সুপ্রিম কোর্ট। ফাইল ছবি।
দেশের আইনমন্ত্রী তখন পুঞ্জলা শিব শঙ্কর। ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের দোর্দণ্ডপ্রতাপ এই মন্ত্রী আচমকাই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নির্দেশিকা পাঠালেন। কেন্দ্রীয় সরকার নিজের ইচ্ছেমতো হাই কোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতিদের অন্য হাই কোর্টে স্থায়ী বিচারপতি হিসাবে বদলি করবে। সে ব্যাপারে বিচারপতিদের আগাম সম্মতি আদায় করতে হবে।
বিচারপতিদের বদলি করতে হলে কেন্দ্রীয় সরকারকে আগে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতিদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে হয়। তাঁদের সম্মতি নিতে হয়। আইনমন্ত্রী পুরো ক্ষমতাটাই সরকারের হাতে তুলে নিতে চাইছিলেন। একেবারে সরাসরি বিচারবিভাগের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ!
চার দশক আগের কথা। ১৯৮১ সালের ঘটনা। আইনমন্ত্রীর এই নির্দেশিকা নিয়ে সংসদে ঝড় উঠল। বিরোধীদের অভিযোগ, ইন্দিরা সরকার আসলে জনতা-লোক দল সরকারের নিযুক্ত বিচারপতিদের ছেঁটে ফেলতে চাইছে। এমন জায়গায় তাঁদের বদলি করতে চাইছে যাতে তাঁরা নিজেরাই বিচারপতির পদ ছেড়ে দেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি যশবন্ত বিষ্ণু চন্দ্রচূড় তীব্র প্রতিবাদ জানালেন। আইনমন্ত্রীকে চিঠি লিখে স্পষ্ট ভাষায় জানালেন, কেন্দ্রীয় সরকার কোনও ভাবেই হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতিদের সম্মতি ছাড়া কাউকে বদলি করতে পারে না।
সে দিনের প্রধান বিচারপতি যশবন্ত বিষ্ণু চন্দ্রচূড়ের পুত্র ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড় এখন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। তিনি পদে বসতে না বসতেই নরেন্দ্র মোদী সরকারের আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু বিচারবিভাগকে নিশানা করা শুরু করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের কলেজিয়াম ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাঁর প্রশ্ন, কেন বিচারপতিরাই বিচারপতিদের নিয়োগ করবেন, কেন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কোনও ক্ষমতা থাকবে না!
মজার বিষয় হল, বিচারপতি নিয়োগের নতুন ব্যবস্থা কী হতে পারে বা বর্তমান ব্যবস্থাটা কী ভাবে আরও ভাল করা যায়, তা নিয়ে আইনমন্ত্রী কিছু বলছেন না। শুধুই সমালোচনা করছেন। পাল্টা আক্রমণে গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টও। প্রকাশ্য আদালতেই শীর্ষ আদালতের বিচারপতিরা আইনমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেছেন।
দেশের সংবিধানে সরকার, আইনসভা, বিচারবিভাগ প্রত্যেকেই নিজের জায়গায় শেষ কথা। সরকার আদালতের কাজে বা আদালত সরকারের কাজে নাক গলাতে গেলে সংঘাত বাধবে। সেটা সুস্থ গণতন্ত্র ও বিচারবিভাগের স্বাধীনতার উদাহরণ। আইনমন্ত্রী বিচারবিভাগের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। তবে প্রকাশ্যে সমালোচনার আগে তিনি বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারতেন। কী ভাবে বিচারপতি নিয়োগের ব্যবস্থাটা আরও ভাল করা যায়, তা নিয়ে কথা বলতে পারতেন। সে পথে না গিয়ে সরাসরি আক্রমণ শুরু করায় প্রশ্ন উঠছে, মোদী সরকার কি বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইছে? সরকারের অনুগত ব্যক্তিদের দিয়ে হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট ভরে তুলতে চাইছে? না কি তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে চাইছে?
মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেই জাতীয় বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন আইন তৈরি করেছিল। সংসদে পাশ হওয়া সেই আইনে বলা ছিল, বিচারপতি নিয়োগ কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি-সহ তিন প্রবীণতম বিচারপতির সঙ্গে কেন্দ্রের আইনমন্ত্রী ও দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকবেন। সুপ্রিম কোর্ট তা অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দেয়। প্রয়াত অরুণ জেটলি তার নিন্দায় বলেছিলেন, এ হল ‘টির্যানি অব দি আন-ইলেক্টেড’। মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকার, সাংসদদের তৈরি আইনকে এমন কিছু বিচারপতি ক্ষমতার জোরে খারিজ করলেন যাঁরা মানুষের দ্বারা নির্বাচিত নন। নতুন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ও একই সুরে সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করেছেন, জনতার নির্বাচিত সংসদের সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন।
কোনও আইন সাংবিধানিক ব্যবস্থা বা সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থী হলে তা খারিজ করে দেওয়ার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে। সংবিধানেই সেই ক্ষমতা প্রদত্ত। প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ক্ষমতায় এসেই সংবিধান সংশোধন করেছিলেন, যাতে জমিদারি প্রথা বিলোপ, শিল্পের জাতীয়করণ, অনগ্রসর শ্রেণির জন্য বিশেষ ব্যবস্থার মতো সামাজিক সংস্কারে সুপ্রিম কোর্ট বাধা না হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে তাঁর মত ছিল, নির্বাচিত সরকার ভুল করে সংবিধানের বিরুদ্ধাচরণ করছে কি না তা দেখা আদালতের কাজ।
প্রশ্ন হল, সাত বছর আগে বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন আইন খারিজ হয়ে গিয়েছে। আচমকা এখন তা নিয়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আদালতকে দোষারোপ করা শুরু করেছেন কেন?
এমন নয় যে বিচারপতি নিয়োগে এখন কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কোনও ভূমিকা নেই। হাই কোর্টে বা সুপ্রিম কোর্টে কাউকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করার সময় কেন্দ্র বা রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে বিচারপতিদের মত বিনিময় হয়। সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম কারও নাম সুপারিশ করলেও কেন্দ্রীয় সরকার তাতে আপত্তি তুলতে পারে। তবে শেষ কথা বলার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের নেই। এই প্রক্রিয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ও সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের মধ্যে সমঝোতা রয়েছে, তার নাম ‘মেমোরান্ডাম অব প্রসিডিয়োর’। আর সেখানেই বোধ হয় প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে।
বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন আইন খারিজ হয়ে যাওয়ার পরে মোদী সরকার ওই প্রক্রিয়ার সমঝোতায় কিছু রদবদল করে তার খসড়া সুপ্রিম কোর্টের কাছে পাঠিয়েছিল। বেশ কয়েক বার মত বিনিময় হয়। শেষে ২০১৭-তে সুপ্রিম কোর্ট নিজের চূড়ান্ত মত জানিয়ে দেয়। সরকারকে সেটাই মেনে নিতে হয়েছে। মোদী সরকার আসলে তা মেনে নেয়নি। সম্প্রতি আইন মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বলেছে, সাত বছরেও এই প্রক্রিয়া নিয়ে সমঝোতা বা ‘মেমোরান্ডাম অব প্রসিডিয়োর’ চূড়ান্ত হয়নি। আর সুপ্রিম কোর্টের মত মানতে পারেনি বলেই মোদী সরকার বার বার শীর্ষ আদালতকে মনে করিয়েছে, ওই প্রক্রিয়ায় কিছু সংশোধন দরকার।
২০১৭-তে সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলার রায় ঘোষণার সময় সাত বিচারপতির বেঞ্চের মধ্যে দুই বিচারপতি মত দিয়েছিলেন, ওই প্রক্রিয়ায় কিছুটা সংশোধন দরকার। মোদী সরকার বার বার ওই দুই বিচারপতির মতকে হাতিয়ার করেছে। বার বার সুপ্রিম কোর্টকে সে কথা মনে করিয়েছে। কারা ওই দুই বিচারপতি? প্রথম জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জে চেলমেশ্বর। যিনি বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন আইন খারিজ করে দেওয়া রায়ের সঙ্গে একমত হননি। দ্বিতীয় জন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। অবসরের পরে যাঁকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত সাংসদ হিসেবে রাজ্যসভায় পাঠানো হয়েছে।
অরুণ জেটলি বলেছিলেন, অবসরের পরেই বিচারপতিদের সরকারি পদে বসানো হতে থাকলে অবসরের আগে রায়ে তার প্রভাব পড়ে। গত আট বছরে মোদী সরকার একাধিক ক্ষেত্রে বিচারপতিদের অবসরের পরেই তাঁদের সরকারি পদে বসিয়েছে। সম্প্রতি বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তকে অবসরের পরেই নয়াদিল্লি আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। উল্টো দিকে একাধিক আইনজীবী বা হাই কোর্টের বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগের সুপারিশে আপত্তি বা টালবাহানা করেছে। কেন আপত্তি, তার সরকারি ব্যাখ্যা মেলেনি। তবে দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই বিচারপতিরা বর্তমান সরকারের শীর্ষব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অতীতে রায় দিয়েছিলেন। আইনজীবী গোপাল সুব্রহ্মণ্যমকে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশ নিয়ে টালবাহানা থেকে এর সূচনা। সুব্রহ্মণ্যম গুজরাতের সোহরাবুদ্দিন ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় আদালত-মিত্র ছিলেন। সরকারের পক্ষে স্পর্শকাতর মামলা বিশেষ কিছু বিচারপতির বেঞ্চে পাঠানো নিয়েও প্রতিবাদ হয়েছে।
আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, ফের বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন আইন তৈরির করার পরিকল্পনা মোদী সরকারের নেই। কিন্তু বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ায় বোধ হয় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা আর একটু বাড়াতে চাইছেন তিনি। বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে যাওয়াটা আসলে তারই পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করার চেষ্টা।