতির প্রতি দিন স্রেফ ঘুরে বেড়ানো, খেলা, ঘর-সংসারের জন্য সারা বছর আনুমানিক ৩০০ থেকে ৫০০ বর্গ কিলোমিটার অরণ্য জরুরি। বনকে তারা নিজের এলাকা মনে করে ঘুরে বেড়ায়। নির্দিষ্ট কতকগুলি পথ দিয়ে হাতি তার বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করে। এগুলোরই নাম এলিফ্যান্ট করিডর।
বহু কাল হল, উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ এলিফ্যান্ট করিডর নষ্ট করে রেলগাড়ি যাতায়াত করছে। ১০০ শতাংশ করিডরের মুখ আগলে কোনও না কোনও চাষ-আবাদের কাজ চলছে। হাতি চলাচলের পথের পাশ দিয়ে চা-বাগান, মানুষের বসতি, রেললাইন, খনিজ সন্ধান, বোল্ডার সংগ্রহ এবং অধুনা মাখনমসৃণ জাতীয় সড়ক। সব মিলিয়ে উত্তরবঙ্গে হাতিদের স্বাভাবিক বাসস্থান-অরণ্য আজ বৃহৎ মাপের প্রাকৃতিক জেলখানায় পরিণত।
হাতি তার করিডরগুলোতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অভ্যস্ত, কিন্তু সেই সব পথে বাধা পেয়ে সে নতুন নতুন করিডর তৈরি করে নিয়েছে— তাতেও তার শান্তি নেই, সেখানেও তৈরি হচ্ছে নতুন সংঘাতের রাস্তা। এর মধ্যে পাশ হয়ে গেল বন সংরক্ষণ আইন ১৯৮০-র সংশোধনী বিল। আইনের ভিতরে গোল বেধেছে নতুন আইনের ধারাগুলির নির্দেশে। এখন থেকে বনের ভিতর সরকারি বা আধা-সরকারি ভাবে ইকো-টুরিজ়ম এবং সাফারি পার্ক, চিড়িয়াখানা করা যাবে। ফরেস্ট্রি ওয়ার্কসের মধ্যে বনের ভিতর জরিপ, অনুসন্ধান মান্যতা পাবে। আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা থেকে একশো কিলোমিটার পর্যন্ত বনকে সংরক্ষণের বাইরে রাখা হবে। আরও অনেক নতুন শিথিল নিয়মের মধ্যে পরিষ্কার করে বলা হয়নি এই অরণ্য ধ্বংসের সীমাবদ্ধতা কতটা।
স্বাভাবিক যুক্তিবোধ বা কাণ্ডজ্ঞানকে ব্যক্তিগত স্বার্থ বা দলের সিদ্ধান্তের কাছে বাঁধা রাখেন যাঁরা, তাঁদেরও পাল্টা যুক্তি আছে। কেউ কেউ বলেন, দেশের নিরাপত্তার জন্যে অতি বামপন্থী উপদ্রুত এলাকায় ৩৭.৫ বিঘা বনভূমিতে সামরিক ক্যাম্পের অনুমতি, বা প্রতিরক্ষার জন্যে ৭৫০ বিঘা বনভূমিতে পরিকাঠামো গড়ে তোলা কত গুরুত্বপূর্ণ। কেউ বলেন, পৃথিবীর সমস্ত দুর্মূল্য, মূল্যবান খনিজ শেষ হলেই বা ক্ষতি কী, চন্দ্রযানের এ-হেন দেশীয় সাফল্যের পর আমরা চাঁদ ও অন্যান্য গ্রহ থেকে সে সব তুলে নিয়ে আসব!
বন বিষয়টি এ দেশে কম গুরুত্বপূর্ণ বলেই পর্যটনের সঙ্গে অনেকেই একে গুলিয়ে ফেলেন। বিশেষ কিছু পরিবেশকর্মী বাদে সংখ্যাগুরু মানুষ এ বিষয়ে আলোচনাগুলোয় গুরুত্ব দেন না। কর্পোরেটের শুভাকাঙ্ক্ষীরা কেন এই আইন পরিবর্তন করছেন, তা অতি স্পষ্ট। জল-জঙ্গলের দখল তাঁদের যেন তেন প্রকারেণ দরকার।
কিন্তু আমরাই বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শৈশব থেকে সচেতনতার শিক্ষাটি দিতে পারছি কই? আমাদের চার পাশে বিদ্যা ও ব্যবহারের মধ্যে যে হেরফের নিয়ে দুঃখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আরও দুঃখের বিষয়, সেখান থেকে আমরা মোটেই এগোতে পারিনি আজও। প্রথাগত শিক্ষা ও পাঠ্যবইয়ের উপর ভর দিয়ে একটি মানবশিশু বাইরের জগতে পা রাখে। পাঠ্যবস্তু ও শিক্ষাপদ্ধতি নির্বাচন করে বোর্ড নামে আপাত-অদৃশ্য এক কমিটি, যাদের সদস্যরা কখনও কখনও সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দে, কখনও বিশেষ মতাদর্শে পাঠ্য বিষয় সঙ্কলিত করেন। নীতি বা পরিবেশ শিক্ষা কেমন হবে, সেটা নির্ভর করে এই বোর্ডের বিচারবুদ্ধির উপর। যে গোষ্ঠী বিশ্বাস করে অরণ্যের পাশে ইকো-সেনসিটিভ জ়োনের দূরত্ব কমলে অরণ্য-প্রাণের ক্ষতি নেই, অরণ্যের মধ্যে রিসর্ট নির্মাণ করলে অরণ্যের ক্ষতি নেই, তাঁদেরই তৈরি শিক্ষানীতিতে শিক্ষার্থী কী জানবে, শিখবে, সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। যুক্তিবোধের বদলে সে ক্রমে বিশ্বাসকে আশ্রয় করবে। বিদ্যাচর্চার উপকরণ, স্থান যতই যান্ত্রিক ও কারিগরি চমৎকারিত্বে ঝলমলায়, বইয়ের পৃষ্ঠায় যতই লেখা থাকুক গাছের প্রাণ আছে, তার কাছে গাছ ফুল পাতা জীবন্ত মনুষ্যপ্রাণের মতো গুরুত্ব পাবে না। অচেনা প্রাণী, চলন্ত প্রাণী, সে পিঁপড়ে হোক আর নির্বিষ সরীসৃপ, সকলকেই সে সম্ভাব্য আক্রমণকারী মনে করে মারতে উদ্যত হবে।
এই অচলায়তনের শিক্ষাব্যবস্থায় অপরিচয় এবং হাতে-কলমে না দেখার ফলে, মানুষ ভিন্ন অন্য প্রাণকে আদতে জীবিত বলে মনেই করা হয় না। যে কিশোর-কিশোরী তার সহপাঠীকে, ভাই-বোনকে যত্ন করে, রক্ষা করার চেষ্টা করে— সে-ই কিন্তু অপরিচিত ঢোঁড়া সাপ বিষয়ে অজ্ঞতায় সহজেই নৃশংস হত্যাকারী হয়ে ওঠে। বয়স বাড়লে অরণ্যভ্রমণে গিয়ে পথের দু’পাশে কাচের বোতল আর প্লাস্টিকের চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট ফেলে আসতে দ্বিধা করে না। কারণ অরণ্যের হস্তীটি তার কাছে ক্ষণিকের উপভোগের বস্তু, ভাগ্যক্রমে দেখে ফেলা চিতাবাঘটি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করার দুর্মূল্য শট মাত্র।
আজ আমাদের নথিভুক্ত বনভূমি শতকরা ২১.৬৭ ভাগ। প্রশ্ন উঠেছে, সুরক্ষা ও তথাকথিত উন্নয়নের জন্যে যে বনভূমি নেওয়া হবে, তার ক্ষতি পূরণের জন্যে যে বনভূমি তৈরি করতে হবে— তার জমি কোথায়? জঙ্গলের ভিতরের প্রকল্পগুলি কতখানি পরিবেশবান্ধব হবে? তার মাপকাঠিই বা কী? চিন্তা নেই, ধীরে ধীরে এ সব প্রশ্ন করারও লোক কমে আসছে। সত্যিই তো, যথার্থ শিক্ষা ছাড়া এক জন শিশুর কাছে গাছের আসল পরিচয় তো কাঠের মহার্ঘ আসবাবের উপকরণ মাত্র।