—ফাইল চিত্র।
গত বছরের নভেম্বরে রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচনের অভিজ্ঞতা। সীকর জেলায় দাঁতারামগঢ়ের রাস্তা পৌঁছে দিয়েছিল নৌসল গ্রামে। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনায় তৈরি রাস্তার পাশে দেখা মিলেছিল পাশাপাশি দুই মন্দিরের। বড় মাপের বালাজির মন্দিরের চূড়ায় ‘জয় শ্রীরাম’ লেখা ঝান্ডা উড়ছিল। পাশে ছোট অথচ যত্নে তৈরি রাজস্থানি লোকদেবতা কেসরিয়া কঁওয়রের মন্দির। এই দেবতার থানে এলে সাপে কাটা রোগী সেরে ওঠে বলে গ্রামের গরিব, পিছড়ে বর্গের মানুষের বিশ্বাস। তাই মন্দিরের গায়ে কালো রঙে যত্ন করে সাপের ছবি আঁকা।
নৌসল গ্রামের গরিব, অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ খুব খুশি। বালাজির মন্দিরের পাশেই, একেবারে পাকা সড়কের পাশে তাঁদের লোকদেবতার মন্দির তৈরি হয়েছে। তাঁদের আস্থার কদর মিলেছে।
কারা মন্দির তৈরি করল? নৌসলের মানুষজন বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন, তাঁদের চাঁদাতেই মন্দির তৈরি হয়েছে। কিন্তু উদ্যোগ কার? খোঁজ নিতে দেখা গেল, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারকরা মন্দির তৈরির উদ্যোগ করেছিলেন। তাঁরাই চাঁদা তুলেছেন গ্রামে ঘুরে ঘুরে। তার পরে তাঁরাই দাঁড়িয়ে থেকে মন্দির তৈরি করিয়েছেন।
কেউ যদি মনে করেন, নরেন্দ্র মোদী, বিজেপি, আরএসএস শুধু অযোধ্যার রামমন্দির তৈরি করে, লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে মন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে, শুধু সেই আবেগে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে জিততে চাইছেন, তা হলে ভুল করবেন। বিজেপি-আরএসএস শুধু কাশী বিশ্বনাথ করিডর, কেদারনাথ মন্দির, উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরের উন্নয়ন করে বসে নেই। তার সঙ্গে দেশ জুড়েই ছোট-বড় হিন্দু মন্দিরের উন্নয়নের কাজ চলছে। দলিত, অনগ্রসর শ্রেণির পূজিত দেবদেবীর মন্দির তৈরি হচ্ছে।
নিজের ধর্মের আরাধ্য দেবতার সুবিশাল মন্দির দেখলে যে কোনও মানুষেরই মনে আনন্দ হয়। তার সঙ্গে যদি দলিত, জনজাতি, অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ দেখেন, তাঁদের লোকদেবতার মন্দিরও তৈরি হচ্ছে, তা হলে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষেরও মনে হয়, তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্মান পেল। সমাজে তাঁদের সম্মান বাড়ল। তাঁদের নতুন ধর্মীয় পরিচিতি তৈরি হল। মানুষের মনে এই ধর্মীয় চেতনা তৈরির কাজটিই করছে বিজেপি-আরএসএস। তাদের কাছে এটাই ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা বা পুনরুদ্ধারের কর্মসূচি। ‘বহিরাগত’ মোগল সেনার তৈরি বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে রামমন্দির তৈরি সেই কর্মসূচিরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু একমাত্র অধ্যায় নয়।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে গত দশ বছরে নরেন্দ্র মোদী এমন দেবদেবীর মাহাত্ম্যের কথা বলেছেন, এমন ধর্মীয় স্থানে গিয়েছেন বা সেখানকার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন যে, অনেকে আগে তার নামই শোনেননি। যেমন এক বার উত্তরপ্রদেশের অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের পূজিত দেবী মোরী মাইয়ের কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বারাণসী থেকে লোকসভা সাংসদ হওয়ার পরে মোদী ‘সংসদ আদর্শ গ্রাম যোজনা’-য় জয়াপুরা গ্রামকে ‘দত্তক’ নিয়েছিলেন। সেই গ্রামের অটলনগর বস্তিতে দলিত মুসহর সম্প্রদায়ের ঠিকানা। সেই বস্তিতে এখন আরএসএস-এর উদ্যোগে তৈরি হয়েছে শবরী মায়ের মন্দির। দলিত মুসহররা মনে করেন, তাঁরা রামায়ণের কাহিনির শবরী মায়ের উত্তরপুরুষ। আগে অটলনগরের পঞ্চাশ ক্রোশের মধ্যে মুসহরদের কোনও মন্দির ছিল না। এখন নিজেদের বস্তিতেই তাঁদের দেবীর মন্দির তৈরি হয়েছে।
বারাণসী নাহয় প্রধানমন্ত্রীর সংসদীয় এলাকা। আপনি উত্তরপ্রদেশ-মধ্যপ্রদেশের মাঝে উন্নতির মাপকাঠিতে পিছিয়ে থাকা বুন্দেলখণ্ডে গেলে দেখবেন, জাতীয় সড়কের পাশে স্থানীয় দলিত, অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের পূজিত দেবদেবীর মন্দির তৈরি হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ রোজগারের আশায় জাতীয় সড়কের ধারে এসে ঘর বাঁধছেন। রাস্তার পাশে গাছের তলায়, গাছের গায়ে লাল, হলুদ সুতো জড়িয়ে, সিঁদুর মাখিয়ে দেবদেবীর থান তৈরি হচ্ছে। তার পরে সেখানে মন্দির তৈরির উদ্যোগ করেছে আরএসএস। দাঁতারামগঢ়ের কেসরিয়া কঁওয়রের মন্দির থেকে লখনউয়ের অর্জুনগঞ্জে মোরী মাইয়ের থান— এ ভাবেই সেজে উঠেছে।
খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায়, এই সব মন্দির তৈরির পিছনে আরএসএসের উদ্যোগ থাকলেও অর্থ নেই। অর্থ জোগাড় করা হয়েছে স্থানীয় মানুষের থেকেই। অল্প অল্প করে চাঁদা তুলে। তাতে লাভ হয়েছে, মন্দির তৈরি হলে সবাই তার সঙ্গে একাত্ম বোধ করছেন। নিজের বলে মনে করছেন। অযোধ্যায় রামমন্দিরের ক্ষেত্রেও একই কৌশল নিচ্ছে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।
তিন বছর আগে অতিমারির মধ্যেই আরএসএস দেশ জুড়ে রামমন্দিরের জন্য অর্থ সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছিল। এমন নয় যে, চাঁদা না তুললে রামমন্দিরের অর্থ জোগাড় হত না। ওই চাঁদা সংগ্রহের উদ্দেশ্য ছিল, রামমন্দিরের সঙ্গে সকলের আবেগকে জড়িয়ে ফেলা। সবাই যাতে রামমন্দিরকে নিজের বলে ভাবেন, তা নিশ্চিত করা। গ্রামে গ্রামে চাল সংগ্রহ করেও তা অযোধ্যায় পাঠানো হয়েছে। তার পরে সেই চালে ঘি-হলুদ মাখিয়ে তৈরি হয়েছে ‘অক্ষত’ চাল। এখন সেই হলুদ রঙের অক্ষত চাল ছোট ছোট প্যাকেটে করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে। তার সঙ্গে থাকছে রামমন্দিরের ছবি-সহ অযোধ্যায় আসার আমন্ত্রণপত্র। ২২ জানুয়ারি রামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর গোটা দেশের লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপি নেতারা নিজেদের উদ্যোগে রামের ভক্তদের অযোধ্যায় পাঠাতে শুরু করবেন। বলা বাহুল্য, তাতে শুধু উচ্চবর্ণের হিন্দুরা থাকবেন না, সেই দলে দলিত, জনজাতি, অনগ্রসর শ্রেণির মানুষও থাকবেন। তাঁরা অযোধ্যায় রামমন্দিরে গিয়ে দেখবেন, রামমন্দিরের চত্বরেই দলিত, অনগ্রসরদের পূজিত বাল্মীকি, শবরী মাতা, নিষাদরাজের মন্দির তৈরি হয়েছে। বসানো হচ্ছে জটায়ুর মূর্তিও। যে জটায়ুকে দেশের বহু জনজাতি সম্প্রদায় পুজো করে।
বিষয়টা খুব সহজ। অযোধ্যায় রামমন্দির আর নিছক রামমন্দির থাকছে না। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের প্রতীক হয়ে উঠছে। তার সঙ্গে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, দলিত, ওবিসি, জনজাতিদের আবেগ জড়িয়ে পড়ছে। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে এককাট্টা হচ্ছে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক। কিন্তু শুধু ভোটব্যাঙ্কের গণিতে তা আর সীমাবদ্ধ থাকছে না। নরেন্দ্র মোদীর কাছে মন্দিরে মন্দিরে যাওয়া, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করা বা কপালে ভস্ম, চন্দন মেখে পুজো করাটা ভারতীয় সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের অঙ্গ। তাঁর এ বিষয়ে কোনও কুণ্ঠা নেই। তিনি নিজেকে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার পুনর্জাগরণের ভগীরথ হিসাবে তুলে ধরছেন। এই রণকৌশলে মিশে থাকছে ধর্মবিশ্বাস, সাংস্কৃতিক পরিচিতি ও হিন্দুত্ব। হিন্দু সাংস্কৃতিক প্রতীক কাজে লাগিয়ে এক নতুন কুণ্ঠাহীন সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলা হচ্ছে।
শুধু হিন্দুত্ব দিয়ে সকলের মন জেতা যায় না তা বিজেপি-আরএসএস জানে। কিন্তু হিন্দুত্বকে যদি সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে তুলে ধরা যায়, তা হলে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করা তরুণ-তরুণীও ইন্টারনেট খুলে অযোধ্যা-কাশী-মথুরার ঐতিহ্যের কাহিনি পড়তে বসে। ইংরেজি উপন্যাস লিখিয়েরাও হিন্দু দেবদেবীদের ঘিরে কিংবদন্তিকে ভিত্তি করে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। স্টেশন থেকে বিমানবন্দর বা শপিং মলের বইয়ের স্টলে এই সব বইপত্রের ভিড় তারই প্রমাণ।
এর উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে কোনও এক রাহুল গান্ধী বলছেন, নিজের রোজকার জীবনে, সামাজিক আচার-ব্যবহারে ধর্মের মূল কথাগুলো মেনে চলাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ধর্মকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী সুবিধা তুলতে চান না। ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রায় বেরিয়ে যখন রাহুল গান্ধী বলেন, “ধর্ম ব্যক্তিগত আস্থার বিষয়, তা নিয়ে ঢক্কানিনাদের প্রয়োজন নেই”, তখন আজকের ভারতে অনেকের কাছেই তা কিছুটা ‘বোকা বোকা’ই শোনায়।
বাস্তব হল, লোকসভা ভোটে জেতা-হারার বাইরে বিজেপি-আরএসএস দেশে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের এমন বীজ বপন করে ফেলেছে, যা আর কারও পক্ষেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তাই কংগ্রেসকেও প্রয়োজনে রাহুল গান্ধীকে ‘পৈতেধারী শিবভক্ত হিন্দু’ হিসাবে তুলে ধরতে হবে। এই ফাঁদ থেকে বেরোনোর উপায় আছে কি?