Labour Wages

এগিয়ে অনুদান, পিছিয়ে মজুরি

রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রকাশিত তথ্যে (২০১৯-২০) দেখাচ্ছে, সারা ভারতে গড় মজুরি পুরুষদের জন্য দৈনিক ৩৪৮ টাকা, পশ্চিমবঙ্গে মজুরি ৩০৫ টাকা।

Advertisement

নব দত্ত

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:২৬
Share:

শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার ভিত্তি হল তাঁদের মজুরি। ফাইল ছবি।

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বাজেটে লক্ষ করা গেল, অনুদানের পরিসর বেড়েছে। যেমন, কৃষকবন্ধুর অনুদান পাচ্ছেন আরও বেশি চাষি। লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের প্রাপকরা ষাট বছর বয়স হলে মাসে হাজার টাকার বার্ধক্য ভাতা পাবেন বলে ঘোষণা হয়েছে। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজসাথী— সবই বহাল রয়েছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকার স্বাস্থ্যসাথীতেও বরাদ্দ বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছে।

Advertisement

কিন্তু, ‘এগিয়ে বাংলা’ দাবি কি কেবল অনুদান বাড়িয়েই পূরণ হবে? শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার ভিত্তি হল তাঁদের মজুরি। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রকাশিত তথ্যে (২০১৯-২০) দেখাচ্ছে, সারা ভারতে গড় মজুরি পুরুষদের জন্য দৈনিক ৩৪৮ টাকা, পশ্চিমবঙ্গে মজুরি ৩০৫ টাকা। এই নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের শেষ বারোটি রাজ্যের মধ্যে। কেরলে গড় দৈনিক মজুরি ৭০১ টাকা, যা পশ্চিমবঙ্গের দ্বিগুণেরও বেশি। এ রাজ্যে মেয়েরা পান দৈনিক ২৫৬ টাকা, সারা দেশে গড় ২৭৮ টাকা।

মজুরিতে পশ্চিমবঙ্গের এই পশ্চাৎপদতা বিরোধীদের আক্রমণের বিষয় হয়ে ওঠেনি, সম্ভবত এই জন্য যে, কেন্দ্রীয় সরকারও মজুরির এক অস্বাভাবিক কম হার নির্ধারণ করেছে— সাম্প্রতিকতম ‘ফ্লোর লেভেল ওয়েজ’ অর্থাৎ ন্যূনতম মজুরি ঠিক করেছে দৈনিক ১৭৮ টাকা। অথচ, ন্যূনতম মজুরি মানে নিছক অনাহারে থাকার অবস্থার একটু উপরে থাকার মতো মজুরি নয়। তা হল, শ্রমিকের কর্মক্ষমতা বজায় রাখার জন্য যে রসদ প্রয়োজন, তা জোগানোর মতো আয়। তার মধ্যে রয়েছে চিকিৎসা, শিক্ষা, আমোদ-প্রমোদ সবই। মূল্যস্ফীতির এই বাজারে কী করে এই সামান্য টাকা ন্যূনতম মজুরি বলে নির্দিষ্ট করা যেতে পারে, সে প্রশ্নটা রাজনৈতিক, কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দল সে প্রশ্ন তুলবে, এমন ভরসা হয় না।

Advertisement

কম মজুরি সর্বাধিক ক্ষতি করছে মেয়েদের। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ই-শ্রম পোর্টালে রেজিস্ট্রেশন (২০ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত) হয়েছে ২ কোটি ৫৭ লাখ শ্রমিকের। এর মধ্যে নারী-কর্মী ১ কোটি ৪০ লক্ষ (৫৪ শতাংশ)। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কৃষি, নির্মাণ, গৃহকর্মী, পোশাক, তামাক শিল্প, বিক্রয়-কর্মী, শিক্ষা, পরিবহণ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, চামড়া শিল্প, খনি-কর্মী, এমন নানা পেশার শ্রমিক। পেশাসূত্রে প্রাপ্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাস্তবিক তাঁরা কতটা পাচ্ছেন এবং সেগুলির পরিধি বাড়াতে সরকার কী ভাবছে, সে বিষয়ে বাজেট বক্তৃতায় কিছু নেই বটেই, কোনও সাম্প্রতিক সরকারি ঘোষণা বা রাজনৈতিক বিবৃতিতেও কিছু পাওয়া যায় না। বরং বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে— মজুরিতে ঘাটতির জন্য (দৈনিক ২৩২ টাকা) চা বাগানে শ্রমিক অনুপস্থিতির হার ৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে। গত তিন বছরে আঠারো বার ত্রিপাক্ষিক মিটিং-এর পর দৈনিক মজুরি ত্রিশ টাকা বাড়ল। তার পরে ডুয়ার্সের বাগানে না গিয়ে পুরুষেরা ভুটানের কারখানায় দৈনিক পাঁচশো টাকা মজুরিতে কাজে যাচ্ছেন। সস্তার শ্রম দিয়ে সেই ফাঁক পূরণ করছেন মেয়েরা।

রাজ্যের চটকলগুলিতে এখন মেয়ে শ্রমিকদের কদর খুব বেড়েছে কর্তৃপক্ষের কাছে। শুনতে হচ্ছে, মেয়েদের নাকি ‘ডিসিপ্লিন’ বেশি, তাঁরা দক্ষ, কামাই করেন কম, উৎপাদন দেন বেশি, ইত্যাদি। যদিও সত্তর-আশির দশকে বলা হত উল্টোটাই— মেয়েরা উৎপাদন কম করেন, এই অজুহাতে হাজার হাজার নারী-শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। আজ তাঁদের কদর বেড়েছে, কারণ সস্তায় তাঁদের দক্ষ শ্রম কেনা যাচ্ছে। বাংলার চটকলগুলিতে হাজার হাজার ‘ট্রেনি’ মেয়ে শ্রমিক কাজ করছেন, যাঁরা দিনে ২২০ টাকা (বা তার সামান্য বেশি) পান। রাতের শিফটে নারী-শ্রমিকদের কাজ আইনসম্মত করার চেষ্টা চলছে। যদিও এখনই অনেক চটকলে রাতের শিফটে নারী শ্রমিক কাজ করছেন কোনও রকম সুরক্ষা ছাড়াই।

ভারতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য জরুরি পরিষেবা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করেন বিপুল সংখ্যক নারী-কর্মী। এ রাজ্যে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ১ লক্ষ ৭০ হাজার, সহায়িকা এক লক্ষের কিছু বেশি, আশাকর্মী ৫৫ হাজার, মিড-ডে মিলে কর্মরত প্রায় ২ লক্ষ ৩২ হাজার। এঁরাই ট্রেড ইউনিয়নগুলির মিছিল-মিটিং’এ সবচেয়ে বেশি ভিড় বাড়ান। কিন্তু সরকার-নির্ধারিত শ্রমিক অধিকার প্রায় কিছুই পান না। এই ধরনের কর্মজীবী কোটি কোটি নারী পুরুষ সুষ্ঠু ভাবে রোজগারের সুযোগ পেলে নিজের আয়ের সংস্থান থেকেই নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে পারতেন। সরকারের তরফে দরকার ছিল সঠিক মজুরি ঘোষণা ও তা পাওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আপদে-বিপদে সামাজিক সুরক্ষা ছাড়া, এই শ্রমিকদের তা হলে সরকারকে প্রয়োজন হত না।

শ্রমার্জিত মজুরি যদি সঙ্কুচিত হয়, অনুদান সেই ফাঁক পূরণ করতে পারে না। অনুদান পাওয়ার আশা হয়তো সরকারকে সমর্থন পেতে সাহায্য করে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা রাজ্যের শ্রমনির্ভর অর্থনীতিকে পঙ্গু করে তুলছে। আজ হয়তো নারীর শ্রমের অবমূল্যায়ন দিয়ে উৎপাদন চালানো যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে সস্তায় শ্রম কেনার আশায় বসে থেকে বহু সংস্থা বন্ধ হয়ে যাবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement