Society

বন্ধুতা, চেনা খোপের বাইরে

প্রতি দিন আনন্দে কাটে তাদের, এক সঙ্গে খাওয়া-ঘুম-পড়া থেকে খোলা আকাশের তলায় খেলে বেড়ানো।

Advertisement

শিলাদিত্য সেন

শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:৫৯
Share:

—ফাইল চিত্র।

সহপাঠী মেয়েদের প্রশ্নে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে ছেলে দু’টি। লিয়ো আর রেমি, বয়স তেরো দু’জনেরই। স্কুলের এক সহপাঠিনী তাদের জিজ্ঞেস করে: “আর ইউ টুগেদার?” অনাবিল রোদে যেন মেঘ ঘনিয়ে আসে আচমকা। ছেলে দু’টি পরস্পরকে ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ মানে, দুই পরিবারের মধ্যেও সম্পর্ক বেশ ঘন। প্রতি দিন আনন্দে কাটে তাদের, এক সঙ্গে খাওয়া-ঘুম-পড়া থেকে খোলা আকাশের তলায় খেলে বেড়ানো।

Advertisement

আর এক সহপাঠিনী আবার জিজ্ঞেস করে: “আর ইউ কাপল?” থতমত লিয়ো বলে: “উই আর বেস্ট ফ্রেন্ডস।” শুনে মেয়েরা ক্ষান্ত হয় না, মুখ টিপে হেসে ফের প্রশ্ন করে: বন্ধুত্ব নাহয় বুঝলাম, কিন্তু তোমরা এমন গায়ে-গায়ে লেপ্টে থাক কেন, তোমাদের মেলামেশার ধরনটা এমন ‘মেয়েলি’ কেন? রেমিকে নিরুত্তর দেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করে লিয়ো, বোঝাতে চায়, তাদের সম্পর্কটা মোটেও তেমন নয়, সে আর রেমি একে অপরের ভাইয়ের মতো।

কোনও সম্পর্ককেই এ ভাবে তকমা দিতে নারাজ লুকাস ঢন্ট, বেলজিয়াম ফ্রান্স নেদারল্যান্ডস-এর যৌথ প্রযোজনায় তৈরি ক্লোজ় ছবির পরিচালক। ফেলে-আসা ছেলেবেলার ‘বন্ধুত্ব’ তাঁর এই ছবিটির আত্মা, অথচ সেই বন্ধুত্বকেই কোনও-না-কোনও খোপে আঁটানোর, ছাঁচে ফেলার চেষ্টা চলে অবিরাম। বন্ধুত্বের মধ্যে যে অনির্ণেয় অনুভূতি বা অব্যাখ্যাত সম্পর্ক, তা বাঁধাধরা ধাঁচে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে পুরুষসমাজ, সে ক্ষেত্রে তার অবশ্যম্ভাবী মাপকাঠিটি হয়ে ওঠে লিঙ্গাত্মক। সব সম্পর্ককেই ওই একই মাপকাঠিতে বিচার করতে শেখায় আমাদের সমাজ, নারীপুরুষ নির্বিশেষে। লুকাসের মতে: ‘থ্রু দ্য লেন্স অব সেক্সুয়ালিটি’।

Advertisement

লুকাসের জন্ম বেলজিয়ামে, বয়স মাত্র বত্রিশ। নিজস্বতার প্রমাণ দিয়েছেন প্রথম কাহিনিচিত্রেই, বছর পাঁচেক আগের সে-ছবি, গার্ল, সম্মান আদায় করে নিয়েছিল কান চলচ্চিত্রোৎসব থেকে, একটি রূপান্তরকামী মেয়ের ব্যালে-নৃত্যের শিল্পী হয়ে ওঠার ছবি। আর কান-এ গত বছর ‘গ্রাঁ প্রি’ পাওয়া তাঁর এই দ্বিতীয় কাহিনিচিত্র দেখা গেল গোয়ায় গত নভেম্বরে, কেন্দ্রীয় সরকারের এই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রোৎসব ‘ইফি’ যাঁরা দেখেননি, তাঁরা ছবিটি দেখেছেন পরের মাসেই, ডিসেম্বরে, রাজ্য সরকারের কলকাতা চলচ্চিত্রোৎসবে।

সিনেমা ছিল লুকাসের ‘প্ল্যান বি’, হতে চেয়েছিলেন নৃত্যশিল্পী। এক বার স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে খুব মন লাগিয়ে নেচেছিলেন, তাঁর সাহসী ‘পারফরম্যান্স’-এর প্রশংসার পাশাপাশি তাঁকে নিয়ে মুখরোচক গুঞ্জনও শুরু হয়েছিল, তিনি কী ভাবে দেহবিভঙ্গে নারীসুলভ লালিত্য এনে ‘ম্যানারিজ়ম’ তৈরি করেছেন, ইত্যাদি... তখন তাঁর বয়স তেরো। সেই যে লজ্জায় সেঁধিয়ে গেলেন, ঘরের চার দেওয়ালের ভিতরে ছাড়া আর কখনও নাচের ‘পাবলিক পারফরম্যান্স’ করেননি।

পরে যখন লুকাসের হাতে ক্যামেরা এল, ফিল্ম-স্কুলে ভর্তি হয়ে তাঁর নৃত্যশিল্পী হওয়ার বাসনাকে কী ভাবে চলচ্চিত্রের ভাষায় রূপান্তরিত করা যায় তা নিয়ে সচেষ্ট হলেন। নিজের অব্যক্ত শিল্প-অভিপ্রায়কে প্রকাশ করতে শুরু করলেন ইমেজ সাউন্ড আর কোরিয়োগ্রাফির ভিতর দিয়ে, কথা-সংলাপ যত দূর সম্ভব কম ব্যবহার করে।

অবশ্যই তুলনা নয়, তবে এই অনুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় চিত্রকলার সঙ্গে নৃত্যকলার ছন্দযোগ মনে পড়েই যেতে পারে কারও, শঙ্খ ঘোষ এই আঙ্গিকগত পারস্পরিকতা সম্পর্কে লিখেছেন: “রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির মধ্যে স্পষ্টতই কয়েকটি নাচের ছবি আছে। কিন্তু সেটাই সবচেয়ে বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা এই যে, যেখানে তা নেই সেখানেও প্রায়ই থেকে যায় এই ‘অদৃশ্য নৃত্য’...।” প্রথম ছবিতে নৃত্যের শরীরী উপস্থিতি রাখার পর এই ‘অদৃশ্য নৃত্য’-এর বাতাবরণই রেখেছেন লুকাস ক্লোজ় ছবিটি জুড়ে। প্রাণিত হয়েছেন তাঁর নৃত্যশিল্পী হওয়ার ফেলে আসা স্বপ্ন থেকে, ব্যবহার করেছেন কোরিয়োগ্রাফার কিংবা ডান্সারদের কর্মকাণ্ডকে। এই ‘বডি ল্যাঙ্গোয়েজ’ই নিজের ছবির যথার্থ শিল্পভাষা মনে করেন লুকাস, কথাশব্দের বদলে। “আই অ্যাম ট্রাইং টু মেক সাম অব দিস ডান্সিং ড্রিম কাম ট্রু থ্রু মাই সিনেম্যাটিক ল্যাঙ্গোয়েজ,” বলেছেন তিনি। সামাজিক ভাবে যে মানসিক পীড়নের শিকার হয়েছিলেন লুকাস, তারই প্রতিস্পর্ধী চলন তাঁর এই ছবিতে বুনে দিলেন তিনি।

যে তেরো বছর বয়সে নৃত্যচর্চা ছেড়ে দিয়েছিলেন লুকাস লোকলজ্জার ভয়ে, সেই তেরো বছর বয়সেরই দু’টি বালকের বন্ধুত্ব নিয়ে, তাদের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর এই ছবি। এই তেরো বছর বয়সটি অদ্ভুত, বালকবেলার শেষ আর বয়ঃসন্ধির দোরগোড়া। বালকবেলা ছেড়ে ছেলেরা যত বয়ঃসন্ধির মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকে, তেরো থেকে আঠারো-উনিশ বছরের দিকে, ততই ‘পৌরুষ’-এর একটি নির্দিষ্ট ধারণা তাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেওয়ার চেষ্টা হয়, যা শেখায় প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা মারফত অপর পুরুষকে পরাজিত করে আধিপত্য কায়েম করতে, ক্ষমতার দ্বারস্থ হতে, নারীর দখল নিতে।

লিয়ো ও রেমির বন্ধুত্বের মধ্যে যে নিবিড় নির্ভরতা ছিল, যে কোমল মুহূর্ত ছিল, সবই আস্তে আস্তে অবসিত হতে থাকে, হারিয়ে যেতে থাকে পরিস্থিতির চাপে, সমাজের চাপে। অকাল বিচ্ছেদ ঘনিয়ে আসে দু’জনের মধ্যে, রেমি মারা যায়, বাড়ি শূন্য রেখে কোথায় যেন চলে যান রেমির বাবা-মা।

‘ব্রুটাল’ বলেছেন একে লুকাস। বলেছেন: এই ‘ব্রুটালিটি’ বাইরের পৃথিবীটাকেই শুধু বদলে দেয় না, বদলে দেয় আমাদেরও, “হাউ উই কাট ফ্লাওয়ার্স, হাউ কালার্স ডিসঅ্যাপিয়ার, ইনসাইড অব আস...।” বন্ধুত্ব যখন নিহত হয়, আমাদের অন্তরে বিপুল অন্ধকারে ফুল ঝরে যায়, রং মুছে যায়...।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement