পণজনিত কারণে বধূমৃত্যুর হারের তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ, এবং চতুর্থ পশ্চিমবঙ্গ। প্রতীকী ছবি।
এক জনপ্রিয় বিস্কুটের বিজ্ঞাপনে দেখলাম, বিয়ের যৌতুক হিসাবে পাত্রপক্ষ বেশি করে সেই বিস্কুট দেওয়ার কথা বলছেন। কারণ, সেই বিস্কুটের প্যাকেটে পাওয়া যাবে সোনা, রুপো এবং আরও নানান বহুমূল্য উপহার। পণ্য বেচতে হাসির ছলে যৌতুকের সমর্থন? হবে না-ই বা কেন? বিজ্ঞাপনের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ডেভিড ওগিলভি বলেছিলেন, “বিজ্ঞাপন আসলে সমাজেরই প্রতিফলন।” সমাজের গ্রহণযোগ্যতা ও পছন্দের ভিত্তিতে তৈরি বিজ্ঞাপন ক্রেতাকে শুধু পণ্য বা পরিষেবার প্রতি আকৃষ্টই করে না, বিষয়বস্তুটির আত্তীকরণেও সহায়তা করে। তাই যে সমাজে আজকের দিনেও প্রতি দিন গড়পড়তা কুড়ি জন নারী যৌতুকজনিত কারণে প্রাণ হারান, সেই সমাজে এমন বিজ্ঞাপনের যৌক্তিকতা নিয়ে সত্যিই প্রশ্ন থাকে না।
গত পাঁচ বছরে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে পণজনিত কারণে বধূমৃত্যুর হার সর্বোচ্চ— যথাক্রমে প্রায় বারো হাজার ও সাড়ে পাঁচ হাজার— গোটা দেশের প্রায় আটচল্লিশ শতাংশ। এই তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ, এবং চতুর্থ পশ্চিমবঙ্গ। বছরে বধূমৃত্যুর সংখ্যা হাজার তিনেক। আর, না মরে মৃতপ্রায় বা অত্যাচারে আধমরা হওয়া মেয়েদের সংখ্যা, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর কয়েকগুণ বেশি। শারীরিক নির্যাতন ছাড়াও আছে অবিরাম মানসিক অত্যাচার, শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা, খোঁটা দেওয়া বা অহর্নিশ ‘কথা শোনানো’-র মতো বিষয়— মেয়েদের যেগুলো ‘মানিয়ে নিতে’ শেখানো হয় ছোট থেকেই।
যৌতুক বস্তুটি এক অর্থে শাস্ত্রসম্মত। বৈদিক যুগে উচ্চবিত্ত পরিবারগুলি মেয়ের বিয়ের সময় তাঁকে কিছু উপহার সামগ্রী দিত। এমন উপহারের দু’টি যৌক্তিকতা ছিল। এক, সে কালের মেয়েরা, বিশেষত উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েরা, সাধারণত ঘরের বাইরে কোনও কাজে যুক্ত হতেন না। ফলে উপার্জন বা ধন আহরণের কোনও বিকল্প পথ না থাকায় স্ত্রীধনটুকুই ছিল তাঁদের নিজস্ব সম্বল। সেই ভিত্তিতে মনুসংহিতায় এই প্রথাকে ন্যায্য ও সঙ্গত বলা হয়েছে। দুই, সে কালে মেয়েদের যে-হেতু সম্পত্তির উত্তরাধিকার ছিল না, তাই উত্তরাধিকার সূত্রে মেয়েদের প্রাপ্য ভাগটুকু তাঁদের বিয়ের সময়েই উপহার হিসাবে দিয়ে দেওয়া হত।
এর উল্টো পিঠে ছিলেন নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা। তাঁরা যে-হেতু নানান পারিবারিক উৎপাদনমূলক কাজে যুক্ত থাকতেন, তাই মনে করা হত যে, বিয়ে করে কন্যা শ্বশুরবাড়ি যাওয়া মানে সংসারের এক জন উপার্জনকারী ব্যক্তি কমে যাওয়া। তার ক্ষতিপূরণ হিসাবে মেয়ের বাপের বাড়ি বরং কন্যাপণ দাবি করতেন মেয়ের হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে। এমন পদ্ধতি শুনতে মধুর হলেও ব্যাপারটা কিন্তু যৌতুকব্যবস্থার থেকেও ভয়ঙ্কর। কারণ, কন্যাপণ পদ্ধতিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কন্যা নিজেই হয়ে উঠল মূল পণ্য বা লেনদেনের মাধ্যম। যেমন মহাভারতে দেখতে পাই, যযাতি ঘোড়ার বদলে নিজকন্যা মাধবীকে গালবের হাতে তুলে দিচ্ছেন এবং এই পদ্ধতিকে স্বীকৃত মনে করছেন।
যৌতুকব্যবস্থার গোড়ায় যে দু’টি ‘ন্যায্য’ কারণ ছিল, সেগুলি এখন লোপ পেয়েছে। মেয়েরা ক্রমশ কাজের বাজারে যোগ দেওয়ায় আলাদা করে স্ত্রীধনের আবশ্যকতা লোপ পায়। উত্তরাধিকার আইন ১৯৫৬, সংশোধিত উত্তরাধিকার আইন ২০০৫ ও ২০১৫-তে মেয়েদের সমান উত্তরাধিকার বলবৎ হলে বিবাহের সময় উপহারের নামে মেয়েকে তাঁর অংশের সম্পত্তির ভাগটুকু আর আলাদা করে আগেভাগে দেওয়ার প্রয়োজনও পড়ে না। এ-সংসারে যা কিছু অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন, তা কালের নিয়মে আপনি বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা। যখন তা হয় না, তখন বুঝতে হবে যে, তা যুক্তি-ভিত্তির সীমানা ছাড়িয়ে সুযোগসন্ধানী হয়ে উঠেছে। যৌতুকব্যবস্থার ক্ষেত্রেও তা-ই হল। এ দেশে যৌতুক আইনত নিষিদ্ধ হল ১৯৬১ ও ১৯৮৫ সালে। কিন্তু যৌতুক নিষিদ্ধ হলেও বিয়েতে বাবা-মা তাঁদের মেয়েকে উপহার দেবেন, বিশ্বের কোনও আইন তাতে বাদ সাধতে পারে না। সেই ফাঁক গলেই যৌতুকব্যবস্থা কায়েম থাকল।
ইতিহাস বলবে যে, শুধু ভারত নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই যৌতুক প্রথার প্রচলন। রাজা হাম্মুরাবির সময়কালে ব্যাবিলনে, প্রাচীন গ্রিস, রোম, পর্তুগালেও এই ব্যবস্থার চল ছিল যথেষ্ট। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল আমাদের আজকের মুম্বই নগরী। ১৬৬১ সালে পর্তুগিজ রাজা চতুর্থ জন তাঁর কন্যা ক্যাথরিনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বিয়েতে যা যৌতুক হিসাবে দিয়েছিলেন। পার্থক্য এইটুকুই যে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যেখানে এই কুব্যবস্থা প্রায় বিলীন করে ফেলেছে, সেখানে এ দেশের তেষট্টি বছরের পুরনো যৌতুক নিষিদ্ধকারী আইন শাস্তি হিসাবে ন্যূনতম পাঁচ বছরের জেল ও আর্থিক জরিমানা চালু করেও তা রোধ করতে পারছে না। আজকের দিনে পৃথিবীর যে ক’টি অনুন্নত দেশে এই যৌতুকব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে, তার মধ্যে ভারত অন্যতম আর এই সংক্রান্ত নির্যাতন ও মৃত্যুহারে বিশ্বে প্রথম। এই সমাজে বিজ্ঞাপন হাসির ছলে যৌতুকের বৈধতা স্বীকার করবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!