অখুশি: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নেতারা, কলকাতা, ১৬ ডিসেম্বর, পিটিআই
তাঁর মূল্যায়নে এই রাজ্যে বিজেপির হাল এখন কেমন, খোদ অমিত শাহ এ বার সেটা বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। একুশের বিধানসভা ভোটের সময় বাংলায় ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখানো শাহের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ তাঁর দলকে কী দিশা দেখাবে, সেটা বিজেপির নিজস্ব বিষয়। কিন্তু গণতন্ত্রে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে বাংলার বিজেপি যে যোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি, সেটা শাহের নজরে স্পষ্ট।
এটা অবশ্য আকাশ থেকে পড়ার মতো কোনও তথ্য নয়। বিধানসভার ভিতরে একমাত্র বিরোধীপক্ষ হয়েও গত দেড় বছরে তারা যা করেছে তা প্রকৃতপক্ষে শুধু কিছু নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। কথায় কথায় ওয়াক আউট কিংবা হট্টগোল বাধিয়ে প্রচারের আলো টানা।
অথচ এর বাইরেও বিরোধীপক্ষের কিছু করার অবকাশ থাকে। গঠনমূলক ‘বিকল্প’ ভাবনা তুলে ধরা তার অন্যতম। আজ পর্যন্ত কোনও বিষয়ে বিজেপির কেউ বিধানসভায় তেমন কোনও উদাহরণ গড়েছেন বলে মনে পড়ে না।
অন্য দিকে, পথে নেমে বিরোধী-সুলভ আন্দোলন করার ক্ষেত্রেও দলটিকে সফল বলা যাবে না। বস্তুত কেন্দ্রীয় তদন্তের সাজানো ডালি এবং আদালতের বিভিন্ন রায় যেন তাদের ‘শক্তির উৎস’ এবং রাজনীতির একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে! এর বাইরে এমন কোনও কর্মসূচি তারা তুলে ধরতে পারেনি, যেটা বৃহত্তর জনজীবনকে স্পর্শ করতে পারে। বিশেষ করে এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিরোধী নেত্রী হিসাবে দেখার পরে তুলনাটি নিঃসন্দেহে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। তার পরেই লোকসভার প্রস্তুতিতে নামবে সবাই। এই অবস্থায় বিজেপির পক্ষে ‘ঘর গুছোনো’ তাই কতটা সহজ হবে, শাহের কথা থেকেই সেই সংশয় দানা বাঁধছে।
কিন্তু কেন বিজেপির এই অবস্থা? দেখা যাচ্ছে, বিধানসভা ভোটে হারার পর থেকে শুধুই সন্ত্রাসের অভিযোগ নিয়ে রাজ্য বিজেপির কতিপয় নেতা সরব। রাজ্যপাল থাকাকালীন জগদীপ ধনখড় নিয়মিত রাজ্য বিজেপির সেই সব অভিযোগে সিলমোহর দিয়ে শাসককে কাঠগড়ায় তুলতেন।
অভিযোগ সবই মনগড়া, তা নিশ্চয় নয়। আবার এটাও বিশ্বাস করা কঠিন যে, শুধুই সন্ত্রাসের ‘ভয়ে’ ভোটের পর থেকে বিজেপি কাঁপতে কাঁপতে গর্তে ঢুকে গিয়েছে! বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বও সন্ত্রাসের এমন ‘অতি সরল’ তত্ত্বে আস্থা রাখতে পারেন না। জে পি নড্ডা এর আগে এখানে এসে সেই কথা বলেছিলেন।
এ বার কলকাতায় দলের সদর দফতরে বসে নেতাদের কাছে শাহ নিজে সোজাসুজি জানতে চান, বিধানসভা ভোটে বিজেপি ২ কোটি ২৯ লক্ষ ভোট পাওয়ার পরেই কি সব লোক দলের দিক থেকে মুখ ফেরালেন? নইলে তার পর থেকে জনসমর্থনে এ ভাবে ভাটা পড়ল কেন? সবই সন্ত্রাস?
উত্তরটাও তিনিই বুঝিয়ে দিয়েছেন। যার সার কথা, নেতারা কর্মীদের কাছে পৌঁছতে পারছেন না। মানুষের সঙ্গে ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে। বিরোধী ময়দানে সেই ফাঁক দিয়ে যে বামেদের কিছুটা অগ্রগতি হচ্ছে, তা-ও উপলব্ধি করেছেন শাহ। শুধু সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে যে দায়িত্ব এড়ানো যায় না, নেতাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন সেই কথাও।
দলের উপরতলায় ঐক্যের অভাব যে এই অবস্থার প্রধান কারণ, শাহের সেটা না-বোঝার কথা নয়। কিন্তু রোগ ধরা পড়লেই তো রোগমুক্তি হয় না! আজকের রাজ্য বিজেপিতে এটাই নির্মম বাস্তব।
তৃণমূলের একটি সুবিধা হল, তাদের সব কিছুই এখনও ‘মমতাময়’। এই দলে যা কিছু হয় সব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত এবং ওটাই শেষ কথা বলে গণ্য। ফলে লোকচক্ষে দলটি মোটামুটি একমুখী হিসাবেই বিবেচিত। দলও সেই ধারণাটি ছড়িয়ে দেয়।
কংগ্রেস যখন রাজ্যে প্রাসঙ্গিক ছিল, তখন উপরতলায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছিল প্রকাশ্য। তার জেরে নীচের তলায় বিশৃঙ্খল চেহারাও সকলের জানা। সিপিএম ‘রেজিমেন্টেড’ দল। অনেক বিচ্যুতি ও ভাঙনের পরেও সেখানে নিয়ম-শৃঙ্খলার কিছু পরিসর এখনও আছে। সঙ্ঘ-ভাবধারার শৃঙ্খলায় পুষ্ট বিজেপিকেও ‘রেজিমেন্টেড’ বলতে কোনও বাধা থাকার কথা নয়।
কিন্তু বাংলার বিজেপি কি আজ সত্যিই ততটা ‘সঙ্ঘবদ্ধ’? না। কারণ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ঘিরে রাজ্য বিজেপির কাঠামোয় টান পড়েছে। একুশের বিধানসভা ভোটে ঘা খাওয়ার পর থেকেই দলের হতোদ্যম অবয়ব বে-আব্রু হচ্ছিল। এখন ক্রমশ সেটা নেতাদের কলতলার ঝগড়ার স্তরে পর্যবসিত। এই সত্যটি আড়াল করার অবস্থায় রাজ্যের বিজেপি আর নেই। সাধারণত শাসক দলের মধ্যে বিবাদের সম্ভাব্য কারণ দু’টি। হয়, নেতাদের ক্ষমতা দখলের আকচাআকচি। নতুবা, কামিয়ে নেওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব। দু’টি আবার পরস্পরের পরিপূরকও বটে। কে না জানে, ‘ক্ষমতা’ বাড়লে সব দিকেই উত্তরোত্তর ‘শ্রীবৃদ্ধি’ ঘটে! ক্ষমতাসীনদের পক্ষে তার সুযোগও অনেক বেশি।
বিরোধীদের অঙ্ক অন্য। কোনও বড় বিরোধী দলের ক্ষেত্রে এই জাতীয় অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের অন্যতম লক্ষ্য থাকে, সংগঠন কব্জা করা। অর্থাৎ দলে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করে গুরুত্ব দেখানো। যাতে সময়মতো সেটা ‘কাজে’ লাগানো যায়। সেই উদ্দেশ্য হাসিল করতেই রাজ্য বিজেপিতে এখন ‘তিন মাথা’র ঠোকাঠুকি!
তবে এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটটি একেবারে ভুলে গেলে চলবে না। একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির সাতাত্তরটি আসন পাওয়ার ‘গ্নানি’ অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছিল কর্মী-সমর্থকদের গগনচুম্বী প্রত্যাশা এবং সাধারণ মানুষের কিছু ধারণা চুরমার হয়ে যাওয়ায়। দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো নেতারা রাজ্যে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে তাঁদের দলকে ক্ষমতায় বসানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন বলেই সাতাত্তর শূন্যের মতো গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
এরই সঙ্গে যুক্ত হয় ভোটের আগে তৃণমূল থেকে সের-দরে নেতা ভাঙিয়ে এনে তাঁদের মাথায় তোলার জন্য বিজেপি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কর্মী-সমর্থকদের প্রবল ক্ষোভ। শীর্ষ নেতৃত্ব চাইলেও তৎকালীন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ভাঙিয়ে আনার ওই রাজনীতি পছন্দ করেননি। তবে ভোটের পর তাঁকে সরিয়ে সুকান্ত মজুমদারকে রাজ্য সভাপতি করা হয়।
পেশায় অধ্যাপক সুকান্ত আরএসএস করেছেন। গত লোকসভা ভোটে প্রথম জিতে রাজনীতিতে পরিচিতি। উত্তরসূরি হিসাবে সুকান্তের নামে সম্মতি দিয়ে দিলীপ হয়তো ভেবেছিলেন, সুকান্ত তাঁর হাত ধরে চলবেন। সেটা হয়নি। অভিজ্ঞতার অভাবে সুকান্তকে হোঁচট খেতে হচ্ছে, এটাও বাস্তব।
এখানেই সবচেয়ে অর্থবহ হল পদ্ম-দলে শুভেন্দু অধিকারীর বিকশিত হয়ে ওঠা। মমতা যদি নন্দীগ্রামে না লড়তেন অথবা শুভেন্দুর কাছে তাঁকে হারতে না-হত, তা হলে বিজেপিতে শুভেন্দুর ‘অবস্থান’ কী হত, বলা শক্ত। তবে যা ঘটেছে তার জন্যই উচ্চাভিলাষী শুভেন্দুর ‘গুরুত্ব’ দিল্লির কাছে অনেকটা বাড়ে। অধিকন্তু, তিনি রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও সংসদীয় রাজনীতিতে অন্যদের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। এক কালে মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তেও বিরাজ করেছেন। সবই বিজেপিতে তাঁর উত্থানের সহায়ক।
বিরোধী দলনেতা রূপে শুভেন্দু এখন দলীয় সংগঠনের সমান্তরাল একটি ‘পাওয়ার সেন্টার’ বললে ভুল হবে না। পরিষদীয় দল এবং মূল দলের মধ্যে বিভাজন রেখাটি এর ফলে স্পষ্ট। ইদানীং মতভেদও প্রকাশ্য। যেটা রেজিমেন্টেড দলের লক্ষণ নয়। সর্বোপরি নতুন-পুরনোর সংঘাত তো আছেই।
ছেঁড়া ছাতায় মাথা ঢাকার চেষ্টায় দিল্লির বিজেপি কর্তারা রাজ্য নেতাদের ডেকে ‘ঐক্যবদ্ধ’ হওয়ার বিধান দিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এমন বিধান তো তাঁরা আগেও দিয়েছিলেন। ভস্মে ঘি!
আসলে শাসকের আসন দখলের আগে বিরোধী হিসাবে উত্তীর্ণ হওয়া খুব জরুরি। শুধু এজেন্সির তদন্ত আর আদালতের মুখের দিকে তাকিয়ে সরকার-পতনের দিন গুনলে সেই ‘অর্জন’ অসম্ভব।