দূরত্ব: স্পর্শ এড়িয়ে জল দেওয়া হচ্ছে এক দলিত ব্যক্তিকে। মধ্যপ্রদেশ, ২০১৬।
দুনিয়ার কোনও ধর্মেরই ভিত্তিস্তম্ভটি বৈষম্যমূলক নয়— বিশেষ করে বিশ্বাসীদের মধ্যে তো নয়ই— ব্যতিক্রম শুধু হিন্দুধর্মের জাতিপ্রথা। অন্তত তিন সহস্রাব্দ প্রাচীন মনুসংহিতা-য় বিধৃত সেই বৈষম্যনীতি অনুসারে, ব্রহ্মার দেহ থেকে নির্গত বর্ণ চারটি— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। সবই কর্মভিত্তিক হলেও তারা কিন্তু সমান্তরাল নয়, বরং উল্লম্বাকার। কালক্রমে বর্ণ থেকে গড়ে উঠল অসংখ্য জাতি— সমাজতাত্ত্বিকরা বলেন প্রায় তিন হাজার; এবং তাদের আরও অনেক গোষ্ঠী— প্রায় ২৫ হাজার। রাজনৈতিক শক্তি মোগলের বা ইংরেজের হাতে থাকলেও উচ্চবর্ণের, বিশেষত ব্রাহ্মণের হাতে রইল নিষ্পেষণের শক্তি। নিম্নবর্গকে নিষ্পেষণ। শূদ্রেরও নীচে ঠেলে দেওয়া যে মানুষরা ছিলেন ‘অস্পৃশ্য’, পরে তাঁরা নামান্তরিত হয়ে হলেন ‘দলিত’। কিন্তু নামান্তর অর্থ অবস্থান্তর নয়। স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর কেটে গেলেও বিভিন্ন জাতির মধ্যে— বিশেষ করে তথাকথিত উচ্চবর্ণ ও দলিতদের মধ্যে— না আছে বিবাহ সম্পর্ক, না সামাজিক। স্বাধীন ভারতেও দেশের কর্তৃত্ব প্রায় পুরোপুরি উচ্চবর্ণের হাতে। বর্তমানে ৮৯ জন উচ্চতম সরকারি আমলার মধ্যে মাত্র চার জন অন্যান্য বর্ণভুক্ত— বাকিরা উচ্চবর্ণের, অনেকেই ব্রাহ্মণ, জনসংখ্যায় যে জাতির অনুপাত মাত্র ৪ শতাংশ। দেশের শীর্ষ আদালতের বিচারপতিদের মধ্যে ব্রাহ্মণ জাতিভুক্তদের অনুপাত কখনওই ৩০ শতাংশের নীচে হয়নি, এবং প্রায়শই তা ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। পাঁচটি প্রধানতম আইআইটির শিক্ষকদের মধ্যে উচ্চবর্ণের অনুপাত ৯৮ শতাংশ। এই তথ্য সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নেচার পত্রিকায়।
১৯৪৭-এর আগে ইংরেজ প্রভু ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি, শুধু সতীদাহ প্রভৃতি কয়েকটি অত্যন্ত দৃষ্টিকটু রীতি ছাড়া। অন্য কোনও দেশও এই বিষয়টি নিয়ে বিশেষ ভাবিত ছিল না। এখন কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। সেই পরিবর্তনের এক বড় প্রমাণ দেখা গেল সম্প্রতি আমেরিকায় প্রশান্ত মহাসাগরের তটবর্তী সিয়াটল শহরে। তার সিটি কাউন্সিলে ৬-১ ভোটে পাশ হয়ে গেল যে প্রস্তাবটি, তার মূল কথা হল— এই শহরের ভারতীয় অভিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত ‘জাতিপ্রথা’ এখন থেকে আমেরিকান ফেডারাল আইনে যা ‘বৈষম্যমূলক আচরণ’, তার মধ্যে গণ্য হবে। আমেরিকায় যা বৈষম্যমূলক আচরণের তালিকাভুক্ত তা হল— ‘রেস’ (জাতি পরিচয়, যেমন কৃষ্ণাঙ্গরা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত), ‘কালার’ (গাত্রবর্ণ) এবং ‘জেন্ডার’ (লিঙ্গবৈষম্য)। তা ছাড়া সে দেশের আইনে সুরক্ষা আছে কর্মস্থলে ধর্মীয় বৈষম্য থেকেও। কিন্তু সিয়াটল সিটি কাউন্সিলে এক নির্বাচিত সদস্য ক্ষমা সাওয়ন্তের প্রস্তাবিত বিলটির বৈশিষ্ট্য হল বৈষম্যমূলক আচরণের তালিকায় ভারতীয় জাতিপ্রথার অন্তর্ভুক্তি। পঞ্চাশ বছর বয়স্ক মরাঠা মহিলা কাউন্সিল সদস্য ক্ষমা বলেন, ভারত থেকে আগত প্রযুক্তিবিদ অভিবাসীদের মধ্যে জাতিভিত্তিক বৈষম্য দেখে তিনি শিউরে উঠেছিলেন।
সিয়াটল গুরুত্বপূর্ণ শহর, মাইক্রোসফট ও অ্যামাজ়নের মতো উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন ব্যবসার আস্তানা। সেখানে ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। সে দেশে নাগরিক আইনের আওতায় বৈষম্য হিসাবে ভারতীয় জাতিপ্রথার অন্তর্ভুক্তি থেকে বোঝা যায়, এই প্রথার বিপদঘণ্টা সে দেশেও বেজেছে। মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, এই জাত্যভিমানী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ‘মনুর বিধান’-এর বিপজ্জনক কুফল সম্পর্কে পৃথিবীকে অবহিত করেছিলেন ভীমরাও রামজি অম্বেডকর, অনবদ্য যুক্তিনিষ্ঠ ভাষায় তাঁর অসংখ্য লেখার মাধ্যমে। সিয়াটল সিটি কাউন্সিলে জাতিপ্রথা বিরোধী আইন পাশ হতেই নাকি টেবিল চাপড়ানোর পাশাপাশি শোনা গেল হর্ষধ্বনি: ‘জয় ভীম’! আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত ও সাম্যের পূজারি সেই মানুষটি নিশ্চয়ই উপভোগ করতেন মুহূর্তটি।
তাঁর খুশি হওয়ার আরও কারণ আছে। হিন্দু জাতিপ্রথা সম্পর্কে উন্নত দেশগুলিতে বিরক্তি এখন বড় আকার নিচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ আগে কানাডার টরন্টো শহরের ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ড নির্বাচনের মাধ্যমে ওই একই রকমের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যার ফলে ‘জাতিবৈষম্য’র ঘটনা প্রমাণিত হলেই তা আদালতের দৃষ্টিতে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের আওতাভুক্ত হয়। ডিস্ট্রিক্ট স্কুল বোর্ডের এই ভোটাভুটিতে পক্ষে ১৬ ভোট পড়লেও বিপক্ষে পড়ে পাঁচ।
উদ্যোগী ও কর্মঠ বলে উদ্যোগপতি মহলে পরিচিত হিন্দু অভিবাসীদের সম্পর্কে সম্প্রদায় হিসেবে ধারণা কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে জাতিপ্রথার জন্য। আইনব্যবস্থা যদি হয় দেশবাসীর নৈতিকতার আয়না, তবে যে মামলাটি সবচেয়ে উল্লেখ্য, তা হল ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের বহুজাতিক ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠান সিসকো সিস্টেমস বনাম তার প্রাক্তন এক হিন্দু দলিত কর্মচারী। তাঁর অভিযোগ, ঊর্ধ্বতন দুই আধিকারিক, দু’জনেই ব্রাহ্মণ, তাঁকে নিয়মিত ভাবে বঞ্চিত করেছেন আত্মসম্মান সহকারে তাঁর জীবিকার চুক্তি অনুযায়ী কাজ করা থেকে। বন্ধ হয়েছে বোনাস, দেখা হয়েছে যাতে তিনি কোনও নীতিনির্ধারক সভায় উপস্থিত হতে না পারেন; যাতে পদোন্নতির জন্য তাঁর নাম বিবেচিত না হয়, তার ক্ষেত্রও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সিসকোর রফানিষ্পত্তির আবেদন আদালত অগ্রাহ্য করছে। মামলা এখন রাজ্য আপিল আদালতে। যদি অভিযোগকারী মামলা জেতেন, তবে রাজ্যের নাগরিক অধিকারে যুক্ত হবে ভারতীয় জাতিপ্রথা এবং তজ্জনিত বৈষম্যমূলক আচরণ।
এই মামলারও একটি ভারত-কেন্দ্রিক প্রেক্ষাপট রচিত হতে শুরু করেছে। আমেরিকার দু’টি রাজ্য কলোরাডো এবং মিশিগান-এ সিদ্ধান্ত হয়েছে, অম্বেডকরের জন্মদিন ১৪ এপ্রিল সেখানে পালিত হবে ‘ড. বি আর অম্বেডকর একুইটি ডে’ নামে। তার আগে কানাডার রাজ্য ব্রিটিশ কলাম্বিয়া জানিয়েছিল, তারা সমগ্র এপ্রিল মাস উদ্যাপন করবে ‘দলিত ইতিহাসের মাস’ হিসেবে। আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের ব্র্যানডাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ তিন বছর বেআইনি ঘোষিত হয়েছে জাতিপ্রথা, অনুরূপ নীতি গৃহীত হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি জুড়ে, বা হার্ভার্ড স্নাতক ছাত্র ইউনিয়নে। আশ্চর্য, ভারতীয় অভিবাসীদের সম্পর্কে ‘ব্যবস্থা’ করার তাড়াটি সর্বাগ্রে অনুভূত হয়েছিল অতলান্তিকের অন্য পারে। ব্রিটেনের ইকোয়ালিটি আইনে ভারতীয় জাতিপ্রথার সংযোজন ঠিক হয়েও তা বানচাল হয়ে যায় ২০১০ সালে লেবার সরকার পতনের পর।
বিশেষ করে আমেরিকায় জাতিপ্রথা সম্পর্কে এই ‘সাজ-সাজ’ রবের প্রথম কারণ অবশ্যই পরিচিতি। ভারতের এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে তফসিলি, জনজাতি ও অন্যান্য পশ্চাৎপদ বর্গের আসন সংরক্ষণের দৌলতে সাম্প্রতিক অতীতে দলে দলে উপবীতহীন ভারতীয় হাজির হয়েছেন ‘ল্যান্ড অব অপরচুনিটি’-তে। অন্য দিকে, সারি সারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সব উচ্চবর্ণের ভারতীয়— মাইক্রোসফট, গুগল-এর মালিক অ্যালফাবেট, টুইটার (সে দিন পর্যন্ত), আইবিএম, অ্যাডবি। ভারতীয়দের কাছে ব্যাপারটি অভিনব নয়। সাহিত্য, বিজ্ঞান, এমনকি ক্রিকেট— কোথায় নেই উচ্চবর্ণের প্রাধান্য? কিন্তু সেই প্রাধান্য যে মানবসৃষ্ট, প্রাকৃতিক নয়, এটি ভারতীয় চোখে এখনও পরিষ্কার হয়নি। যেমন, কোনও কৃষ্ণাঙ্গ যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, তা ক’জনই বা অনুমান করেছিল ২০০৮ সালে বারাক ওবামার নির্বাচনী জয়ের আগে? আমেরিকার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সিলিকন ভ্যালির শেয়ারহোল্ডাররা, তাই জানতে উৎসুক, কী ভাবে ওই উপবীতধারীরা সকলে হলেন সমান কর্মপটু, উপবীতহীনদের চেয়ে অনেক বেশি? তার মন্ত্রটিও কি অপরকে নিষ্পেষণ?
অম্বেডকর ছিলেন সত্যদ্রষ্টা। ১৯১৬ সালে তিনি একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন: “হিন্দুরা যদি এক দিন ভূপৃষ্ঠে অন্য কোথাও বাস করতে শুরু করে, তখন ভারতীয় জাতপ্রথা হয়ে উঠবে এক পৃথিবীর সমস্যা।” সেই সমস্যার স্বরূপটি পশ্চিমি দুনিয়া দেখতে আরম্ভ করেছে।