Political Violence

অপ-রাজনীতি বন্ধের পথ

সদাইপুরে লালমোহনপুর গ্রামে পাঁচটি বড় পাত্র বোঝাই ১০২টি বোমা উদ্ধার করে পুলিশ। বোমা নিষ্ক্রিয় করার সময় ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালায় মানুষ।

Advertisement

সামিরুল ইসলাম

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৩ ০৮:১২
Share:

বড় মাপের রাজনৈতিক হিংসার ঘটনায় সাধারণত প্রাণ যায় মহিলা ও শিশুদের। ফাইল চিত্র।

আর কিছু দিন পরেই পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন। বীরভূমের লাল-কাঁকুরে পথ জুড়ে লাল পলাশ। চারিদিকে যখন আনন্দের আয়োজন, ঠিক তখনই বিকট বোমার আওয়াজে কেঁপে উঠছে এক একটা গ্রাম। লুকিয়ে রাখা বোমা ফেটে ক্ষতবিক্ষত শিশু মল্লারপুরের খরাসিনপুরে রামপুরহাট হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। ফেব্রুয়ারিতেই মাড়গ্রামে বোমা বিস্ফোরণে দুই যুবকের মৃত্যু হয়। রামপুরহাটের বারমেসিয়ায় পুলিশ উদ্ধার করে ড্রামভর্তি বোমা। সদাইপুরে লালমোহনপুর গ্রামে পাঁচটি বড় পাত্র বোঝাই ১০২টি বোমা উদ্ধার করে পুলিশ। বোমা নিষ্ক্রিয় করার সময় ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালায় মানুষ। বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে বীরভূম।

Advertisement

যে কোনও বড় মাপের রাজনৈতিক হিংসার ঘটনায় সাধারণত প্রাণ যায় মহিলা ও শিশুদের। গত বছর মার্চে বগটুইয়ের ঘটনায় স্থানীয় নেতা ভাদু শেখের খুনের বদলা নিতে গ্রামে যে আগুন ধরানো হয়, তাতে মোট বারো জন হিংসার বলি হন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ছ’জন মহিলা ও দু’জন শিশু। ভয়ঙ্কর, কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়— বাম আমলে নানুরে এগারো জন খেতমজুর হত্যা, সুচপুরের গণহত্যার ধারাতেই এই হিংসার স্রোত বয়ে চলেছে। যে জেলায় বাউলের একতারার মেঠো সুর জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে ভালবাসতে শেখায়, সেখানে এত অশান্তি কেন! বিদ্রোহ, বিপ্লব ও আর লাল-মাটির বীরভূম আজ রাজনৈতিক হিংসার মৃগয়াক্ষেত্র। কবি চণ্ডীদাস, জয়দেব, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথের চারণভূমি বীরভূমের পরিচয় আজ তার ‘বোমা শিল্প’।

এর শেষ কোথায়? শাসক ও বিরোধী নেতারা নাহয় আখের গোছাতে ব্যস্ত। কিন্তু যাঁরা নিজেদের সচেতন, শিক্ষিত মানুষ বলে দাবি করেন, হিংসা থামাতে তাঁদের ভূমিকা কী? শুধু নেতাদের দোষারোপেই দায় সারা যায় না। হিংসা থামাতে নাগরিক সমাজের অবদান কতটুকু? সাধারণ নাগরিকের জনজীবন-বিমুখ ‘নিরাপদ’ রাজনীতিও কম সমস্যাজনক নয়। এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা দখল করে নিচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রের ফাঁকা জায়গাগুলি। মধ্যবিত্ত সচ্ছল পরিবারের পিতামাতারা সন্তানদের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আদৌ উৎসাহ দেন না, প্রতিবাদ করতে শেখান না। শেখান, কী করে পালিয়ে বাঁচতে হয়, কী ভাবে নিজের ভালটা করে নিতে হয়।

Advertisement

মানুষের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতিও আজ দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত লোকসভা, বিধানসভা ভোট, বা আগামী পঞ্চায়েত ভোটের আগে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে বাংলা জুড়ে শান্তি আনতে এক সুরে বার্তা দিতে এখনও পর্যন্ত কাউকে দেখিনি। কেবলই চলে কাদা ছোড়াছুড়ির পালা। রাজনীতির ময়দানে প্রকাশ্য জনসভায় নেতারা ‘একে অপরকে দেখে নেন’। নেতার উস্কানিতে বোমায় প্রাণ গেলে মৃত ব্যক্তি কোন দলের নেতা বা সমর্থক, তা নিয়েই তরজা শুরু হয়ে যায়। মরার আগে সে কারও পিতা ছিল, কারও স্বামী, কারও পুত্র বা ভাই, মরার পরে সে কেবল রাজনৈতিক লাশ।

‘কোন দল, তুমি কোন দলে?’ ক’দিন পরে গোলমাল ঠান্ডা হলে সেই মানুষটির পরিবারকে সবাই ভুলে যান। তত দিনে যতটুকু রাজনৈতিক লাভ নেওয়া যায়, নেতারা নিয়ে নিয়েছেন, মিডিয়া বাড়িয়ে নিয়েছে টিআরপি। রোজগেরে মানুষটিকে হারিয়ে অকূলপাথারে ভেসে গিয়েছে পরিবার। কেউ খোঁজ নেওয়ার নেই।

মনে পড়ে, সাঁইথিয়াতে রাজনৈতিক লড়াইয়ের মাঝে এক জন পা হারিয়েছিলেন। প্রথম দিকে তাঁকে নিয়ে রীতিমতো রাজনীতির বাজার গরম হয়। আর এখন তাঁর কেউ খোঁজ নেয় না। চিকিৎসার অভাবে তাঁর পায়ে পচন ধরেছে। এমন উদাহরণ অনেক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বীরভূমের গ্রামে গ্রামে বোমা বাঁধছেন গরিব মানুষ। ওই বোমা পড়বে যাঁদের উপর, তাঁরাও সেই একই অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ভিনগ্রামে বোমা বাঁধছেন। মরছেন গরিব, মারছেনও গরিব। এঁরা ক্ষমতাবানদের নিষ্ঠাবান লেঠেল। এই লড়াইয়ে বড় নেতানেত্রীদের কখনও বলি হতে দেখা যায় কি? প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের একটা বড় অংশের জীবনের মান তেমন বদলায়নি। বহু জনজাতি এলাকায় পরিস্রুত পানীয় জলটুকু মেলে না। ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। এঁদের অভাবকে কাজে লাগিয়ে, কিছু পয়সা ধরিয়ে দিয়ে, রাজনৈতিক হিংসায় জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

পুলিশ-প্রশাসনের উপর ভরসা রেখে দিন কাটানো চলে না, তারা ক্ষমতারই ডালপালা। এলাকার শিক্ষিত, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের এগিয়ে আসা দরকার। শুরু হোক পাড়ায় পাড়ায় মাদুর পেতে আলোচনা। সকলকে বোঝাতে হবে, কিছু টাকার বিনিময়ে বোমা-বন্দুক হাতে তুলে নেওয়া চলে না, কারণ পরিবারকে বাঁচানোর দায়িত্ব অন্য কেউ নেবে না। প্রয়োজনে সঙ্গে নিতে হবে সেই ভুক্তভোগীদের, যাঁরা নেতার জন্য প্রাণ দিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু আজ তাঁদের ভুলে গিয়েছেন নেতারা। এ ভাবে হিংসার পরিণাম তুলে ধরলে হয়তো হিংসার কবল থেকে দরিদ্র মানুষকে বার করে আনা সম্ভব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement