রাজার চিঠি’ কেবল অমল পেয়েছিল। ‘ইলেকশন কমিশন’-এর চিঠি এখন সুধারাও পেতে শুরু করেছেন। পাওয়ার পরই তাঁদের জীবনের সুধাসাগর হলাহলে টইটম্বুর। এ কী হল? কেন হল? কী যে হল? এখন কী হবে? প্রশ্নের শেষ নেই; আতঙ্কেরও। প্রাত্যহিকীর তরী হঠাৎ ডুবে যাওয়ার অবস্থা। ছেলেরাও সোনামুখ করে ‘ভোট করতে’ যান না, কিন্তু মেয়েদের অবস্থা ট্র্যাজেডির শেষ সীমায়।
কেন? বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে বাস করি আমরা। নির্বাচন হল ‘গণতন্ত্রের উৎসব’। হ্যাঁ, উৎসবে মাঝেমধ্যে দুমদাম শব্দ হয়, ‘উন্মাদনা’ দু’শো মিটারের বাঁধ ভেঙে দিয়ে ‘মা ভৈ! মা ভৈ’ বলে তেড়ে আসে। কিন্তু সেটি সার্বিক চিত্র নয়। এই বার সাবধানতার ‘আশ্বাস’ অন্তত অনেক বেশি। তা হলে নারী সমাজে এমন ‘ঐ আসে ঐ অতি’ রব কেন? কান পেতে শুনতে গিয়ে মালুম হল, ভয়ের মোদ্দা কথা, কী করে করব?
‘কী করে করব?’ এই প্রশ্নের আসলে দু’টি রূপ আছে। প্রথমটি হল, ‘নির্বাচন’ কী ভাবে করাতে হয়, তার কিছুই জানা নেই। তার উপর কপালে যদি ‘প্রিসাইডিং’ জোটে, একেবারে খাদের কিনার। কাজেই সরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদির দেওয়ালে কান পাতলে এখন লেডি মেহের আলিদের আর্তনাদ শোনা যাবে, ‘সব গন্ডগোল হ্যায়!’ কেউ বাড়ির ‘ভোট বিশারদ’-এর কাছে প্রাইভেট টিউশন নিচ্ছেন, কেউ ‘হ্যান্ডবুক’ থেকে নোট নিতে নিতে বাজারি নোটের কথা ভুলে মেরে দিয়েছেন। দুই নারীর মাঝখানে এখন রান্নার রেসিপি, শাড়ির ডিসকাউন্ট বা নতুন পড়া উপন্যাস নেই। সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করেছে সিইউ, বিইউ, ভিভিপ্যাট।
ঠেলায় পড়ে হলেও শিক্ষা যে কোনও মূল্যে ইতিবাচক প্রাপ্তি। মেয়েরা সব পারেন, আর ‘নির্বাচন’ সামলাতে পারবেন না? তবু এমন ল্যাজে গোবরে অবস্থা হচ্ছে কেন? নির্বাচন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেলেও সেই অবস্থার প্রতিফলন দেখা যাবে। ‘প্রশিক্ষণ’ তার মতো চলছে। শিক্ষার্থী উদাস চোখে কে জানে কোন দিকে চেয়ে আছেন। ভাবছেন, বাড়ির কী হবে? ডিউটির দুটো তিনটে দিন বাড়িটা চলবে কী করে?
পুরুষ ভোটকর্মীদেরও যে সাংসারিক সমস্যা নেই, তা নয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা বহুগুণ বেশি। কাজেই দলে দলে প্রমীলারা দরখাস্ত হাতে সরকারি দফতরে ছুটছেন, লাইন দিচ্ছেন। যদি কাটে? যদিও সে আশার ঘুড়ি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘ভো কাট্টা’! সাত বছর আগের অপারেশন, বিশ্বস্ত হাঁটুর ব্যথা, বাড়িতে ছোট্ট বাচ্চা, স্বামী স্ত্রী’র একই দিনে ডিউটি, ঠাকুমার এখনতখন, এমন বহু কারণের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে।
দুগ্ধপোষ্য শিশুর মা’র অব্যাহতির গ্যারান্টি আছে। প্রাণঘাতী অসুস্থতাও ছাড় পাচ্ছে। তবু সাংসারিক সমস্যা এত বেশি কেন বিপন্ন করে মেয়েদের? কারণ, আজও চাকরিরত মহিলার স্বামী নাকি ‘বাড়ির কাজ কিচ্ছু পারেন না’। কেন পারেন না? তাঁর স্ত্রী যদি বাড়ির কাজ সামলে অফিস করতে পারেন, তিনি কেন অফিস সামলে বাড়ির কাজ করতে পারেন না? স্ত্রী’র বেতন যদি গুনেগুনে নেওয়া যায়, তাঁর সাংসারিক কাজের শরিক কেন হওয়া যায় না? ‘বাইরের কাজ’-এর অধিকারে সমান, কিন্তু ‘ঘরের কাজ’-এর অধিকার, ক্ষমতা চির-অসমান?
নিশ্চয় ব্যতিক্রমী জীবনসঙ্গীরাও আছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম দিয়ে তো আর সময়ের ছবি আঁকা যায় না। বিগত অন্তরণকাল বিশেষ করে প্রমাণ করে দিয়েছে, সাধারণ ভাবে পুরুষ সংসারের কাজ কতটা কম করেন। শুধু তা-ই নয়, গৃহকর্মের সুমিষ্ট ফল সবচেয়ে বেশি করে আস্বাদন করার সুযোগ পেয়েও এই কাজকে ব্যঙ্গ করেন। ‘তালাবন্ধ’ সময়ে যখন আবেগের মুক্তি ঘটত ফেসবুকে, তখন আমরা প্রায়ই পুরুষকে ঝাঁট দেওয়া বা বাসন মাজার কাজ করতে হয়েছে বলে আক্ষেপ করতে দেখেছি। ‘কাজের মেসো’ শব্দবন্ধ সেই আক্ষেপকে পরিহাসের মোড়ক দিয়েছে। যদি কাজগুলি এতই ঘৃণ্য হয়, তবে মেয়েদের, এমনকি বাড়ির বাইরে কর্মরত মেয়েদের তা করতে হয় কেন? তাঁরা কি ‘কাজের মাসি’? আর যদি তা-ই হন, তাতেই বা অসম্মানের কী আছে?
মেয়েদের আর একটি গুরুতর সমস্যা দেখা দেয় ‘মা’ হিসেবে। যাঁদের সন্তান আক্ষরিক অর্থে মাতৃদুগ্ধপোষ্য নয়, আবার স্বাবলম্বী হওয়ার মতো বড়ও হয়নি, তাদের মায়েরা দেখছেন, প্রশিক্ষণের সময় অনেক বাচ্চারই অনলাইনে পরীক্ষা চলছে, তাদের তত্ত্বাবধান করা, চাকরি বজায় রাখা এবং ভোট নেওয়ার বিধি ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি এক সঙ্গে করা প্রায় মায়ের পক্ষে ‘হারকিউলিসের কাজ’। অসামান্য গোছানো স্বভাবের হলে সামাল দেওয়া যায়। সুতরাং প্রত্যাশা হল, বাইরের কাজ করতে হলে মেয়েদের অসামান্য (বিদেশি শব্দে ‘সুপারমম’) হতে হবে, পুরুষদের অমন কোনও দায় নেই।
অথচ, এই সমাজ কিন্তু ‘হারকিউলিস’-এর সম্মান দিয়েছে, দেয় ও দেবে পুরুষকেই, আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কাজ করিয়ে নেয় মেয়েদের দিয়ে। পুরুষ ভোটকর্মীরা নিরাপত্তার জন্য যতখানি চিন্তিত হন, সংসারের কথা ভেবে ততখানি হন কি? কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে চিত্র প্রায় উল্টো। আসলে কোভিডের মতো অতিমারি, নির্বাচন ইত্যাদি মাঝেমাঝে এসে সমাজকে বড় পরীক্ষার সামনে ফেলে দেয়। বার বার প্রমাণ হয়ে যায়, চাকরিরত নারীর শ্রম-দাসত্ব চাকরি-না-করা নারীর দ্বিগুণ। কাজেই ‘স্বনির্ভরতা’ কতখানি ‘স্বাধীনতা’, কতখানি ‘পরিশ্রম’, সেই চেনা প্রশ্ন বার বার উঠতে থাকে।
শুধুমাত্র ‘নারী দিবস’ পালন করলেই হবে? মহাকাশে, সেনাবাহিনীতে যাওয়া গুটিকয় নারীর গুনতি করলেই চলবে? প্রত্যহ ডালভাত, বাচ্চার ইউনিট টেস্ট, সাড়ে ন’টার শেওড়াফুলি লোকাল, বসের কাছে ছেলের পিটিএম’এর জন্য হাফে বেরোনোর আর্জি, রাজমার প্যাকেট, বাসন মাজা, ঘরমোছা, কাপড় কাচা ইত্যাদির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গিয়েছেন যে নারী, তাঁর কাজের সঙ্গী হতে হবে না? বাড়ির বাইরে কর্মরতা নারীর সন্তানের দেখাশোনার জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে হবে না? ‘নারী ও শিশুকল্যাণ’ নাম দিয়ে দফতর ও মন্ত্রী বানিয়ে দিলেই দায় শেষ? পরিবার এবং রাষ্ট্র— সকলের মিলিত দায়িত্ব নয় মেয়েদের স্বস্তি এবং স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া? মায়ের প্রতি নির্ভরতার গুরুত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু মায়ের সামাজিক এবং পেশাগত দায়িত্বকেও তো গুরুত্বহীন ভাবলে চলবে না? পেশাগত জীবনে তো কেউ কাউকে জোর করে ঠেলে না? তার সুবিধা নিতে হলে দায়িত্বের সুদও দিতে হবে বইকি। নারীকে নিজেকে এবং তাঁর পরিবারকেও তা দিতে হবে।
এমন দিন কবে আসবে যখন নারীর ‘দশভুজা’ হওয়ার কোনও দায় থাকবে না? বোঝা যাবে ওটা একটা সামাজিক গিমিক মাত্র। মেয়েদের হাতের সংখ্যা দুটোই থাকুক।