বাহুল্য: দার্জিলিঙে পাহাড়ের গায়ে যত্রতত্র মাথা তুলেছে বাড়ি ও হোটেল।
আশ্চর্য মিল দুই পাহাড়ে। হিমালয়ের ধসপ্রবণ এলাকায় বিপুল নির্মাণ। সুড়ঙ্গ কাটা হয়েছে, বোল্ডার ধসিয়ে তৈরি হয়েছে রাস্তা। যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে হোটেল এবং বাড়ি। সর্বোপরি, পাহাড়ি নদীর উপরে তৈরি হয়েছে একাধিক বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। না, সিকিম বা দার্জিলিং পাহাড়ের কথা নয়। জোশীমঠে ধস, বাড়িতে ফাটল, রাস্তা দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার পরে তার কার্যকারণ খুঁজে দেখতে গিয়ে উঠে এসেছে এই ছবি। গাড়োয়াল পাহাড়ে এই প্রলয়ঙ্কর কাণ্ডের তদন্তে প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে তৈরি হয়েছে কমিটি। প্রাথমিক ভাবে উপরের বিষয়গুলিই সামনে উঠে এসেছে।
এবং মিলটা এখানেই। এই একই ‘দোষে দুষ্ট’ সিকিম এবং উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চলও। বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই— দার্জিলিং, গ্যাংটকের মতো শহরে ঢোকার অনেক আগে থেকে সাধারণ পর্যটকেরও চোখে পড়ে অট্টালিকার সারি। চার-পাঁচ তলা বা তারকাখচিত বিপুল বৈভবের সব হোটেল এখানে একেবারেই দুষ্প্রাপ্য নয়। যেমন নয় তিস্তা ও তার শাখানদীগুলির উপরে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
একটি ছোট উদাহরণ দিলে ছবিটা স্পষ্ট হতে পারে। ভারতে (সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ভাগ মিলিয়ে) প্রায় ৩০৫ কিলোমিটার পথ পার হয়েছে তিস্তা। সেই পথে বহু বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে উঠেছে। তার জন্য নির্বিচারে কাটা হয়েছে পাহাড়-জঙ্গল। বদল করা হয়েছে নদীর গতিপথও। এই কাজ শুধু যে সিকিমে হয়েছে, তা-ই নয়, পশ্চিমবঙ্গেও কালীঝোরা এবং রিয়াঙে বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের সুপারিশ অনুযায়ী, এমন আরও বেশ কিছু প্রকল্পের সুযোগ এখনও রয়েছে। রাজনীতিকরা বলবেন, তা হলে কি বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট হবে না? নদীর উপরে সেতু থাকবে না? সিকিম বা কালিম্পঙের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ কি বিদ্যুৎহীন গ্রামেই থাকবেন? পিচ রাস্তার বদলে মাটি বা খোয়া পথে যাতায়াত করবেন? এমন চলতে থাকলে তো চিকিৎসার জন্য সমতলের হাসপাতালে নেমে আসতে হবে। হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, দোকানবাজার— এ সব কিছুই কি তা হলে থাকবে না?
উন্নয়নের যুক্তি বড় নির্মম। ঠিক কংক্রিট স্তম্ভের মতো। এমনই স্তম্ভ গেঁথে এর আগে সেতু হত। এর পরে হচ্ছে বাঁধ আর বিদ্যুৎ প্রকল্প। হচ্ছে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, হোটেলের বিশাল অট্টালিকাও। দার্জিলিং ঢোকার মুখে যে মনাস্ট্রি-টি আছে, দূর থেকে চোখে পড়ার মতো, তার চেহারাই বা কম কিসে!
এখন দেশের প্রতিরক্ষার স্বার্থে তৈরি হচ্ছে রেলপথ। সেবক থেকে রংপো। সেবক স্টেশন দিয়ে যাঁরা ডুয়ার্সে গিয়েছেন ট্রেনে চেপে, তাঁরা জানেন, কী অপূর্ব সে যাত্রাপথ। এখন এই পথে চালানো হচ্ছে ভিস্তাডোম কোচ, যেখানে বড় বড় কাচের জানলা দিয়ে জঙ্গলের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে যান পর্যটকরা। এই পথে হাতি কাটা পড়ার ঘটনা একেবারেই বিরল নয়। সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। তার আগে সেবক থেকে পাহাড়ের চড়াই ধরে নতুন যে রেলপথটি তৈরি হচ্ছে, সে দিকে নজর দেওয়া যায়। সিকিমের রংপো পর্যন্ত এই পথের অনেকটা অংশেই রেললাইন যাবে সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে। সে সুড়ঙ্গ করতে গিয়ে এর মধ্যেই বহু জায়গায় মাটির ধস নেমেছে। প্রাণ গিয়েছে বেশ কয়েক জন কর্মীর।
এ ক্ষেত্রে যুক্তি, রেল যোগাযোগ তৈরি হলে সিকিমের অনেক এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ সহজতর হবে। বিশেষ করে চিনের সঙ্গে পাহাড়ি সীমান্তগুলিতে সহজে পৌঁছনো যাবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের যে মন্ত্রকগুলি এই সব ক্ষেত্রে ছাড়পত্র দেয়, রাজ্য সরকারের যে দফতর থেকে পাহাড়ি শহরগুলিতে চার-পাঁচ তলা বাড়ি তৈরির আবেদনে সিলমোহর পড়ে, তারা সকলেই জানে: হিমালয়ের এই অঞ্চলটি সিসমিক-৪ জ়োন বলে চিহ্নিত। অর্থাৎ, ভূমিকম্পপ্রবণ এবং অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ২০১১ সালে যে ভূমিকম্প গোটা এলাকাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, রিখটার স্কেলে সেটি ছিল ৬.৯। সিকিমের মঙ্গনে সেই ভূকম্পের পরে কয়েক দিন বাইরের লোক ঢুকতে পারেনি, এমনই অবস্থা হয়েছিল পথের। সেনাবাহিনী প্রথম পৌঁছয়। তার পরেও ৫ রিখটারের উপরে ভূমিকম্প আরও একাধিক বার হয়েছে।
এত কিছুর পরেও তিস্তা দিয়ে বয়ে গিয়েছে সময়, আর তৈরি হয়েছে বাঁধ। শেষতমটি গজলডোবায়। বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের ধারে। যে ব্যারাজের দরজা খুললে জল চলে যাবে বাংলাদেশে। এই ব্যারাজ ঘিরে এখন পর্যটনের বিরাট কর্মযজ্ঞ। মাথায় রাখা দরকার, এই এলাকাটি পুরোপুরি ছিল হাতি করিডর। এখনও তিস্তা ক্যানাল পার করে হাতিরা উল্টো দিকের বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের পথ ধরে। এই পথে এত বাধা মাথা তুলে দাঁড়াবে কেন?
কেন্দ্রের মতো রাজ্য সরকারেরও যুক্তি আছে। মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন গজলডোবা গড়ে উঠুক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে। তাই এত রাজসূয় যজ্ঞ। এই বৈকুণ্ঠপুরের কোনও এক জঙ্গল-পথেই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময়ে হাতির হানায় প্রাণ গিয়েছে অর্জুন দাসের। কেন? কারণ, যে ‘পথ’ দিয়ে অর্জুনরা যাচ্ছিল, সেটি আসলে হাতিদের চলাচলের স্বাভাবিক পথ। সেটা ভুলে গিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। বা অনেক ক্ষেত্রে বিপদের আশঙ্কা মাথায় রেখেই যাতায়াত করেন তাঁরা।
এই অভ্যাস, তা সে প্রয়োজনেই হোক বা অন্য কোনও কারণে, বিপদ ডেকে আনছে সকলের। মানুষের তো বটেই, হাতিরও। এই যে ট্রেন লাইন গিয়েছে ডুয়ার্স ভেদ করে, সেখানে ফি-বছর বহু হাতি মারা পড়ে। তারা মারা পড়ে মানুষের তৈরি অন্য ফাঁদেও। শুধু ২০২১ সালে কার্শিয়াং, দার্জিলিং এবং বৈকণ্ঠপুর বিভাগ মিলিয়ে হাতির হানায় প্রাণ গিয়েছে ১৫ জনের। পক্ষান্তরে, ওই বছর বৈকণ্ঠপুর জঙ্গল-লাগোয়া এলাকায় চারটি হাতি মারা গিয়েছে, যার মধ্যে তিনটির মৃত্যুর কারণ বৈদ্যুতিক শক। এই সংঘাত শুধু হাতির ক্ষেত্রেই নয়, চিতাবাঘ, বাইসন, এমনকি সম্প্রতি ভালুকের সঙ্গেও হয়েছে। হতাহত দু’দিকেই হয়েছে। তার মধ্যেই ডুয়ার্সে জঙ্গল কেটে তৈরি হয়েছে রেলের ফ্লাইওভার।
সম্প্রতি বিজেপি বিধায়করা উত্তরবঙ্গে এই অঞ্চলে প্রকৃতি বাঁচাতে আন্দোলনে নামার কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তাঁরা প্রশ্ন তুলবেন তিস্তার উপরে বাঁধ, বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে? প্রশ্ন তুলবেন কি সেবক-রংপো রেল যোগাযোগ নিয়ে? একই ভাবে পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া তৃণমূল নেতারাই বা কেন গজলডোবার প্রকল্পটি নিয়ে চুপ করেছিলেন? বক্সার জঙ্গলে আদালতের নির্দেশে সরকারি থাকার জায়গাগুলি সাধারণের জন্য বন্ধ। কিন্তু হোমস্টে-র নামে স্থানীয়দের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থার জোটবন্ধন কি আদৌ পরিবেশের স্বস্তিদায়ক? পাহাড়ে যে অট্টালিকার পরে অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে, তা কি ভারসাম্যে আঘাত করছে না? জোশীমঠের ঘটনার পরে এই নিয়ে কি রাজ্যের শাসক দলের কেউ যথাযথ ভাবে প্রশ্ন তুলেছেন?
দার্জিলিঙের তাকদার কাছেই থাকেন গাড়িচালক পবন। পাহাড়ে যাতায়াতের সূত্রে তাঁর সঙ্গে আলাপ। কথায় কথায় এই প্রশ্নগুলিও উঠেছিল। তিনি বললেন, “সিকিম বা কালিম্পং যাওয়ার পথে তিস্তাবাজারের আগে পাহাড়ি রাস্তা থেকে অনেক নীচে তিস্তা দেখতে পান। গত বছর বর্ষায় সেই জল রাস্তায় উঠে এসেছিল। এর জন্য দায়ী কে?” তাঁকে সমর্থন করেই তিস্তাবাজারের এক দোকানি বলেছিলেন, “সব হোক। কিন্তু দেখবেন, তার ভারে যেন আমরা ভেসে না যাই!”
স্থানীয়রা কেউ কেউ বোঝেন। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে টক্করে পরিবেশ নিয়ে সতর্কতা যেন বহু আগেই তিস্তার জলে ভেসে গিয়েছে।