Same Sex Marriage

প্রশ্ন যখন ব্যক্তির অধিকারের

শীর্ষ আদালতের এই রায়গুলির মধ্যে সমকামী ও রূপান্তরকামী মানুষদের মর্যাদা ও অধিকারের স্বীকৃতি স্পষ্টতই অনুভব করা যায়।

Advertisement

ভাস্কর মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৩ ০৬:০৪
Share:

কেন্দ্রীয় সরকার সমকামী বিয়ের বিরোধিতা করছে। প্রতীকী ছবি।

ভারত সমকামী মানুষদের বিয়ের অধিকারকে স্বীকার করবে কি না, সুপ্রিম কোর্টে এখন তা নিয়ে বাদানুবাদ চলছে। কেন্দ্রীয় সরকার সমকামী বিয়ের বিরোধিতা করছে। ২০১৮ সালে যখন এই সুপ্রিম কোর্টে ৩৭৭ ধারাটির অবলুপ্তি ঘটে, তখন সমকামী, রূপান্তরকামী এবং নানাবিধ ভিন্ন যৌনচেতনার ব্যক্তিরা (এলজিবিটিকিউএআই) ‘অপরাধী’ তকমা থেকে মুক্তি পান। সেই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও বিরোধিতা করেনি। যদিও সেই সময়ে এলজিবিটিকিউএআই গোষ্ঠীর উপর হয়ে চলা সামাজিক দুর্নাম ও হেনস্থা (স্টিগমা) কমানোর জন্য নানা মাধ্যমে ক্রমাগত প্রচারের জন্য কেন্দ্রের প্রতি যে নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট, সরকার তা কার্যত উপেক্ষা করেছে। শুধু তা-ই নয়, ২০১৪ সালে ‘নালসা রায়’ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, ভারতের যে কোনও নাগরিক স্বেচ্ছায়, চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনও রকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজেকে ‘রূপান্তরকামী' ঘোষণা করতে পারবেন, এবং সামাজিক সব রকম সুবিধা পাবেন।

Advertisement

শীর্ষ আদালতের এই রায়গুলির মধ্যে সমকামী ও রূপান্তরকামী মানুষদের মর্যাদা ও অধিকারের স্বীকৃতি স্পষ্টতই অনুভব করা যায়। কেন্দ্রীয় সরকার সে-সবের তোয়াক্কা না করে ২০১৯ সালে যখন ‘ট্রান্সজেন্ডার অ্যাক্ট’ তৈরি করল, তখন চিকিৎসার সাহায্যে ‘পুরোপুরি’ রূপান্তরিত মানুষদের অগ্রাধিকার দিতে চাইল। বোঝা গেল, এই আইনপ্রণেতারা রূপান্তরকামী মানুষদের বিষয়ে সামান্যই খবর রাখেন। এখন সমকামীদের বিবাহের মামলায় কেন্দ্রই প্রধান বিবাদী। আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেছেন যে, বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র সম্পর্কের ব্যাপারে আদালত রায় দিতে পারে না। এর দায়িত্ব পুরোপুরি জনগণের, বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। মুশকিল হল, এই জনপ্রতিনিধিরা আজ অবধি সমকামী-বিয়ে নিয়ে সংসদে কোনও আলোচনার পরিসরই তৈরি করতে দেননি। শুধু তা-ই নয়, প্রাইভেট মেম্বার্স বিল পেশ করে যখনই কোনও সাংসদ এ বিষয়ে আলোচনা করতে উদ্যোগ করেছেন (শশী তারুর, সুপ্রিয়া সুলে কিংবা সেন্থিলকুমার এস, প্রমুখ) তখনই সংসদে তাঁদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অনেকে ভেবে নিচ্ছেন, সমকামীদের বিয়ে মেনে নিলে প্রচলিত আইনি বা ধর্মীয় বিবাহের উপর কোনও ভাবে হস্তক্ষেপ করা হবে। তা নয়। ভারতের তথাকথিত বিসমকামী মানুষেরা যে সব সুযোগ-সুবিধা বিয়ের জন্য পেয়ে থাকেন, সেগুলো সমকামী মানুষেরাও যেন পান, তার পক্ষেই সওয়াল করা হচ্ছে আদালতে। ভারতের সংবিধান প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের জন্য সব ক্ষেত্রেই সমতার কথা বলেছে, সেখানে সমকামীরা কেন বৈষম্যের শিকার হবেন?

Advertisement

সুপ্রিম কোর্ট প্রথম থেকেই বলেছে যে, তারা সমকামী বিবাহের বিষয়টি ভারতের ‘বিশেষ বিবাহ আইন’ মোতাবেক আলোচনা করবে। বাদী পক্ষও সেটা সমর্থন করেছে। ধরা যাক, দেশের সমকামী মানুষেরা বিয়ের অধিকার পেলেন। কিন্তু তার পর বিবাহ-বিচ্ছেদ, খোরপোশ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলির সমাধান কী করে হবে? ভারতীয় বিবাহ আইনে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এবং ইতিমধ্যেই পারিবারিক আইনের অন্তর্ভুক্ত, যা প্রধানত ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে নির্ধারিত হয়। কিরেন রিজিজু সংখ্যাগরিষ্ঠের বিচারের কথা বলছেন। সংখ্যাগুরুর মত সবার উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না বলেই ভারতে বিচারবিভাগের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এবং সমকামী মানুষের সংখ্যা যত কমই হোক না কেন (১৪০ কোটির দেশে কোনও সংখ্যাই যদিও ছোট নয়), তাঁদের ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকারকে কোনও ভাবেই খাটো করা চলে না।

এখনও অবধি সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে যে-সব যুক্তি এই সমকামী-বিবাহ বিষয়ে পেশ করা হয়েছে, তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সমকামীদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের অযৌক্তিক ভীতি এবং বিদ্বেষ কাজ করছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে ভারতের প্রত্যেকটি মানুষ যেমন এক, তেমনই যৌনচেতনা দিয়েও যে নাগরিকের মধ্যে বৈষম্য করা চলে না, এ কথা কেন্দ্রীয় সরকার মানতে চাইছে না। সরকার দাবি করছে, ভারতে এলজিবিটিকিউএআই গোষ্ঠীর প্রতি কোনও কলঙ্ক আরোপ করা হয় না। কার্যক্ষেত্রে কিন্তু অধিকারের প্রশ্নে, সমকামী সম্পর্ককে আইনের আওতায় আনার প্রশ্নে সরকারই সমকামী এবং ভিন্ন যৌনচেতনার মানুষদের প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টির পরিচয় দিচ্ছে। সমকামী সম্পর্ককে কখনও ভাই-বোনের মধ্যে যৌনসম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করছে, কখনও শিশুর দত্তক গ্রহণে এলজিবিটিকিউএআই ব্যক্তিদের অযোগ্য বলে ঘোষণা করছে। এ থেকে সরকারের প্রকৃত মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে।

প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় নিজেই বলেছেন, নারীত্ব বা পুরুষত্ব শুধু দেহগত লিঙ্গচিহ্নের বিষয় নয়, আরও গভীর ও জটিল বিষয়। তা সত্ত্বেও ‘নারী’, ‘পুরুষ’-এর সংজ্ঞা সরকার করতে চায় চিরাচরিত দৃষ্টিতে, যেখানে নারীত্ব আর পুরুষত্বকে বিরাট প্রাচীর দিয়ে ঘেরা দু’টি অলঙ্ঘনীয় এলাকা হিসাবে দেখা হয়। অতএব, এখনই এটা বোঝা যাচ্ছে যে, ভারতের সমকামী সমাজ বিয়ের অধিকার যদি পেয়েও যায়, তা হলেও তাদের অতিক্রম করতে হবে দুস্তর বিদ্বেষের পাহাড়। সমাজ ও সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই এত শীঘ্র সমাধা হবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement