—প্রতীকী ছবি।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ইংরেজির অধ্যাপক স্টেফানি বার্ট এই জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া সিমেস্টারে একটা নতুন বিষয় পড়াচ্ছেন, ‘টেলর সুইফট অ্যান্ড হার ওয়ার্ল্ড’। ডজনখানেক কলেজে ইতিমধ্যেই ‘কোর্স’ পড়ানো হচ্ছে এই গীতিকার-গায়িকাকে নিয়ে; হার্ভার্ড নিঃসন্দেহে সেগুলোর মধ্যে অভিজাততম। এ সব হয়েছে তিনি টাইম ম্যাগাজ়িন-এর ২০২৩ সালের ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হওয়ার আগেই।
ব্রিটিশ লেখক চাস নিউকি-বার্ডেন ২০১৪ সালে টেলরকে নিয়ে বই লিখেছিলেন: টেলর সুইফট: দ্য হোল স্টোরি— এক ছোট শহরের অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন মেয়ের একরাশ স্বপ্নকে সঙ্গী করে গোটা আমেরিকার ‘সুইটহার্ট’ হয়ে ওঠার গল্প। কিন্তু হায়! তখনই কি আর ‘হোল স্টোরি’ লিখে দেওয়া যায়? সেই বই প্রকাশের পর কেটে গিয়েছে এক দশক। এই সময়কালে টেলর সুইফট হয়ে উঠলেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বিনোদনকারী। ৯৬ বছর ধরে টাইম ম্যাগাজ়িন বছরের সেরা ব্যক্তিত্বকে বেছে নিচ্ছে— সেই প্রায় এক শতকের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও তারকা এই স্বীকৃতি পেলেন একক ভাবে। ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ তাঁর ৩৪তম জন্মদিনের দিনকয়েক আগেই।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির যে ‘কোর্স’, তাতে পড়ানো হবে এক সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক যাত্রাপথের ইতিবৃত্ত। ডলি প্যাটনের মতো পূর্বসূরি থেকে শুরু করে টেলরকে নিয়ে ২০২০ সালের তথ্যচিত্র মিস আমেরিকানা— সুইফটেরই ২০১৯-এর গান ‘মিস আমেরিকানা অ্যান্ড দ্য হার্টব্রেক প্রিন্স’ থেকে ধার করা নাম। থাকবে এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘ফ্যান’ সংস্কৃতি, ‘সেলেব্রিটি’ সংস্কৃতি, কৈশোর, প্রাপ্তবয়স্কতা এবং উপযোগ নিয়ে পর্যালোচনা।
ঠিক কেমন টেলর সুইফটের স্বপ্নিল জগৎখানা? তিনি দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় গীতিকার-গায়ক, দুনিয়া জুড়ে ইতিমধ্যেই বিক্রি হয়েছে তাঁর ২০ কোটি রেকর্ড, স্পটিফাই-এর সবচেয়ে বেশি ‘স্ট্রিমড’ শিল্পী তিনি। তাঁর ‘এরাজ় টুর’ নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে দুনিয়ার জনপ্রিয়তম কনসার্ট মুভি, আয় হয় ২৫ কোটি ডলার। আর এ সবের মধ্য দিয়েই টেলর হয়ে ওঠেন বিলিয়নেয়ার। তাঁর পোশাক, ফ্যাশন, সবই অগণিত জনতার অনুকরণের বিষয়বস্তু। বিখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে বিখ্যাত খেলোয়াড়ের সম্পর্ক থাকলে জনগণের মাতামাতি হবেই। তবে কোনও শিল্পীর সঙ্গে ক্রিকেটারের সম্পর্কের কারণে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, এমন কথা বলতে শুনিনি কাউকে। ভিক্টোরিয়া কিংবা শাকিরা হয়তো বেকহ্যাম বা পিকে-কে নিয়ে উন্মাদনা বাড়াতে সাহায্য করে থাকবেন, তবু ফুটবল খেলাটা তার অনেক ঊর্ধ্বে। কিন্তু টেলর সুইফট কানসাস সিটির প্রধান এবং দু’বারের সুপার বোল চ্যাম্পিয়ন আমেরিকার ন্যাশনাল ফুটবল লিগের তারকা ট্রাভিস কেলস-এর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর পরে ও দেশের জনপ্রিয় খেলাটারও জনপ্রিয়তা নাকি বেড়েছে আরও। অক্টোবরে একটা খেলায় স্টেডিয়ামে হাজির ছিলেন সুইফট, টিভিতে তার দর্শক-সংখ্যা আকাশ ছুঁয়েছিল।
আবার কখনও টেলর ‘হিরো’ থেকে হয়ে যান ‘অ্যান্টি-হিরো’ও, তাঁর গানের মতোই। সেখানে সুইফটের যুদ্ধ যেন তাঁর নিজের সঙ্গেই। আছে ভয়, আছে নিরাপত্তাহীনতা, এবং অবিশ্বাস। এই ‘অ্যান্টি-হিরো’র ভাবমূর্তি যেন সুইফটকে টেনে আনে মাটির কাছাকাছি। যেন হাত বাড়িয়েই ছোঁয়া যায় তাঁকে। টেলর সুইফট তাই বহুবর্ণের এক বিরল মিশ্রণ। এক দিকে তিনি এলভিস প্রেসলি, মাইকেল জ্যাকসন বা ম্যাডোনার পর্যায়ের পপ তারকা। সেই সঙ্গে তিনি বব ডিলান, পল ম্যাকার্টনি বা জনি মিচেলের মতো সঙ্গীতকার। তিনি সফল ব্যবসায়ী, ইতিমধ্যেই যাঁর বহু বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য।
২০২৩ তাঁর সঙ্গীত-জীবনের শ্রেষ্ঠ ‘যুগ’। তাঁর সাফল্যেরও। দীর্ঘ ১৭ বছরের সঙ্গীত-জীবনকে সম্পাদনা করে, বিভিন্ন ‘এরা’ বা যুগের কোলাজ বানিয়ে, শুরু হল তাঁর ‘এরাজ় টুর’। আমেরিকায়, এবং দুনিয়া জুড়ে। কিন্তু ইতিমধ্যেই তিনি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ তারকা, জনপ্রিয়তা অকল্পনীয়। আগের সব তারকার সমস্ত টুরের সাফল্যের ইতিহাস খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিয়ে তৈরি করলেন নতুন রূপকথা। দুনিয়ার যেখানেই ‘শো’ করতে গিয়েছেন টেলর, প্রবল উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিয়েছে ‘সুইফটি’রা। হ্যাঁ, এ নামেই পরিচিত টেলর সুইফটের অগণন ভক্ত। তাঁর ‘শো’-এর সাত দিন আগেই তাঁবু খাটিয়ে উপস্থিত অগণিত ‘সুইফটি’। এমনকি গত জুলাইয়ে সিয়াটলে তাঁর কনসার্টের সময় ১,৪৪,০০০ ‘সুইফটি’র উল্লসিত পায়ের তালে তৈরি হল ২.৩ মাত্রার ভূমিকম্প— ছাপিয়ে গেল খেলার দুনিয়ার ২০১১-র এক রূপকথাকে, যখন ফুটবল টিম ‘সিয়াটল সিহক্স’-এর সমর্থকরা সৃষ্টি করেছিল ২.০ মাত্রার ভূমিকম্প!
টেলর সুইফট। —ফাইল চিত্র।
বার্বি-র গ্রেটা গারউইগ টেলর সুইফটকে দেখেছেন রক গায়ক ব্রুস স্প্রিংস্টিন, গীতিকার এবং লোকগীতি-শিল্পী লোরেটা লিন, আর বব ডিলানের সংমিশ্রণ হিসাবে। কিন্তু টেলরের প্রভাব তাঁর অনন্য সঙ্গীতের চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ নয়— কেবলমাত্র বিনোদনকারীই নন, তিনি হয়ে উঠলেন অর্থনীতির এক সূচকও। এখানে টেলর অনন্য। যেখানেই তিনি গিয়েছেন, ফুলে-ফেঁপে উঠেছে স্থানীয় অর্থনীতি। শুধু কি টিকিট বিক্রির টাকা, দূরদূরান্ত থেকে আসা ‘সুইফটি’-দের যাতায়াত, হোটেল-রেস্তরাঁর খরচ, কেনাকাটা, সব মিলিয়ে এক মিনি-রাজসূয় যজ্ঞ। ‘এরাজ় টুর’কে উপলক্ষ করে কেবলমাত্র আমেরিকাতেই উপভোক্তারা খরচ করবেন আনুমানিক প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। পৃথিবীর অন্যত্রও ছবিটা একই। এমনকি যেখানে তিনি যাননি, সেখানেও। তাঁর অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় নিউ জ়িল্যান্ড থেকে আসা ‘সুইফটি’দের জন্য অন্তত ১৪টি অতিরিক্ত বিমানের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল বিমানসংস্থাকে। সব মিলিয়ে হইহই কাণ্ড। কানাডার প্রধানমন্ত্রী, চিলির প্রেসিডেন্ট, তাইল্যান্ড, হাঙ্গারির গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকরা তাঁকে অনুরোধ জানান তাঁদের দেশে ‘শো’ করতে। বিভিন্ন শহর, স্টেডিয়াম, রাস্তার নামকরণ হয় তাঁর নামে। মিনিয়াপোলিসের নাম দেওয়া হয় ‘সুইফটি-আপোলিস’, তিনি সাম্মানিক মেয়র হন ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা ক্লারা শহরের। নিউ জার্সিতে স্যান্ডউইচের নামকরণও হল সুইফটের নামে।
অতিমারি-উত্তর বিষণ্ণ অর্থনীতিতে টেলর যেন এক সঞ্জীবনী মন্ত্র। টেলর সুইফট নিজেই যদি একটা অর্থব্যবস্থা হতেন, তা হলে তা আয়তনে অন্তত ৫০টি দেশের চেয়ে বড় হত! গড়পড়তা হিসাবে সরাসরি পরিবেশন-যোগ্য বিনোদনের টিকিটে ১০০ টাকা খরচ হলে, পর্যটন এবং বিবিধ পণ্যের অনুসারী অর্থনীতিতে খরচ হয় ৩০০ টাকা, এটাই দস্তুর। বিশ্ব জুড়েই। ‘সুইফটি’রা এ বাঁধও ভেঙেছেন। ‘এরাজ় টুর’-এ টিকিট প্রতি ১০০ টাকা খরচের সঙ্গে গড়ে ১৩০০-১৫০০ টাকা খরচ করছেন তাঁরা। স্থানীয় অর্থনীতি তার সুফল পেয়েছে। সর্বত্রই। ২০২২-এর অ্যালবাম মিডনাইটস-এর জনপ্রিয় গান ‘ইউ আর অন ইয়োর ওন, কিড’-এ রয়েছে ‘ফ্রেন্ডশিপ ব্রেসলেটস’-এর উল্লেখ। সুইফটের কনসার্টে তাই ‘সুইফটি’রা হাজির হন ব্রেসলেট পরে, বিনিময় করেন ব্রেসলেট। একটা গানের কলি কারুশিল্পের দোকানের বিক্রি বাড়িয়ে দেয় পাঁচ গুণ।
আমেরিকার ফেডারাল রিজ়ার্ভ পর্যন্ত অর্থনীতিতে টেলর সুইফটের প্রভাবের উল্লেখ করেছে তাদের রিপোর্টে। ভাবা যায়! কোভিডের ফলে সঞ্চয় বেড়েছে এক শ্রেণির, সঙ্গে রয়েছে অবদমিত খরচের আকাঙ্ক্ষা। অতিরিক্ত খরচ শুরু হয় বিনোদনে। ‘ফান’ আর ‘ইনফ্লেশন’ শব্দ দু’টির হাঁসজারু বানিয়ে ব্যাঙ্ক অব আমেরিকা যাকে বলেছে ‘ফানফ্লেশন’। অতিমারি-উত্তর এক ব্যতিক্রমী সময়কালে টেলর সুইফট, বিয়ন্সে কিংবা বার্বি, ওপেনহাইমার-এর হাত ধরে এর সূত্রপাত, যার স্থায়িত্বর মেয়াদ দীর্ঘ হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সভ্যতার ইতিহাসের এক অনন্য সময়কাল নিঃসন্দেহে সাহায্য করেছে টেলর সুইফটকে, ‘ফানফ্লেশন’ ধারার পুরোধা হতে। আবার এটাও ঠিক, টেলর সুইফট নিজে এই ‘ফানফ্লেশন’-এর অন্যতম স্রষ্টা।
আমেরিকার পরিপ্রেক্ষিতে টেলর সুইফটের গুরুত্ব আরও গভীর। তিনি ছুঁয়েছেন প্রায় অধরা এক সীমান্ত, যা বিশ্বাসহীনতার এই সঙ্কটকালে অন্য কোনও শিল্পীর পক্ষে ভাবাও হয়তো কঠিন। মতাদর্শ নিয়ে সুস্পষ্ট ভাবে বিভক্ত আজকের আমেরিকায় তিক্ত রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে টেলর সুইফটই বোধ হয় একমাত্র পারেন বিভাজনের সীমানা অতিক্রম করতে, অক্লেশে। মেলাবেন, তিনি মেলাবেন এই সমাজকে, তাঁর গানের ও পারে।
‘বিটলস্ম্যানিয়া’ কিংবা ‘মুনওয়াকার’ মাইকেল জ্যাকসনের ‘থ্রিলার’কে কিন্তু বহু মাইল পিছনে ফেলেছেন টেলর সুইফট। তিনি যেন এক ভিন গ্রহের শিল্পী, কোনও এক অপার দাক্ষিণ্যে বিনোদনের আবেশ সঞ্চার করতে সৌরমণ্ডলের তৃতীয় গ্রহকেই বেছেছেন প্ল্যাটফর্ম হিসাবে। আর পরিশেষে গ্ল্যাডিয়েটর ছবির রাসেল ক্রো-র মতোই তিনি শুধোচ্ছেন, তাঁর বিনোদনে আমরা বিমোহিত হয়েছি কি না।