অতিমারি আক্রান্ত এই সময়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন মুর্শিদাবাদ জেলার ছাত্রী রুমানা সুলতানা (ছবিতে)। আনন্দের এই সংবাদ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কারণ, ফল ঘোষণার সময় উচ্চ মাধ্যমিক সংসদ সভাপতি ঘোষণা করেন— এ বছর উচ্চ মাধ্যমিকে একক সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন এক জন ‘মুসলিম কন্যা’, ‘মুসলিম লেডি’, ‘মুসলিম গার্ল’। তাঁর ঘোষণায় তিন বার উচ্চারিত হয়েছে রুমানার ধর্মীয় পরিচয়। অভিযোগ উঠেছে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে অপরায়ণের।
অভিযোগটিকে অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না; এই ব্যাধি তো বহু পুরনো। মীর মশাররফ হোসেনের প্রশংসা করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই কবে বঙ্গদর্শন-এর পাতায় লিখেছেন, “তাহার রচনার ন্যায় বিশুদ্ধ বাংলা অনেক হিন্দুও লিখিতে পারে না।” জসীমউদ্দিনকে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ছাড়তে হয়েছে, কারণ তিনি যথার্থ ‘উদারপ্রাণ মুসলমান’-এর মতো হিন্দু মহাসভার এক প্রচারকের বক্তৃতার সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি। উদাহরণ অজস্র, এবং নিত্যদিন তা আমাদের সহাবস্থানকে ক্ষত-বিক্ষত করে। অপরায়ণের এই অভিযোগের প্রত্যুত্তরে বলা হচ্ছে যে, মুসলিম সমাজ সম্পর্কিত নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশনে যে ভাবে বারংবার ধর্মীয় পরিচয়কে তুলে ধরা হয়, সেই প্রেক্ষিতে রুমানার এই কৃতিত্বের কথা বলতে গিয়ে তার সম্প্রদায়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন। কোথাও আবার জোর আলোচনা চলছে রুমানা ও তার পরিবার কতটা যথার্থ মুসলমান, সেটি নিয়ে। কারণ, সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার সময় রুমানার পোশাক নাকি ঠিক ইসলাম-সম্মত হয়নি। সব মিলিয়ে সংবাদমাধ্যম এবং আন্তর্জাল-নির্ভর চণ্ডীমণ্ডপগুলি সরগরম। এই সব তর্ক-বিতর্কের মাঝে হারিয়ে যেতে বসেছে রাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নয়নের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়, যা কিনা উচ্চ মাধ্যমিক সংসদ সভাপতির কথাগুলির মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
প্রথমত, ব্যক্তিগত মেধার প্রশ্ন সরিয়ে রেখে যদি শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিম মেয়েদের অংশগ্রহণের পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া যায়, তবে বোঝা যায় রুমানার এই সাফল্য অপ্রত্যাশিত নয়। ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিক্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন, ২০১৯-২০’র তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরে মুসলিম ছেলে এবং মেয়েদের ভর্তি হওয়ার হার যথাক্রমে ২০.৩৯% এবং ৩৩%; উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সেই হার যথাক্রমে ২০.৩৫% এবং ২৭.০১%। শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিম মেয়েদের এই আশাব্যঞ্জক অংশগ্রহণ স্পষ্ট হয় মুসলিম সমাজের অভ্যন্তর থেকে উঠে আসা আল-আমীন মিশন-এর মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রচারপুস্তিকা দেখলেও।
কিন্তু এর উল্টো পিঠে রয়েছে আর একটি ছবি। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার পঞ্চম দফার তথ্য অনুযায়ী, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ জেলা, যেখান থেকে উঠে এসেছে রুমানার সাফল্য, সেখানে মেয়েদের মধ্যে বাল্যবিবাহের হার ৫৫.৪%; ২০১৫-১৬ সালে সেটি ছিল ৫৩.৫%। অন্য কয়েকটি মুসলিম-অধ্যুষিত জেলার— যেমন মালদহ এবং বীরভূম— পরিসংখ্যানও ভীতিপ্রদ, যথাক্রমে ৪৯.১% ও ৪৯.৯%। শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিম মেয়েদের আশাব্যঞ্জক অংশগ্রহণ এবং বাল্যবিবাহ— এই দুই বিপরীতের সহাবস্থান কি জটিলতর ব্যাধির দিকে ইঙ্গিত করে না? বিদ্যালাভ অন্তে কর্মের সুযোগ না থাকার দরুন মেয়েদের পড়াশোনা কি কেবলমাত্র সুপাত্রী হিসেবে পরিগণিত হওয়ার পন্থা হিসেবেই সীমিত থাকছে? শিক্ষা যদি এই মেয়েদের মনন এবং চিন্তনের প্রসারের সঙ্গে জীবিকা অর্জনের পথ না খুলে দেয়, তা হলে তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে কী ভাবে? উপযুক্ত পেশা নির্বাচনের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের সুযোগ— এর অভাবের সঙ্গে জুড়ে আছে আর একটি প্রশ্ন।
শিক্ষায় মুসলিম মেয়েদের অংশগ্রহণ এবং সাফল্য যখন আমাদের আশ্বস্ত করছে, তখন চিন্তিত করছে শিক্ষাঙ্গনে মুসলিম ছেলেদের ক্রমহ্রাসমান উপস্থিতি। অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ, গাইডেন্স গিল্ড এবং প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এর ২০১৬ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার হার মুসলিম ছেলে (৮৪.৬%) ও মেয়ে (৮৬.৪%), উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রায় সমান। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা শেষে স্কুলছুটের হার মেয়েদের (৪৩.৮%) চেয়ে ছেলেদের (৪৯.৬%) অনেকটাই বেশি। আর্থ-সামাজিক অবস্থানের পাশাপাশি সন্তানের শিক্ষা ও পেশা সম্পর্কে পিতামাতার ধারণা ও আকাঙ্ক্ষা এই স্কুলছুটের কারণ হতে পারে।
বিশ্বভারতীর স্কোপ অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস অব প্রাইমারি এডুকেশন অ্যামং মুসলিম কমিউনিটি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল (২০১৯) শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকল্পে মুসলিম পিতামাতাদের প্রশ্ন করা হয় যে, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের কত দূর পর্যন্ত পড়াতে চান। ১০% পিতামাতা চান ছেলে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করুক এবং ১৪.৪% পিতামাতা তাঁদের মেয়ের জন্য সেই আশা পোষণ করেন। স্নাতক স্তরের ক্ষেত্রে সেটি যথাক্রমে ৩.৮% এবং ৬.৯%। কিন্তু দশম শ্রেণি পর্যন্ত এই হিসাব প্রায় সমান। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, দশম শ্রেণির পর দরিদ্র মুসলমান পিতামাতা আশা করেন ছেলেরা লেখাপড়া ছেড়ে রোজগারের পথ খুঁজে নেবে। কিন্তু এই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে তারা কী ধরনের কাজ জোগাড় করতে পারবে? হয় তারা চাষবাসের কাজে হাত লাগাবে, দিনমজুরের কাজ করবে, শহরের দিকে হয়তো বা মিস্ত্রির কাজ জুটিয়ে নেবে। অন্যথায় পাড়ি দেবে অন্য রাজ্যে, রাজমিস্ত্রির সাহায্যকারী হতে, জরির কাজ করতে বা ফেলে দেওয়া চুলের কারবার করতে। ফলে, দরিদ্র মুসলিম পরিবারের ছেলেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম কায়িক শ্রম এবং স্বল্প মজুরির এই সব পেশাকে আঁকড়ে ধরে থাকবে। বৌদ্ধিক, কায়িক পরিশ্রমহীন এবং বেশি পারিশ্রমিকের পেশাগুলি অন্যদের কুক্ষিগত হয়ে থাকবে। এও কি এক ধরনের আধিপত্যবাদ নয়? কল্যাণকামী রাষ্ট্রকে এই নিয়ে প্রশ্ন করার দায় তো সমাজের। কিন্তু সমাজ এখন এই সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে চোখ সরিয়ে নানাবিধ তরজায় ব্যস্ত।
তাই, রুমানাকে জানানো জরুরি যে, আমরা এখনও চণ্ডীমণ্ডপের সীমানা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারিনি। আমরা দেখতে পাইনি— ‘বান ডেকেছে’, ‘জোয়ার-জলে’ প্রবল ঢেউ উঠছে।
কিন্তু রুমানাদের সামনে জয় করার জন্য রয়েছে সম্পূর্ণ আকাশ। তারা ‘জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে/ প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে’ দেবে। সেই আশা করি।