Jammu and Kashmir

‘ওরা সন্ত্রাসবাদী ছিল’

উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ভূরি ভূরি। কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া সেনাবাহিনীর অভিযুক্ত কর্মী-অফিসারদের সাজা হয়নি।

Advertisement

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৪২
Share:

কাশ্মীর পুলিশও এক বিবৃতিতে সংঘর্ষের কথা জানায়। প্রতীকী ছবি।

জম্মুর রাজৌরি থেকে কাজের খোঁজে ওঁরা তিন জন এসেছিলেন দক্ষিণ কাশ্মীরের শোপিয়ানে। তাঁদের মধ্যে এক জন, ইমতিয়াজ আহমদ, অবশ্য তার মাসখানেক আগে শ্রমিকের কাজে ঢুকেছিলেন। বাকি দু’জন, আব্রার এবং ইব্রারকে তিনিই নিয়ে আসেন। সেটা ২০২০-র জুলাই। লকডাউনে কার্যত কোথাও কোনও কাজ নেই। তিন যুবকই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন ১৬ জুলাই। ব্যস, ইমতিয়াজের মোবাইল ফোন এর পর থেকে সুইচড অফ। বাকিদেরও খোঁজ নেই। বাড়ির লোকজন রাজৌরি থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন।

Advertisement

এর ঠিক দু’দিন পরে, ১৮ জুলাই কাশ্মীর উপত্যকার শোপিয়ান জেলার আমশিপোরায় সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের ৬২ নম্বর ব্যাটালিয়নের জওয়ানদের সঙ্গে ‘সংঘর্ষ’-এ তিন জঙ্গি নিহত হয়। তাদের কাছ থেকে ‘অস্ত্রশস্ত্র ও প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ নথি’ উদ্ধার হয়। কাশ্মীর পুলিশও এক বিবৃতিতে এই সংঘর্ষের কথা জানায়। যদিও পরে ওই তিন যুবকের ছবি দেখে বাড়ির লোকজন দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, ওই ‘জঙ্গিরা’ তাঁদের বাড়ির ছেলে। তাঁরা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের। স্রেফ কাজের সন্ধানে তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন। কোনও সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের সঙ্গে ওই যুবকদের দূরতম যোগাযোগ নেই।

সেনাবাহিনী জানায়, তারা তদন্ত করে দেখবে। পুলিশও একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করে। সেনা আদালত সে দিনের ‘সংঘর্ষ’-এর নেতৃত্ব দেওয়া রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের ক্যাপ্টেন ভূপেন্দ্র সিংহকে (যিনি স্থানীয় ভাবে মেজর বশির খান নামে পরিচিত ছিলেন) সম্প্রতি দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সুপারিশ করেছে— যদিও এই সুপারিশ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করে দেখবেন। তদন্তে বলা হয়, ওই অফিসার সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইনের (আফস্পা) অপব্যবহার করেছেন। এ ছাড়াও প্রমাণিত হয়, ওই বাহিনী ভুয়ো তথ্য দিয়েছে। নিরীহ তিন যুবককে জঙ্গি আখ্যা দেওয়া হয়েছে ২০ লক্ষ টাকা নগদ পুরস্কারের লোভে।

Advertisement

উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ভূরি ভূরি। কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া সেনাবাহিনীর অভিযুক্ত কর্মী-অফিসারদের সাজা হয়নি। শোপিয়ানের আমশিপোরায় অন্তত সেনা আদালত সাজার কথা বলেছে। আরও একটি বিষয় বর্তমান ঘটনাটির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ— পুলিশি তদন্তও চাপের মুখে ফেলেছিল নিরাপত্তা বাহিনীকে।

সেনা আদালতে কারও দোষী সাব্যস্ত হওয়া যদি মুদ্রার একটি পিঠ হয়, অন্য একটি পিঠ হল সেনা আদালতের সুপারিশ বাস্তবায়িত হওয়ার অনিশ্চয়তা। দু’-একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১০-এর ৩০ এপ্রিল সেনাবাহিনী দাবি করে, জম্মু-কাশ্মীরের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর মাছিল সেক্টরে তিন জন পাকিস্তানি জঙ্গি সংঘর্ষে নিহত হয়েছে। তাদের কারও বয়স ২১, কারও বা ১৯। ওই ঘটনারও তদন্ত হয়। সেনা আদালত বাহিনীর ছ’জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। কিন্তু ২০১৭-য় সেনা ট্রাইবুনাল সেই সাজা বাতিল করে দেয়। কাশ্মীরের পাথরিবালে ২০০০ সালে রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের বিরুদ্ধে ভুয়ো সংঘর্ষে পাঁচ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে। সেনাবাহিনী দাবি করেছিল, নিহতেরা পাকিস্তানি জঙ্গি। কিছু দিন পরে সেনা এই ঘটনায় দোষীদের সাজা দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সিবিআই তদন্তে প্রমাণিত হয়, ওই সংঘর্ষ ভুয়ো। তাদের ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। এমনকি, ডিএনএ পরীক্ষাতেও প্রমাণিত হয়, নিহতেরা স্থানীয়। সেনা ডিএনএ পরীক্ষা এড়িয়ে যাচ্ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। জম্মু-কাশ্মীর হাই কোর্ট সেনা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ বহাল রাখলেও নিহতদের পরিবারের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারে সব পক্ষকে ছ’সপ্তাহের মধ্যে নোটিসের জবাব দিতে বলে। সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি গ্রহণ করার পরে সেনা আদালত বসলেও তারা অভিযুক্ত সেনা অফিসার ও জওয়ানদের রেহাই দেয়।

নানা মহলে সেনা তথা রাষ্ট্রের এই মনোভাবকে ‘রেহাই দেওয়ার সংস্কৃতি’ বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। বারংবার প্রশ্ন উঠছে, শুধুমাত্র জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে অভিযুক্তদের আড়াল করার এই সংস্কৃতি দেশের নাগরিকদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে না তো? শুধুই কি কাশ্মীর উপত্যকা? দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে তাকানো যাক। ২০১৬-য় সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হয় এক্সট্রা-জুডিশিয়াল এগজ়িকিউশন ভিক্টিম ফ্যামিলিজ় অ্যাসোসিয়েশন, মণিপুর। মণিপুরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জঙ্গিদের ভুয়ো সংঘর্ষের ১৫২৮টি অভিযোগের কথা জানিয়ে তারা সর্বোচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপের আর্জি জানায়। এই সংগঠনের সদস্যদের পরিবারের কেউ না কেউ ভুয়ো সংঘর্ষের শিকার হয়েছেন।

এই সব ভুয়ো সংঘর্ষের অভিযোগের তদন্তের জন্য ২০১৬-র ৮ জুলাই কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। পরের বছর এক বিশেষ তদন্তকারী দল গড়ে দেয় সর্বোচ্চ আদালত। ১৫২৮টির মধ্যে প্রাথমিক ভাবে ৯৫টি ঘটনার তদন্ত করে চার্জশিট পেশের নির্দেশ দেয় আদালত। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, পরের বছর সরকার যে তালিকা কোর্টে পেশ করে তাতে ৯৫টির বদলে জায়গা পায় ৪১টি ঘটনা! সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন দুই বিচারপতি মদন বি লোকুর এবং বিচারপতি ইউ ইউ ললিতের ডিভিশন বেঞ্চ ওই তালিকা দেখে জানতে চায়, গত কয়েক মাসে ক্ষতিগ্রস্ত ও মোট ঘটনার সংখ্যা কমে যায় কী করে? সে সময়ে বিচারপতি লোকুর মন্তব্য করেন, “আমরা নিছক আরও একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলছি না। আমরা মৃত্যুর কথা বলছি যা খুনও হতে পারে!”

২০০৮ থেকে ২০২১-এর মধ্যে কাশ্মীর উপত্যকায় নানা ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের অন্তত ১০৮টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ভুয়ো সংঘর্ষ, হেফাজতে মৃত্যু, নিগ্রহ, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, মানবঢাল, ছররা বন্দুকের যথেচ্ছ ব্যবহারের মতো গুরুতর সব অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু একটি ঘটনাতেও কারও সাজা হয়নি বলে উপত্যকার মানবাধিকার সংগঠনগুলির অভিযোগ। কাশ্মীরের মানবাধিকার সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর জাস্টিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ২০১৮-য় রাজ্য মানবাধিকার কমিশনে আবেদন জানায়, ১৯৯০ থেকে ওই সময় পর্যন্ত উপত্যকায় ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্ত রিপোর্টের হাল কী, জানানো হোক। উত্তরে কমিশন জানিয়েছিল, ওই সময়কালে পাঁচশোরও বেশি ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র একটির তদন্ত শেষ হয়েছে, তবে তার রিপোর্টও জমা পড়েনি!

২০০১-এর ১৭ মার্চ, দিল্লিতে ‘গণতন্ত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনাসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী মন্তব্য করেছিলেন, “সেনাকে সাংবিধানিক ভাবে অসামরিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ মানা প্রয়োজন। তাদের ভূমিকা রক্ষকের, শাসকের নয়।” তাঁর উত্তরসূরিরা কথাটি মনে রাখেননি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement