machines

যন্ত্রের নকশাও যখন পুরুষালি

যখন থেকে মাস-প্রোডাকশন শুরু হল, এল অধিক মুনাফা ও পুঁজিবাদের প্রশ্ন, তখন থেকে মেয়েরা ছিটকে পড়ল এর আওতা থেকে।

Advertisement

তৃষ্ণা বসাক

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২১ ০৫:৪১
Share:

১৯০০ সাল। জনপ্রিয় মিউজ়িক পাবলিশার ই টি পল মিউজ়িক কোম্পানি একটি গানের বই বার করল, তার প্রচ্ছদটি বিশেষ ব্যঞ্জনাময়। প্রচ্ছদের উপরে লেখা ‘ডন অব দ্য সেঞ্চুরি’। এর কেন্দ্রে সুন্দরী এক নারী, তিনি প্রগতির দেবী। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটি চাকার উপর, যার দু’দিকে ডানা, যা কিনা সময়ের প্রতীক। তাঁর হাতে নতুন শতাব্দীর পতাকা। তিনি চলেছেন ভবিষ্যতের দিকে। তাঁর চার দিকে মহাশূন্যে ভাসছে রেলওয়ে, ক্যামেরা, মেশিন, প্রিন্টিং প্রেস— প্রগতির অভিজ্ঞানগুলি।

Advertisement

এই ছবিটা এক আশ্চর্য বৈপরীত্য তুলে ধরে। কারণ শিল্পায়নের আগে, যেটাকে আমরা বলছি প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজ়েশন, সেখানে প্রতিটি পরিবার উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তখন নারী কিন্তু এই উৎপাদনের কেন্দ্রে ছিল। সভ্যতার আদিতে চাষের কাজে এবং অন্য উৎপাদনে নিয়োজিত নারী নিজেদের সুবিধার জন্য ছোট ছোট যন্ত্র নিজেরাই উদ্ভাবন করেছিল। যেমন ঢেঁকি, সুচ, বা বোনার সুতো। যখন থেকে মাস-প্রোডাকশন শুরু হল, এল অধিক মুনাফা ও পুঁজিবাদের প্রশ্ন, তখন থেকে মেয়েরা ছিটকে পড়ল এর আওতা থেকে। প্রযুক্তি চেহারায় ও দাপটে হয়ে উঠল পুরুষালি। মাঠের জন্যে পুরুষ আর চুলোর জন্যে নারী/ তলোয়ারের জন্যে পুরুষ, সুচের জন্যে নারী।

অবাক লাগে, যন্ত্রের নকশা করার সময়ও মাথায় রাখা হয় পুরুষ শরীর এবং তার প্রয়োজনের কথা। ক্যারোলাইন ক্রিয়াড পেরেজ়, লেখক, নারীবাদী, বিলেতের মানুষ, লিঙ্গবৈষম্যের সঙ্গে লড়ে চলেছেন। তাঁর সাম্প্রতিক বই ইনভিজ়িবল উইমেন-এ তিনি দেখিয়েছেন গাড়ির সিটবেল্ট, ভয়েস রেকগনিশন সফটওয়্যার থেকে পাবলিক রেস্টরুম সব কিছুই ছেলেদের কথা ভেবে বানানো, যে কোনও যন্ত্র বা গ্যাজেট ডিজ়াইন করা হয় পুরুষের কথা মাথায় রেখে। আর তাই মেয়েরা যখন সেগুলো ব্যবহার করেন, তখন যে শুধু তা তাঁদের পক্ষে আরামদায়ক হয়, তা-ই নয়, তা তাঁদের সুরক্ষার পক্ষেও ভয়ানক।

Advertisement

এই বইটা তিনি অদ্ভুত এক ধাক্কা থেকে লিখতে শুরু করেছিলেন। হঠাৎ জানতে পেরেছিলেন, হার্ট অ্যাটাকের যে লক্ষণগুলি প্রচারিত হয়, অর্থাৎ বুকে ব্যথা, বাম বাহুতে ব্যথা, তা হচ্ছে আসলে পুরুষের হৃদ্‌রোগের উপসর্গ। নারীর উপসর্গ— নিশ্বাসের কষ্ট, বমি ভাব, ক্লান্তি, বদহজমের ভাব। কিন্তু এগুলি জনস্বাস্থ্য তথ্যে থাকে না। এই আবিষ্কারের পর থেকে ক্যারোলাইন লক্ষ করতে শুরু করলেন, সব যন্ত্র বা গ্যাজেটের নকশাই ছেলেদের কথা ভেবে তৈরি।

এক এক করে বলা যাক। পাবলিক রেস্টরুমের মাপ ছেলে এবং মেয়ে দু’জনের জন্যেই সমান। আপাতদৃষ্টিতে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মেয়েদের বিশেষ প্রয়োজনের কথা ভাবলে, যেমন ঋতুকালীন প্রয়োজন, কিংবা শিশু এবং বৃদ্ধার প্রয়োজন, তা হলে অবশ্যই মেয়েদের জায়গা অনেক বেশি লাগে। ব্যাগ ঝোলানোর হুকও অনেক সময় থাকে না।

মজার কথা, বরফ পরিষ্কারের কর্মকাণ্ডও পুরুষমুখী। সুইডেনের কার্লসকোগা শহরের অফিশিয়ালরা স্বীকার করেছেন, তাঁদের যা কাজের ব্যবস্থা, এতে উপকৃত বেশি ছেলেরাই। মেয়েদের দিনব্যাপী ছোট ছোট যাওয়া-আসায়, জনপরিবহণে, হয়তো বাচ্চাকে খাওয়াতে আসা, পেরেন্টস মিটিং থাকা, বৃদ্ধ বাবা মাকে দেখাশোনা ইত্যাদি, বাড়ির বাজার, দোকান, ব্যাঙ্ক, এ সবের জন্য ছোট রাস্তা আর গলিপথই ভরসা। বলা বাহুল্য, এর অনেকটাই ‘আনপেড ওয়ার্ক’। মেয়েরা এখনও সারা পৃথিবীর ‘আনপেড কেয়ার ওয়ার্ক’-এর ৭৫ শতাংশ করে। তাই তাদের যাতায়াতের পথের বরফ অনেক সময়ই পরে পরিষ্কার হয়, তাদের ভুগতে হয় অনেক বেশি।

এই যে যে-কোনও গ্যাজেট বা ইনফো সিস্টেম থেকে মেয়েদের বাদ দেওয়ার অভ্যাস, এর কারণ হিসেবে দেখানো হয় একটা অজুহাত, মেয়েরা বড্ড জটিল, তাদের শরীর জটিল, মন জটিল, যাতায়াত করার ধরনটিও জটিল। মনে পড়ে, স্কুলে বায়োলজি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে মেয়ে ‘ব্যাঙ পড়লে’ মাথায় হাত পড়ত। কী জটিল ওদের শরীর, কত কী প্রত্যঙ্গ! ছেলে ব্যাঙ কত সরল, ঝপাঝপ কাটা হয়ে যায়!

ভয়েস রেকগনিশন সফটওয়্যার নারীকণ্ঠ চেনে না, কারণ যে ডেটাসেটের ভিত্তিতে অ্যালগরিদম বানানো হয়, তা ‘মেল-বায়াসড’ বা পুরুষ পক্ষপাতদুষ্ট, ট্রান্সলেশন সফটওয়্যারও তা-ই, ইমেজ লেবেলিং সফটওয়্যার উনুনের পাশে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলেই তাকে মহিলা ভেবে নেয়। এই স্টিরিয়োটাইপ এক ভয়ঙ্কর অভ্যাস। এখনও মহিলা শৌচালয়ের বাইরে থাকে ঘোমটা দেওয়া মহিলার ছবি। যেন জিনস-সালোয়ার পরিহিতারা মহিলাই নয়! একই ভাবে সিটবেল্ট, এয়ার ব্যাগ সুরক্ষা থেকে কোমরে আটকানো মাইক্রোফোন সেট— সব পুরুষ পক্ষপাতদুষ্ট। অর্থাৎ, যে ডিফল্ট বডি টাইপ নিয়ে এদের ডেটাসেট তৈরি, তা পুরুষের শরীর।

১৯৩০ সালে বিখ্যাত সুইস স্থপতি লা করবুইজ়ার স্থাপত্যে হিউম্যান স্কেল নিয়ে এলেন। কী সেই হিউম্যান? তা আসলে ছয় ফুট লম্বা এক পুরুষ! ১৯৫০ সালে কার ক্র্যাশ টেস্ট ডামি ব্যবহার শুরু হল, তা আসলে একটি পুরুষ। যখন নির্মাতারা উপলব্ধি করলেন, পৃথিবীতে মেয়েরাও আছে, তখন ফিমেল ক্র্যাশ টেস্ট শুরু হল, কিন্তু সেখানে যে ফিমেল ডামি নেওয়া হল, তা আসলে স্কেল ডাউন মেল বডি, অর্থাৎ পুরুষ শরীরের একটি ক্ষুদ্রতর রূপ।

এই অবস্থা তখনই পাল্টাবে, যখন অনেক নারী আসবে প্রোডাক্ট ডিজ়াইনে। তত দিন শেয়ালের বাড়ি বকের নেমন্তন্ন খাওয়া ছাড়া উপায় কী?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement