ডাঙা থেকে কিছুতেই জলে নামতে চাইত না রুপু। ওই ডাঙায় দাঁড়িয়েই ভিতু ভিতু মুখে এ-দিক ও-দিক তাকাত। আমরা বলতুম— নেমে আয়, না নামলে খেলা হবে কী করে রে? রুপু তখন প্রায় চোখ কান বুজে ছুট লাগাত, আর ওই দিশেহারা ছুটের মাঝে দশ বারের মধ্যে আট বারই— ছোঁয়া— আউট, এ বার তুই কুমির।
কোভিডের এই দ্বিতীয় ঢেউতে লুকিয়ে থাকা কুমিরের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে তো একটু বোকাসোকা আমাদের রুপু?
ভয়ের পাশবালিশ
ভয় করছে মা। বড্ড অন্ধকার, আমাকে জড়িয়ে থাকো।
কিসের ভয় রে খোকা? হলই বা অন্ধকার, আমি তো পাশের ঘরেই আছি।
খোকা বলতে পারেনি এ ভয় কিসের। বড় হয়ে সাজানো ভাষার দাক্ষিণ্যে আমরা একে নাম দিয়েছি ‘অজানার ভয়’। মা তখন পাশে শুয়ে গল্প বলত, গান গাইত। কখনও আবার কাজ থাকলে একা ফেলে চলে যেত। ভয়কে পাশবালিশের মতো জড়িয়ে আস্তে আস্তে বড় হয়ে ওঠে খোকা। এখন কাকে বলবে সে— বড্ড অন্ধকার, আমার ভয় করছে?
খোকা বড় হয়েছে, তাই ভাবে, নিজের জীবনের উপর তার নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। যখন সেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়, খোকা ভয় পায়। কোভিড সেই রূপ-বদলানো দৈত্যের মতো সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। বড় হয়েছে, তাই খোকা সে ভয় প্রকাশ্যে স্বীকার করতেও ভয় পায়। তার ভয় প্রকাশ পায় রাগ, ক্ষোভ, বা বাস্তবকে অস্বীকার করা সুখলিপ্সা রূপে। কিন্তু দিনের শেষে আকাশ জুড়ে নেমে আসে দিগন্তব্যাপী ভয়। নিজের আর প্রিয়জনের মৃত্যুভয়। খোকা সতর্ক হতে চায়।
পজ়িটিভ থাকার গল্পগাছা
সতর্ক থাকলেই বাঁচা যাচ্ছে না যে। মনবিশারদেরা বলেছেন, পজ়িটিভ থাকো। মনস্তাত্ত্বিকের কোট পরা আমি দিশেহারা। বাবু হয়ে ওঠা খোকা ফোন করে টেলিকাউন্সেলিং চায়— কী করে পজ়িটিভ থাকব, আপনি বলে দিন ম্যাডাম। পজ়িটিভ মানে কী, তা কি আমিই জানি? সে কি এই ভরসা রাখা যে, আমার আর আমার প্রিয়জনের কিছু হবে না? এই ভরসা রাখা যে শুধু অবাস্তব, তা-ই নয়— এ এক স্বার্থপরতাও। হে ঠাকুর, আমার প্রিয় যেন বাঁচে; আর মনের গহিনে অস্ফুটে থাকে বুঝি— অন্য কারও যা-ই হোক না কেন!
তবে কি ভয়ে আধমরা হয়ে থাকব? ধমকে ওঠে আমার মনবিশারদ মন। এ কেমনতর পেসিমিজ়ম? ভয়ের ‘ভ’-কে ভাল থাকার ‘ভ’-তে নিয়ে এস। মন দাও সদর্থক কাজে, গানে, রান্নায়, পরিবারের সঙ্গে সময় বাড়াও, সিনেমা দেখো, পুরনো শখগুলিকে মিটিয়ে নাও। টিভি দেখো না বেশি, মানুষখেকো খবরগুলোকে মাথা থেকে ঠেলে ফেলে দাও। মনবিশারদ বলেছেন ঠিকই, তাতে কিছুটা আরামও হয় বটে; কিন্তু মনের লুকানো ভয়টা পুরোপুরি যায় না। গত বছর সমাজমাধ্যমজোড়া কত মানুষের নাচের ভিডিয়ো দেখেছি, এ বার সেই আনন্দোচ্ছলতা কই? আসলে এ সবই ভুলে থাকার নিদান— যে মৃত্যু হয়তো বা এখনই পিছনদুয়ার দিয়ে ঘরে ঢুকছে, তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখা।
মনের উপর কোভিডের প্রভাব নিয়ে গত দু’বছরে দেশে-বিদেশে অনেক গবেষণা হয়েছে। যে দু’টি সমস্যা সবচেয়ে প্রকট, তা হচ্ছে: জীবনের ছন্দের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব; এবং, প্রিয়জনের মৃত্যুর পরে শোকের প্রকাশ অবরুদ্ধ থাকার বেদনা। বিশ্বজোড়া হতাশার মধ্যে চোখ সরাবারও জায়গা নেই যে। তাই ভাবি, পজ়িটিভ থাকতে কী করে বলি?
জীবন লইয়া কী করিব?
চোখ সরাবার জায়গা না থাকলে চোখ মেলেই দেখতে হবে। রোগ আর মৃত্যুর খতিয়ান। শতকরা বনাম সংখ্যার হিসেবের দ্বন্দ্ব। পরিচিতদের জীবনের দুঃসংবাদ, নিজজনেরা একটু অসুস্থ হলেই আতঙ্কিত হওয়া— এটাই তবে জীবন? বিজ্ঞানীরা দিশাহারা। আজ একটা বিধান দেন, তো কাল সেটা বাতিল। আবার ঘনঘন রূপ বদলানো ভাইরাসের সঙ্গে মরণ হুল্লোড়ে মেতেছে বুঝি নানা রঙের ফাঙ্গাস। এর সঙ্গে তথ্যের অস্পষ্টতা, প্রতিষেধকের অপ্রতুলতা, দূরদৃষ্টি আর মানবিকতার নিরিখে জনপ্রতিনিধিদের ঔদাসীন্য। কেউ জানি না, দু’বছর, তিন বছর— কত দিন এই ভাবে কাটাতে হবে আমাদের। জানি না, কোনও দিন ‘ওল্ড নর্মাল’-এ ফিরব কি না; সে ফেরা দেখার জন্য আমি সপরিবার বেঁচে থাকব কি না।
আমরা সবাই মৃত্যুকে মুখোমুখি জানব তো এক বারই— যেখান থেকে আর ফিরব না। কিন্তু যখন প্রিয়জনকে চলে যেতে দেখছি সেই অজানা পথে— চোখের সামনে, কিংবা চোখের আড়ালে! চোখের সামনে থাকলেও তাকে জড়িয়ে রাখতে পারছি না— স্পর্শদোষের আশঙ্কায়। হাসপাতালে থাকা প্রিয়জনের প্যারামিটারের ওঠা-নামার ব্যাখ্যায় আশা-আশঙ্কায় দুলছি। তার মধ্যেই হয়তো দূরভাষিক খবর চূড়ান্ত পরিণতির। হয়তো নিজের অসুস্থতার জন্য সে খবরকে গ্রহণ করার মতো দেহমনের জোরটুকুও তখন অনেকের বাকি নেই। এ এক নির্মম পরিস্থিতি, যখন মৃত পরিজনের দেহে শেষ বার আদরের হাতটুকু বুলিয়ে দিতে পারব না; দেখব না সে দেহের কী পরিণতি হল। চিরচেনা মানুষ শুধু একটি দূরভাষের বার্তায় অচেনা হয়ে যাবে।
মৃত্যুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য জীবিত পরিজনকে ধীরে ধীরে সেই চরম অনুভূতিকে গ্রহণ করার সময় দিতে হয়। মৃত প্রিয়জনের দেহ দেখা, স্পর্শ করা, সম্মান জানানো— সবেরই একটা দীর্ঘস্থায়ী মূল্য থাকে জীবিতজনের মানসিক সুস্থতার পরিসরে। এই ‘ক্লোজার’ বা সমাপন ঠিকমতো ঘটে না কোভিড মৃত্যুর দেহ-সংক্রান্ত বিধিনিষেধে। কী জানি, এই মানসিক বেদনার পরিসর কত জনের আমরণ বিস্তৃত থাকবে। কী জানি, কী হবে সেই শিশুদের— কোভিড যাদের পৃথিবীকে পাল্টে দিল।
তবু মানিয়ে নিতেই হবে। অদ্ভুত এই মানিয়ে নেওয়ার দায়— প্রকৃতি, বিজ্ঞানী, রাজনীতিক, ভয়-ব্যবসায়ী সকলের খামখেয়ালিপনা, নির্বুদ্ধিতা, হিংস্রতা, স্বার্থপরতা, অসহায়তা, সব কিছুকে মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই— সাধারণ জনের।
একটু অন্য ভাবে চেষ্টা করি। ভয়, রাগ, দুঃখের আবেগের যবনিকা সরিয়ে জীবনের অনিশ্চয়তাকে যদি স্পষ্ট আলোয় দেখি? বাস্তবের উপর আর নিয়ন্ত্রণ নেই; এটাই বাস্তব। আমি তো তত ক্ষণই অসহায়, যত ক্ষণ ভরসা রাখি সহায়ের উপর। কিন্তু যদি নিশ্চিত জানি যে জীবনের রূপটিই অনিশ্চিত?
আমরা হয়তো এত দিনই ভুল ভেবে এসেছি। আরও বেশি ভোগের উপকরণে সাজিয়ে প্রকৃতির ছন্দকে আঘাত করে আর বাঁধন দিয়ে সুখের বিভ্রমে ভেসে গিয়েছি। মানব চরিত্রে তো দু’টি দিকই আছে, একটি আত্মসুখের সন্ধানী, অন্যটি পারস্পরিকতা আর বৃহত্তরের অভিমুখী। প্রথমটি স্বার্থভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায় প্রকৃতি, জীবজগৎ আর অন্য মানুষের উপর। দ্বিতীয়টি নিজেকে মেলে ধরতে চায়, ভালবাসায়— অন্যের কাছে নিজেকে মিলিয়ে আর বিলিয়ে দেওয়ায়। দু’টিই সত্য, প্রতি হৃদয়ে তারা পাশাপাশি হাত ধরাধরি করেই থাকে; দু’টিকেই ফুটিয়ে তোলা যায় যদি চেষ্টা করি যথাযথ ভাবে।
বহু দশক ধরে আমরা সাফল্য আর উন্নতির নামে ভোগসুখের চাষ করেছি। ফলন রূপে পেয়েছি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার ভ্রান্ত আস্থা। আমাদের চোখ পাশের বাড়ির মানুষগুলির ভালমন্দ থেকে নিস্পৃহ হয়ে শুধু নিজের বাড়িতে ঢুকেই ক্ষান্ত হয়নি; নিজের পরিজনের থেকেও বিচ্যুত হয়ে লগ্ন হয়েছে মোবাইলের স্ক্রিনে।
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে
কোভিডকে এড়ানো যাবে অদূর ভবিষ্যতে, এ ভরসা নেই। মেনে নিতে হবে যে, নিয়ন্ত্রণের মন্ত্র এখনই কাজ করবে না। অথচ, অপরূপ সৌন্দর্যে এই অনিশ্চিতের মধ্যেই জেগে উঠেছে কিছু মানুষের সুপ্ত ভালবাসার, অন্যের কথা ভেবে জীবনকে অর্থপূর্ণ করার সহজাত প্রবণতা। ত্রস্ত অসহায় মানুষের সাহায্যের জন্য তারা হাত বাড়িয়ে রেখেছে। জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে এই অভাবিত বন্ধুদের মধ্যে অবশ্যই আছেন অনেক স্বাস্থ্যকর্মী, কিন্তু আছেন অন্য অনেক পেশার মানুষজনও। সবচেয়ে আশার কথা, এই দলে আছে অনেক কিশোরী ও কিশোর, যুবতী ও যুবক, যাদের আমরা ভোগবাদী সভ্যতার উদাহরণ হিসেবেই ভাবতাম। রোগীর জন্য, অভুক্তের জন্য, কর্মহীনের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তারা। মানুষ তা হলে এখনও ভালবাসতে ভোলেনি। মৃত্যুর শঙ্কা স্বার্থের আবরণকে সরিয়ে দিয়েছে, অন্তত কিছু মানুষের জন্য। আমরা বাকিরা কি তাদের অনুসারী হতে পারি? জীবনের অনিশ্চিতকে নিশ্চিত করতে পারব না। কিন্তু হয়তো এখনও জাগিয়ে তুলতে পারি আমাদের সত্তার দ্বিতীয় কেন্দ্রটিকে, যেখানে আছে স্বার্থহীনতা আর ভালবাসা। তা হলে বুঝি গভীর যন্ত্রণাতেও আমাদের কাছে নিজের অস্তিত্বের কিছু অর্থ থাকবে। একে কি বলতে পারি পজ়িটিভ বাঁচা?
দেহের সব রোগের ওষুধ মজুত থাকে না চিকিৎসকের ভাঁড়ারে। মনের সব কষ্টের সমাধান থাকে না মনবিদের ঝুলিতে। জীবন আর মৃত্যু, দু’টিই দেহবিজ্ঞানের আর মনোবিজ্ঞানের চেয়ে বড়। তাই এখন বিনীত হই। প্রার্থনা করি, ভালবাসা জাগুক আমাদের মধ্যে; অনিশ্চিতকে গ্রহণ যদি করতেই হয়, অন্যকে ভালবেসে, অন্যের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রেখেই যেন করি। ঈশ্বর বলতে হয়তো এই ভালবাসাকেই বোঝায়।
ফলিত মনোবিজ্ঞান বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়