সম্প্রতি ধারাবাহিক ভাবে একটি পুলিশি প্রক্রিয়ার যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু হয়েছে। তা নতুন নয়। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ শাসকের বহুব্যবহৃত এই প্রক্রিয়া উত্তরাধিকার সূত্রেই আত্মস্থ করেছে স্বাধীন দেশের শাসক। প্রক্রিয়াটি হল, মিথ্যা মামলা সাজিয়ে বিরোধীদের বন্দি করা। পরাধীন ভারতের ইতিহাসে এ ধরনের অনেক মামলা লিপিবদ্ধ আছে। যেমন, আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা, কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা, মেরঠ ষড়যন্ত্র মামলা ইত্যাদি। এমন মামলার সুবিধা হল, এক সঙ্গে বহু মানুষকে জড়িয়ে ফেলা যায়।
ইদানীং দেশের অতি-জাতীয়তাবাদী সরকার ব্রিটিশ শাসনপদ্ধতির অনুকরণ করে একের পর এক ষড়যন্ত্র মামলা করে চলেছে। ২০১৮ সালে ভীমা-কোরেগাঁও ষড়যন্ত্র মামলা, ২০২০ সালে দিল্লি দাঙ্গা ষড়যন্ত্র মামলা, এবং ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে বিশৃঙ্খলার ঘটনাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মামলা তৈরির প্রয়াস চলছে। অভিযুক্ত কারা? ৮৩ বছরের অসুস্থ সমাজকর্মী স্ট্যান স্বামী, ৮০ বছরের অসুস্থ কবি ভারাভারা রাও, ৭০ বছরের লেখক ও মানবাধিকার কর্মী গৌতম নওলখা, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সোমা সেন, আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, সুধা ভরদ্বাজ, উমর খলিদ, নাতাশা নারওয়াল, দেবাঙ্গনা কলিতা, দিশা রবি প্রমুখ। তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন শহর থেকে গ্রেফতার হওয়া এই প্রবীণ ও নবীন রাজনৈতিক ও সমাজকর্মীদের মধ্যে মিল একটাই। এঁরা কুশাসক ও কুশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখ। এঁরা শাসকের বশ্যতা স্বীকার করেননি।
২০১৪ থেকে আমাদের শাসকরা গণতন্ত্রের যে নতুন চেহারা মানুষের সামনে হাজির করেছেন, তাতে স্বাধীন মিডিয়া সংস্থা বা সেখানকার কর্মীরা সরাসরি শাসকের আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছেন। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ উঠছে। স্বতন্ত্র নিউজ় পোর্টালগুলিকে নানা ভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। ২৬ জানুয়ারি কিসান ট্র্যাক্টর কুচকাওয়াজ চলাকালীন এক কৃষকের মৃত্যুর ঘটনার টুইট প্রসঙ্গে একটি নিউজ় পোর্টালের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক সিদ্ধার্থ বরদারাজন, প্রতিবেদক ইসমত আরা, বিশিষ্ট সাংবাদিক মৃণাল পাণ্ডে, রাজদীপ সরদেশাই, বিনোদ জোস, জাফর আগা, পরেশ নাথ ও অনন্ত নাথের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়। পুলিশ অফিসারদের উপর হামলা এবং তাঁদের বাধা দেওয়ার অভিযোগে সাংবাদিক মনদীপ পুনিয়া গ্রেফতার হন। এর আগে, আর এক সাংবাদিক প্রশান্ত কানোজিয়া একটি টুইটের জন্য দু’মাস কারাগারে কাটিয়েছিলেন। হাথরসে সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়ার পথে কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় কুখ্যাত ইউএপিএ-র বিভিন্ন ধারা। তিনি চার মাস ধরে কারাগারে রয়েছেন।
এই রকমই এক অনলাইন নিউজ় পোর্টালের সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং লেখক গীতা হরিহরনের বাসভবনে তল্লাশি চালাল ইডি। তল্লাশি শুরু হয় ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে। প্রবীর পুরকায়স্থ এক জন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী, তাঁর সততা এবং সাহসের জন্য সুপরিচিত। জরুরি অবস্থার সময়ে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছিল বাম মনোভাবাপন্ন ছাত্র হওয়ার অপরাধে। গীতা হরিহরন নামকরা লেখক, ১৯৯৩ সালে প্রথম বই দ্য থাউজ়্যান্ড ফেসেজ় অব নাইট-এর জন্য ‘কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজ়’-জয়ী। ২০০৯ সালে কাজ শুরু করে তাঁরা দেশের মানুষের সমস্যা, প্রতিবাদ ও আন্দোলনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। ২০১৭-য় রাজস্থানের কৃষক আন্দোলন সম্পর্কিত খবর, ২০১৮-য় নাশিক থেকে মুম্বই অবধি ‘কিসান লং মার্চ’-এর বিবরণ এবং মোদী সরকার ও তার সাঙাত পুঁজিপতিদের মধ্যে গভীর সম্পর্কের বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণ-সহ প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ করেছেন তাঁরা। রাফাল চুক্তি নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে প্রশ্ন তুলেছেন। শ্রমিক শ্রেণি, শিক্ষার্থী, প্রান্তিক মানুষ ও বিরোধী কণ্ঠের উপর হামলা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপর হামলা-সহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের উপর রাষ্ট্রের প্রতিটি আক্রমণ তাঁরা তুলে ধরেছেন। তাঁদের সাম্প্রতিক বিবৃতি বলছে, “যাঁরা সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন এবং সমালোচনা করেন, তাঁদের সকলের বিরুদ্ধে সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করা বর্তমান সরকারের নিয়মিত অনুশীলন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে আয়কর বিভাগ, ইডি, সিবিআই এবং এনআইএ-র মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে বিভিন্ন অংশের লোকের বিরুদ্ধে— সাংবাদিক থেকে রাজনৈতিক নেতা, এমনকি কৃষকদের বিরুদ্ধেও— ব্যবহার করা হয়েছে।” সে কারণেই কি এ বার ইডি-র তল্লাশি?
আসলে, ‘নয়া’ ভারতে গণতন্ত্রের নতুন ভাষ্যে তিনিই সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক, যিনি প্রতি দিন উত্তর ভারতীয় রীতিতে শাসক দলের নেতাদের হাঁটু ছুঁয়ে সম্মান জানান। যদি কেউ দাসত্ব স্বীকার করে নিতে পারেন, তা হলে তিনিই শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক; নানা অভিযোগে কণ্টকিত হয়েও সরকারের শীর্ষব্যক্তিত্বের গুডবুকে থাকতে পারবেন। এটাই ভারতীয় গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের ‘নিউ নর্মাল’।