—ফাইল চিত্র।
গাজ়ার বিরুদ্ধে ইজ়রায়েলি যুদ্ধ ঘোষণার পর তিন মাস অতিক্রান্ত হল। ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল, হামাসকে ইজ়রায়েল নিশ্চিহ্ন করবে। গাজ়া ভূখণ্ড জনশূন্য করে দেওয়া হবে। এই তিন মাসে যুদ্ধে অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের মূল লক্ষ্য অধরা থেকে গেছে। হামাস নিশ্চিহ্ন হয়নি। গাজ়া জনশূন্য হয়নি। মরতে মরতেও গাজ়াবাসীরা গাজ়া ছেড়ে চলে যেতে সম্মত হননি। বরং হামাস নেতারা বলেছেন, গাজ়া সামায়িক ভাবে পরাস্ত হতে পারে, কিন্তু প্যালেস্টাইনের জনগণ থাকবে, প্যালেস্টাইন থাকবে। তাঁরা যোগ করেছেন, এই জন্য হামাসও থাকবে, হামাস একটা ধারণা।
এর নাম প্রতিরোধ। সমাজতত্ত্ববিদ এবং নৃতত্ত্ববিদরা বলেন, দুর্বলরা সোজাসুজি প্রতিরোধ করে না। নানা ছলচাতুরি, অভিনব উপায়ে প্রতিরোধ হতে থাকে। প্রতিরোধের চেহারা হয়ে দাঁড়ায় প্রহেলিকাময়। এই তর্কে গিয়ে লাভ নেই। এবং এটা তার অবকাশও নয়; কিন্তু চিন্তাবিদরা বার বার ভেবেছেন, বলা চলে, ভাবতে বাধ্য হয়েছেন, প্রতিরোধ কী? কী-ই বা তার স্বরূপ?
এক অমর দার্শনিক ঊনবিংশ শতাব্দীতে বলেছিলেন, একটা ধারণা বা মতাদর্শ যখন জনমানসকে অধিকার করে, তখন আর তা ধারণা বা মতাদর্শ থাকে না, তা হয়ে দাঁড়ায় এক বাস্তব শক্তি। জাতীয়তাবাদ, প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা, ইহুদিবাদী বর্ণ নিপীড়নের অবসান, এই তিন উপাদানের সংমিশ্রণে প্রতিরোধের যে ধারণা তৈরি হয়েছে এবং প্যালেস্টাইনের জনচিত্তজয় করেছে, তা এক অর্থে কালজয়ী। প্রায় পঁচাত্তর বছরব্যাপী এই প্রতিরোধ আমাদের ভাবাতে বাধ্য করে, প্রতিরোধের মর্ম কী? কী ভাবে এই প্রতিরোধ একই সঙ্গে দৈনন্দিন এবং ব্যতিক্রমী? প্রতিরোধী শক্তির সঙ্গে শান্তি করা যায়, সহাবস্থানের চুক্তিতে আসা যায়, কিন্তু তাকে কি পরাস্ত করা যায়? নিশ্চিহ্ন করা যায়? কী করবে রাষ্ট্র সেই শক্তিকে নিয়ে, যার প্রতিনিধিরা মরতে রাজি? যাদের জীবন হল অনেকটা সেই প্রাণী-রূপের মতো, যাকে ধরা যায়, কিন্তু আয়ত্তে আনা যায় না?
প্রতিরোধের ধারণা বা ভাবনা রাজনীতিতে অনেক উদ্ভাবন আনে। যেমন, সংগঠনের নমনীয়তা এবং এক বিস্ময়কর নম্রতা এবং সংযত মনোভাব। জাতীয় প্রতিরোধ, ধর্মীয় প্রতিরোধ, জনবাদী প্রতিরোধ— এই সব প্রতিরোধের যেন একটাই কথা: আমাদের নিজস্ব ভবিষ্যৎ আমাদের নির্ধারণ করতে দাও। স্বাধিকার ভিন্ন অন্য কোনও আকাঙ্ক্ষা আমাদের নেই। তোমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু আমাদের জীবন আমাদের ছেড়ে দাও। আমরা সামান্যই চেয়েছি। না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের দাবি থাকবে। আমরা তোমাদের হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসন প্রতিরোধ করব।
আধুনিক ইতিহাসে দেখা গেছে, ক্ষমতাধর শক্তি, রাষ্ট্রশক্তি, সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী— এরা বৈপ্লবিক, অর্থাৎ সমাজ-রূপান্তরকামী শক্তিকে পরাস্ত করতে পারে; কিন্তু প্রতিরোধকে স্থায়ী ভাবে পরাস্ত, অর্থাৎ নিশ্চিহ্ন করতে পারে না। কোন বামপন্থী ইতিহাসবিদ এই দুর্জ্ঞেয় রহস্যের উদ্ঘাটন করেছেন জানি না। সম্ভবত, এই রহস্য সমাধানের উপর নির্ভর করছে বিশ্বব্যাপী নয়া উদারনীতিবাদী প্রসারের যুগে সমাজ পরিবর্তনকামী কর্মসূচির ভবিষ্যৎ।
আর এক বার গাজ়ার উপর ইজ়রায়েলের আক্রমণের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী এখন বলছেন, হামাসকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে এবং এই যুদ্ধ সেই জন্য হবে দীর্ঘস্থায়ী। এর অর্থ, হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা নয়, গাজ়া ভূখণ্ডকে নিঃশেষ করা। আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞরা বলেন, এর নাম গণহত্যা। গণহত্যা বলা হবে সেই ব্যাপক হত্যালীলাকে, যার উদ্দেশ্য হল এক বিশেষ জাতি, ধর্মগোষ্ঠী, বর্ণ অথবা সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা। তাদের ভূখণ্ড থেকে তাদের বিতাড়িত করা, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি লোপাট করা। কাদের? যাদের বলা যায়, গৌণ জাতি, দুর্বলতর জাতি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ও যুদ্ধ চলাকালে জার্মানি ও অক্ষশক্তি, পূর্ব ইউরোপের ছোট ছোট জাতি, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার কর্মসূচি নিয়েছিল। এই ধ্বংসকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রমাণ যুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব ইউরোপেরই এক পলাতক আইনজ্ঞ রাফায়েল লেমকিন সংগ্রহ করেছিলেন এবং ন্যুরেমবার্গ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারালয়ে তা পেশ করার চেষ্টা করেন। তাঁর যুক্তি ছিল, অক্ষশক্তি ও নাৎসি জমানার অপরাধ প্রতি দিনের মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, এই অপরাধ এক বিশেষ অপরাধ। তার নাম গণহত্যা বা জেনোসাইড। ন্যুরেমবার্গ আদালত লেমকিনের সেই বক্তব্য মানেনি। কিন্তু, লেমকিনের বক্তব্য অল্প কিছু বছরের মধ্যে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের স্বীকৃতি পায়। পাশ হয়, গণহত্যার বিষয়ে ঘোষণাপত্র।
ক্ষুদ্র জাতি, ক্ষুদ্র দেশ, এক কথায় দুর্বলতর মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার প্রবণতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাইটহুড পরিত্যাগের চিঠিতেও উল্লেখ করেছিলেন এই বলে যে, দুর্বলতর জাতিকে ধ্বংস করার সামনে দাঁড়িয়ে আর কিছু করার না থাকলে, অন্তত সেই নিরাবরণ নিঃসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়।
প্রশ্ন হল, গণহত্যা ও গণপ্রতিরোধের মধ্যে সম্পর্ক কী? গাজ়ায় প্রতিরোধ প্রবল শক্তিধর, আগ্রাসী ইজ়রায়েলকে কী ভাবে উন্মত্ত করে তুলল? প্রতিরোধ কেন শক্তিধর রাষ্ট্রকে পাগল করে তোলে? তবে কি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সামাজিক-রাজনৈতিক রসদ এত কম যে, প্রতিরোধের শক্তির সঙ্গে তা কথাবার্তা চালাতে সক্ষম নয়? স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মতোই গণতন্ত্রও ভাবে যে, গণহত্যা চালিয়ে প্রতিরোধ নির্মূল করাই বাঁচার একমাত্র পথ?
গণতন্ত্র, গণহত্যা, প্রতিরোধ— এই তিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে সমাজ পরিবর্তনকামী শক্তিকে ভাবতে হবে, সামাজিক রূপান্তরের পথ কী? যুদ্ধ এবং শান্তির প্রশ্ন আমাদের সামগ্রিক জীবনের সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। প্রতিরোধ ছাড়া গণতন্ত্রের এই চরম সীমাবদ্ধতা উন্মোচিত হত না। তাই প্রশ্ন হল, প্রতিরোধের স্বরূপ কী? প্রতিরোধের ধারণা কী ভাবে এক বাস্তব শক্তি হয়ে ওঠে।
প্রতিরোধ নিত্য। প্রতিরোধই বর্তমান, আমাদের অতীতও হল প্রতিরোধের আখ্যান। কিন্তু এর মধ্যে কি ভবিষ্যতের কোনও রূপরেখা থাকে? ভবিষ্যতের আদর্শ বা অন্তত এক কল্পকাহিনি? উত্তর হল, স্বল্প ক্ষেত্রে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না। প্রতিরোধ হল জনসাধারণের চৈতন্য বা বলা চলে, প্রতিরোধের উৎস সাধারণ বুদ্ধি বা সাধারণ বোধ। সাধারণীকৃত বোধ এবং চেতনা। সমাজ পরিবর্তনকামী কর্মসূচি ভবিষ্যৎকে আশু সময়ের বর্তমান কালের অঙ্গ করে নেয়। যদিও সেই কর্মসূচি কালের এই বিভাজনকে অতিক্রম করতে চায় হিসাব করে, বেহিসাবি ভাবে নয়।
তবুও মনে রাখা দরকার, প্রতিরোধের কালচেতনা ও সমাজ-রূপান্তরকামী কালচেতনার পার্থক্য অনেকটা কেতাবি। প্রতিরোধের সংঘর্ষভূমি থেকে ভবিষ্যৎমুখী চৈতন্যও জন্ম নেয়। অনেক সময়, প্রতিরোধের যুক্তি বধ্যভূমির বাস্তবতার ভিতর থেকে নতুন চিন্তার অবকাশ সৃষ্টি করে।
ফিরে চলুন আবার গাজ়ার কথায়। কেন প্রতিরোধের ধারণা গাজ়া ভূখণ্ডের জনমানসকে উদ্বেলিত করল? একটাই উত্তর। গাজ়ায় প্রতিরোধ আইন অমান্যের পৃথিবীতে প্রবেশ করেছিল, যেটা কারাবাসীদের কারা-বিদ্রোহের কথা স্মরণ করায়। আইন অমান্য প্রতিষ্ঠিত সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক অর্থে বলা চলে— শেষ সীমান্ত। আমাদের জাতীয় আন্দোলনে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আইন অমান্য সেই ভূমিকা পালন করেছিল, যার নাম দেওয়া চলে সর্বাত্মক প্রতিরোধ। আইনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অর্থ সর্বাত্মক প্রতিরোধ।
আইন অমান্যের রণক্ষেত্র নিয়ে যুদ্ধবিশেষজ্ঞরা কম ভেবেছেন। সর্বাত্মক অসহযোগিতা, আইনের সঙ্গে অসহযোগিতা হল এক কথায় সামাজিক যুদ্ধ ঘোষণা। এর তাৎপর্য সামগ্রিক ভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং যুদ্ধনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলে?
দুর্ভাগ্য যে, এই গূঢ় আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। কিন্তু, আইন অমান্য কর্মসূচি প্রতিরোধকেও বাধ্য করে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে। এই আইন বা আইনব্যবস্থা না মানলে আমরা এর বিপরীতে কী চাই? ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়ে গাজ়াবাসী কী ভাবছেন? কী তাঁদের ভাবনা, আমরা কি তা জানি?
সংহতি, পারস্পরিক সহযোগিতা, বিভিন্ন ভেদাভেদকে কী ভাবে সামলে রাখা যায়— সবই দেখা যায় অবরুদ্ধ এলাকায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত জনজীবনে। নতুন জীবনরূপের ইঙ্গিত পাওয়া যায় প্রতিরোধরত জনমণ্ডলীর জীবনচর্যায়। প্যালেস্টাইনি সংবাদে, চিঠিপত্রে, ছোট, স্বল্প সময়ের ছবিগুলিতে। গাজ়াতেও আনা ফ্র্যাঙ্ক আছেন, যাঁরা তাঁদের ভাবনা লিপিবদ্ধ করে চলেছেন।
তবু, প্রতিরোধ থেকে উৎসারিত বিকল্প ভাবনার সীমা থেকে যায়। যুদ্ধের মাঝে কতটুকুই বা ভবিষ্যতের কথা ভাবা যায়? বিকল্প পথ, সমাজ-রূপান্তরের সংগ্রাম চলতে থাকে এই প্রতিরোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে, তবু তার স্বাতন্ত্র্য থেকে যায়, তা প্রতিরোধকে সমাজ-রূপান্তরের পথে এগোতে সাহায্য করে। আজকের নয়া উদারনীতিবাদী কালে সম্পদের আহরণ, শোষণ, জল, খনিজ পদার্থ, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য শক্তিধরের যুদ্ধ ঘোষণা বেড়ে চলেছে। আক্রান্ত শক্তিকে ভাবতে হচ্ছে, সম্পদের এই কাড়াকাড়ি ও শোষণের বিকল্প কী? ন্যায় কোন পথে নিশ্চিত হবে?
মহাভারতের যুদ্ধ শেষে মৃত্যুশয্যায় শায়িত ভীষ্ম, যুধিষ্ঠিরদের নতুন কোনও যুদ্ধের কথা বলেননি। শক্তি কী করে বাড়ানো যায়, এই উপদেশ দেননি। বলেছিলেন, ন্যায়সম্মত শাসনের কথা। সুশাসন কী সে সম্পর্কিত উপদেশ।
যুদ্ধকে অতীতে পর্যবসিত করে ন্যায় স্থাপন হল ভবিষ্যৎ। শান্তিকে ভবিষ্যৎ হয়ে উঠতে হবে। তখন আর প্রতিরোধের প্রয়োজন পড়বে না। যুদ্ধের স্থান নেবে সংলাপ! যুদ্ধ নয়, দ্বন্দ্বমূলক সংলাপ।