প্রতীকী ছবি।
কোন রোগ কত ভয়ঙ্কর? ২০১৯-এর ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত তথ্য বলছে, মারণক্ষমতায় প্রথম দশের মধ্যে পুরোভাগে ইসকিমিক হৃদ্রোগ। এর পর স্ট্রোক, সিওপিডি, ফুসফুসের সংক্রমণ, নবজাতকের নানা ব্যাধি, বিভিন্ন ক্যানসার, অ্যালঝাইমার’স ইত্যাদি। সারা বিশ্বে মৃত সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের অর্ধেকের বেশির মৃত্যুর কারণ এ সব রোগ। কিন্তু বাকিরা? স্বাস্থ্য পরিষেবা কেমন সে ক্ষেত্রে? চিকিৎসা বিজ্ঞান কতটা এগিয়েছে? সেই পরিপ্রেক্ষিতে অল্প পরিচিত এক মারণ রোগের কথা উঠে আসে— অ্যামিয়োট্রপিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস বা সংক্ষেপে এএলএস। স্নায়ুর এই রোগে আজও মানুষ অসহায়। আগামী ২১ জুন পালিত হবে এএলএস দিবস।
এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বিশ্বের বহু গুণিজন। প্রথমেই মনে পড়ে বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর কথা। মাত্র বাইশ বছর বয়সে হকিং-এর একটি রোগ ধরা পড়ে। তখন তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত। নানা পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা নিশ্চিত হন, রোগটি এএলএস। এই মারণ রোগটির পরিসংখ্যান থেকে ধরে নেওয়া হয় যে তাঁর আয়ু সীমিত। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে হকিং তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে বিস্ময়কর অবদান রেখেছেন শারীরিক সমস্যা দমিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা, সংসার করেছেন স্বাভাবিক মানুষের মতো। বয়স ষাট পেরোলেও প্রতিবন্ধকতা জয় করে বেলুনে পাড়ি দিয়েছেন আকাশে। পরে তাঁর স্বরনালিতে ট্রাকিয়োস্টমি সার্জারি হয়। কথা বলা তখন থেকেই বন্ধ। ছিয়াত্তর বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
নিউ ইয়র্ক ইয়াংকি দলের বেসবল খেলোয়াড় লাও গেহরিগ ছিলেন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। ১৯৩৯-এ তাঁর এএলএস ধরা পড়ে, দু’বছরের মধ্যেই মারা যান। পরে তাঁর নামে এএলএস রোগের আর একটি নামকরণ হয়। গানস অব নাভারোন-খ্যাত অস্কারজয়ী ব্রিটিশ অভিনেতা ডেভিড নিভেন মারা যান এই রোগে। মাও জেদং শেষ বয়সে এএলএস-সহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগেছিলেন। আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস-এর গভর্নর, রাজনীতিবিদ পল সেলুসি মারা যান এএলএস-এ। এ রোগের সচেতনতা ও গবেষণার কাজে ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন। শিশুসাহিত্যিক, প্রযোজক-পরিচালক জন স্টোনও এই রোগের শিকার।
এএলএস-এর পুরো নাম অ্যামিয়োট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস। অ্যামিয়োট্রফিক শব্দের অর্থ পেশি সংক্রান্ত অসুবিধা। ল্যাটারাল মানে আড়াআড়ি, স্ক্লেরোসিস বলতে বোঝায় ক্রমে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়া। এই রোগটি ‘গেহ্রিগ রোগ’ ও ‘চার্কট’স ম্যালাডি’ নামেও পরিচিত। ১৮২৪-এ রোগটির লক্ষণ লিপিবদ্ধ হয়েছিল, ১৮৬৯ নাগাদ ফরাসি স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ জঁ মার্টিন চার্কট রোগটির স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে যোগ নিশ্চিত করেন। এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলি হল অকারণে হোঁচট খাওয়া ও পড়ে যাওয়া, পা টেনে চলা বা হাঁটাচলায় অসুবিধা, কোনও এক দিকের হাত বা পায়ের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা ও সঙ্গে পেশি ক্রমে শুকিয়ে যাওয়া, বোতাম লাগাতে, লিখতে বা চাবি খুলতে হাতের দুর্বলতা। আরও নানা উপসর্গ নিয়ে গবেষণা করছেন চিকিৎসকরা।
এএলএস পরীক্ষার পরিসর সীমিত ও ব্যয়বহুল। এখনও পর্যন্ত রোগটির নিশ্চিত কারণ অজানা, শতকরা পনেরো ভাগ জিনগত ত্রুটি রোগটির কারণ বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। ল্যান্সেট জার্নালের সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র জানাচ্ছে, এএলএস হওয়ার সম্ভাবনা প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে এক বা দু’জনের। কিন্তু সারা জীবনের জন্য বললে ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ অনেক বেশি, প্রতি চারশো জনের মধ্যে এক জনের হতে পারে।
সবচেয়ে দুর্ভাবনার বিষয়, রোগটির কোনও প্রমাণিত চিকিৎসা নেই। যেটুকু দেশ-বিদেশে করা হয়, সবই পরীক্ষামূলক। তাই হয়তো ক্যানসারের চেয়েও এ রোগটি বিপজ্জনক, রোগীর পরিবারের কাছে হতাশার। রোগীর মনস্তাত্ত্বিক দিকটিও যথেষ্ট ভাববার: তাঁর মস্তিষ্কের সক্ষমতা পুরো মাত্রায় থাকে, অথচ তিনি বুঝতে পারেন ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন শেষের দিকে। এই হতাশা মৃত্যুর ভয়াবহতার দিকটিকে প্রকট করে তোলে। এই রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে যে ব্যবস্থা দরকার তা এ দেশে অপ্রতুল, এএলএস-এর গতির হার শ্লথ করতে একটি ট্যাবলেট ব্যবহারের মাসিক খরচ প্রায় বারো থেকে পনেরো হাজার টাকা। রোগের পার্শ্বক্রিয়া আটকাতে সাহায্যকারী একটি ইনজেকশনের দাম প্রায় সাতশো টাকা। পরবর্তী কালে এএলএস-এর তীব্রতা বাড়তে থাকলে রোগীকে সব ধরনের জীবনদায়ী পরিষেবা দিতে উন্নত বিশ্বে বার্ষিক ন্যূনতম খরচ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৭০ কোটি টাকা। এখানে চিকিৎসার খরচ এক দশমাংশ ধরলেও তা কয়েক কোটিতে পৌঁছবে। বিশ্বের নানা সংস্থা ও সরকারের সাহায্য না পেলে স্টিফেন হকিং-এর চিকিৎসা হত না। এএলএস নিয়ে তাই সচেতন হওয়া দরকার, দরকার এর গবেষণায় ও রোগীদের পাশে দাঁড়ানো।