Holi

অশুভ দহন, প্রীতি আবাহন

‘হোলিকাদহন’-এর মাধ্যমে সমস্ত অশুভ শক্তিকে নাশ করে তার পর আসে দোলের দিন। সন্ত্রাস, স্বৈরাচার, অন্ধভাব, এই সমস্তই তো অশুভ শক্তির পরিচায়ক-রূপ।

Advertisement

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২৩ ০৫:১০
Share:

দোলের ঠিক আগের দিন হোলিকাদহনের রীতি আছে। ফাইল ছবি।

এখন বসন্তকাল। কোকিলরা প্রস্তত। গাছে-গাছে দেখা দিয়েছে শিমুল আর পলাশ। বাতাস মৃদুমন্দ আর আকাশে দোল পূর্ণিমার চাঁদ। এ সবের মধ্যে মুশকিলে পড়েছে কেবল এক জন। কে? রং। তাও সব রং নয়, প্রধানত একটিই। বাকি রংগুলিও ভাবনা-চিন্তা করছে এ বার দোলখেলায় তাকে সঙ্গে নেবে কি না! নিলে যদি আপত্তি ওঠে? উঠতেও পারে! দীপিকা পাড়ুকোনের বিকিনি-তে সে রং বিতর্কের, অরিজিৎ সিংহের গানেও। সে রং গেরুয়া, যার উল্লেখমাত্রেই পক্ষ-বিপক্ষের রাজনীতি এখন ঝাঁপিয়ে পড়ে। গেরুয়া রঙের স্বাভাবিক রূপের মধ্যে কোথা থেকে যেন এসে হাজির হয় বিভিন্ন মানুষের ধার্মিক আস্থার পরিচয়-চিহ্ন। এ ভাবেই রং তার নিজস্ব ধর্ম হারায়, হয়ে ওঠে রাজনীতির সম্পত্তি। অথবা, এ ভাবেই রাজনীতির রং অধিকার করে নেয় আমাদের মনের পরিসরটুকুকে।

Advertisement

অথচ, এই ভূখণ্ডে বসন্তকালে সেই কবে থেকে মানুষ দোলের সময় এক অপরকে রং দিয়ে আসছে! খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মধ্যপ্রদেশের রামগড় গুহালিপিতে খুঁজে পাওয়া যায় হোলি খেলার বর্ণনা। নারদপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ, পদ্মপুরাণ-এও দোল উৎসবের কথা রয়েছে। সপ্তম শতাব্দীর একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, রাজা হর্ষবর্ধন পালন করতেন ‘হোলিকাউৎসব’। বাৎস্যায়নের কামসূত্র-তেও দোলের উল্লেখ আছে। সুলতান মহম্মদ-বিন-তুঘলক দোল খেলতেন হিন্দুদের সঙ্গে। আল-বেরুনির বিবরণে জানা যায় যে, মধ্যযুগে কোনও কোনও অঞ্চলে মুসলমানরা হোলির উৎসবে সংযুক্ত হতেন।

কৃষ্ণনগরে আমার প্রতিবেশী পাড়া কুর্চিপোতা-য় কয়েক ঘর মুসলিম বাস করেন। ছোটবেলায় দোলের দিন রঙের বালতি ও পিচকারি হাতে ও পাড়ার বন্ধুরা আসত রং খেলতে। আমরাও যেতাম। খেলা শেষে, রাস্তায়-রাস্তায় কিংবা বাড়ির দেওয়ালে যে রঙের দাগ সারা বছর লেগে থাকত, তা হিন্দুর না মুসলিম কিশোরের ছুড়ে দেওয়া রং— কেউ কখনও জানতেও চাইত না।

Advertisement

জানতাম শুধু এটুকুই যে, দোল বন্ধুত্বের দিন। আর ভারত কাহিনির দেশ! দিদিমার মুখে গল্প শুনেছি, বসন্তকালে পূর্ণিমার আলোয় যখন ভেসে যায় ব্রজধাম, তখন রাধা ও তাঁর সখী-গণের সঙ্গে রং খেলায় মেতে ওঠেন কৃষ্ণ। আবার বিভিন্ন পুরাণে এ-কথাও শোনা যায় যে, শ্যামবর্ণ হওয়ায় কৃষ্ণের খুব দুঃখ। অন্য দিকে, রাধা ও তাঁর সখীরা যথেষ্ট উজ্জ্বল বর্ণের অধিকারিণী। অসহায় কৃষ্ণ কী করবেন? যশোদা বললেন, রাধার শরীরে রং মাখিয়ে দাও। তা হলে তাঁর দেহবর্ণ আর বোঝা যাবে না। জ্ঞানদাসের ২৭৬ সংখ্যক পদে দেখতে পাই সেই রং খেলার আনন্দময় রূপ, “মধুবনে মাধব দোলত রঙ্গে/ ব্রজবনিতা ফাগু দেই শ্যামঅঙ্গে/ কানু ফাগু দেয়ল সুন্দরি-অঙ্গে” কিংবা “রাঙ্গা ফুলে রাঙ্গা ভ্রমর রাঙ্গা মধু খায়/ রাঙ্গা বায়ে রাঙ্গা হৈল কালিন্দীর পানি।”

বাকি দেশের তুলনায় বাংলার দোল উৎসব কিন্তু তত প্রাচীন নয়। সনাতন গোস্বামীর হরিভক্তিবিলাস-এ যদিও রং খেলার বেশ কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে, পদাবলির ক্ষেত্রে জ্ঞানদাসের পদেই সম্ভবত প্রথম আমরা রাধাকৃষ্ণের দোল উৎসবের বিবিধ বর্ণনা খুঁজে পাই। জ্ঞানদাসের ২৭৭ নং পদে দেখতে পাওয়া যায় কৃষ্ণ পিচকারিতে চন্দন, কুমকুম, চুয়া ভরে নিয়ে হোলি খেলছেন রাধা ও তাঁর সখীদের সঙ্গে। খেলতে-খেলতে হেরেও যাচ্ছেন কৃষ্ণ। জ্ঞানদাস তাঁর পদে শুধু রাধাকৃষ্ণকেই নয়, পক্ষী, বৃক্ষকুল, এমনকি সমস্ত ব্রজধামকেই বসন্তের মধুগুঞ্জরনে জাগিয়ে তুলেছেন। সব কিছুর মধ্যে একটিই অনুভব প্রধান হয়ে আছে, তা হল অন্যকে রং দেওয়ার আনন্দ! সেই আনন্দকেই গোবিন্দদাস তাঁর পদে বর্ণনা করছেন এ ভাবে, “আগু ফাগু দেই নাগরী নয়নে/ অবসরে নাগর চুম্বয়ে বয়নে।।”

দোলের ঠিক আগের দিন হোলিকাদহনের রীতি আছে। পুরাণ অনুয়ায়ী, হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন পিতার শত্রু বিষ্ণুর ভক্ত। হোলিকা, হিরণ্যকশিপুর বোন। হোলিকার একটি জাদুবস্ত্র ছিল, যা পরলে অগ্নিও তাঁকে স্পর্শ করতে পারত না। হিরণ্যকশিপুর আদেশে প্রহ্লাদকে নিজের কোলে বসিয়ে অগ্নিকুণ্ডে ঢোকেন হোলিকা। অগ্নিকুণ্ডে প্রহ্লাদ বিষ্ণুনাম জপ করতে থাকেন। জাদুবস্ত্র হোলিকার শরীর থেকে খুলে গিয়ে প্রহ্লাদকে রক্ষা করে, এবং হোলিকা আগুনে ছাই হয়ে যান। ‘হোলিকাদহন’-এর মাধ্যমে সমস্ত অশুভ শক্তিকে নাশ করে তার পর আসে দোলের দিন।

সন্ত্রাস, স্বৈরাচার, অন্ধভাব, এই সমস্তই তো অশুভ শক্তির পরিচায়ক-রূপ। সেই অশুভ শক্তির হোলিকাদহন একমাত্র আমাদের মনের ভিতরেই সম্ভব। আমাদের দেশের প্রতিটি নারীপুরুষই দোল উৎসবে রাধাকৃষ্ণের প্রতিমূর্তি।

রঙের যেমন ধর্ম হয় না, ঠিক তেমনই প্রেমের, বন্ধুত্বের, কাউকে ভাল লাগার কোনও ধর্ম নেই। এক বিরাট জনমানবহীন প্রান্তরে, মূল স্রোতের বাইরে যাঁরা দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সেই মানুষরা— সমকামী, একাকী, এই রঙের উৎসব তাঁদেরও। যে কিশোর বা কিশোরী দোলের দিন সকালবেলায় রং খেলবে বলে বেরোল— সেও যেন কোনও নির্দিষ্ট রংকে মুঠোয় তুলে নিতে ভয় না পায়, যেন দ্বিধা না করে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement