হাঁটতে হাঁটতে সে তৈরি করেছে বাসা! প্রতীকী ছবি।
সে বড় অদ্ভুত মুহূর্ত। রোজ সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ শিশুটি বলে, “ক’টা বাজে? দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি যেতে হবে।” সন্ধ্যার সময়ে এমনিই তার মন খারাপ হয়। অন্ধকারকে সে ভয় পায়। “বাড়ি? এটাই তো তোর বাড়ি। তোর বাড়িতেই তো আছিস।” শিশু তাকায় কিন্তু আবার বলে, “বাড়ি যেতে হবে, দেরি হচ্ছে।”
বেশ কয়েক দিন এমন বলার পর আন্দাজ করা যায়, যে মেয়েটি তাকে দেখে রাখেন সর্ব ক্ষণ, তিনি কোনও কোনও সময় বলেন, দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাড়ি যেতে হবে, কাজ পড়ে আছে।
কখনও তা তার নিজের বাড়ি, কখনও অন্য কাজের বাড়ি।
একলা শিশু তাই শুনে বাড়ি যেতে চায়।
এক বালিকা থাকত প্রবাসে। সে কোন দেশে থাকে, স্কুলে জিজ্ঞেস করায় সে বলেছিল, ইন্ডিয়া। কেন? তার প্রাণপ্রিয় দিদা থাকতেন ভারতে, অতএব সে সেখানেই থাকে।
এ-হেন প্রবাসে এক দিন ঘোর বিদ্যুৎবিভ্রাট। তিন দিন ধরে আলো, জল কিছু নেই। মায়ের হাত ধরে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে তেরো তলার ফ্ল্যাটে সে নিয়ে এসেছে জল, তার পর বিছানায় লেপ, বালিশ নিয়ে তৈরি করেছে ‘নেস্ট’। সেখানেই গুটিয়ে শুয়ে থাকে। পরে দেখা গেল, ইট, কাঠের ঘরের ভিতরে ‘নেস্ট’ তৈরি করতে সে সিদ্ধহস্ত।
বালিকা জানত না, তার প্রমাতামহী, ঢাকার বাঙাল, বলতেন বাসা। বলতেন, তাঁর পিসেমশাই গাইতেন: ‘চার দিকে মালঞ্চ বেড়া, ওই দেখা যায় বাড়ি আমার’। তিনিও শিখে গিয়েছিলেন গানটি। পরে জানতে পেরেছিলেন, তাঁর পিসেমশাই নিয়মিত অন্য এক মেয়ের বাড়ি যাতায়াত করতেন।
পিসেমশাই, পিসিমার কাছে বালিকাকালের অনেকটাই আহ্লাদে কাটানো মেয়েটি বুঝেছিল, বাসা কী ভাবে বদলে যায়।
তার বাসাও তো বদলেছে বার বার।
বাসা চলে গেলে হাঁটতে হয়। অনেকটা বা পুরোটাই। একা।
যুধিষ্ঠিরের মতো। প্রাণাধিকরা একে একে লুটিয়ে পড়বেন তুষার-আবৃত পথে। তিনি মানুষের সঙ্গহীন হাঁটবেন।
বা মেরি, জোসেফের মতো। নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেরিকে গাধার পিঠে চাপিয়ে হেঁটে চলেছেন জোসেফ, নাজারেথ থেকে বেথলেহেম, ৯০ মাইল, শীতের রাতে কনকনে ঠান্ডা, দিনে বৃষ্টি।
কে জানত, মেরি হেঁটে চলেছেন আসলে পুত্রের মৃত্যুর দিকে। যে পুত্রকে তিনি জন্ম দেবেন এবং ৩০ বছরের সেই যুবক ক্রুশ নিয়ে হাঁটবে একা, তার যাত্রা ও মৃত্যু দেখবেন মেরি।
সভ্যতা এই একলা হাঁটা চায়। তাতে জীবন, আবিষ্কার ও মৃত্যু থাকে।
হাঁটা, একলা এবং একলা হয়ে সমবেত হাঁটা, ইতিহাস তৈরি করে। দেশভাগের পর কাতারে কাতারে ঘরহারা হাঁটেন, গান্ধী হাঁটেন।
আমাদের সেই মেয়েটিও হেঁটেছে অনেক। পথে, মনে।
হাঁটতে হাঁটতে সে তৈরি করেছে বাসা!
বাসা— পাখির ও মানুষের। বাইরের ঝড়ঝাপটা থেকে আড়াল করা আশ্রয়। একটা নিজস্ব ভাবনা-কোণ। ভাবন-কোণও বলা যায়। নিজস্ব ভাবনা সযত্নে লালন করা। বাইরের রোদ, জল সবই আসবে, আর ভাবনা বাড়বে তার নিজের মতো। এক কনিষ্ঠ বলেছিল, শান্তিনিকেতনের প্রবল গরমে বাড়িতে গিয়ে সে দেখে পাখা চলছে না, যন্ত্র সারানোর লোকও অমিল। সে ভাবতে শুরু করল, গরম লাগছে না। ভাবন-কোণও সে রকম। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, বা বাসে, ভিতরে ভাবনা তার মতো ভেবে যাচ্ছে। সঞ্চিত রাখছে তার বোধ, উপলব্ধি, ভাবনা।
বাসা খুঁজলে তাই হাঁটতে হয়।
বৈশাখও হাঁটছে আর ভাবছে। সে একলা (সেই কবে এক কবি-চিত্রকর লিখেছিলেন, তাঁর এক কন্যা সংবাদপত্রে ১লা বৈশাখকে পড়েছিল, একলা বৈশাখ, সেই দিন থেকে একলা বৈশাখ মন জুড়ে রয়েছে)। সে খুঁজছে। তাকে হাঁটতেই হবে।
তার বাসা নেই। সম্রাট আকবর তার সূচনা করেছিলেন আর এই ১৪৩০ সনে পা ফেলতে গিয়ে সে দেখছে, চার দিকে গলগল করে বেরোচ্ছে ঘৃণা আর অসততা। যে ঘৃণা বাঙালির ঘর কেড়েছে বার বার, কেড়েছে প্রিয়জনকে, সেই ঘৃণার ধর্মকেই সে আঁকড়ে ধরছে জান্তব উল্লাসে। অহং, অশালীন, আঘাতের ভাষা সর্বজনীন ও স্বাভাবিক। কী রাজা, কী প্রজা। শ্বেতশুভ্র সরস্বতী ঢাকা পড়ে গিয়েছেন তাঁর ভ্রাতার দাপটে। আর যে ভ্রাতা ছিলেন গণেশদাদা, পেটটি নাদা, ‘গণেশজি’ হয়ে ওঠায় মাথায়, গলায় ফেট্টি জড়িয়ে ডিজের তালে না নাচলে তাঁর ভজনা সম্পূর্ণ হচ্ছে না। চিচিং ফাঁক বললেই খুলে যাচ্ছে একটার পর একটা দরজা, আর তা থেকে বেরিয়ে আসছে ধনরাশি। অসতের ধন। যা ছিল ব্যতিক্রম, তাই হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক। চাকরি বিক্রি হয়ে উঠেছে লাভজনক পেশা।
এরই মধ্যে বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছে একলা বৈশাখ।
কী সেই বাসা? বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘নোয়াখালি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন গান্ধীর পদযাত্রার কথা— লিখেছিলেন, নোয়াখালির কারণে গান্ধী মুক্তি পেয়েছিলেন ‘মিথ্যা থেকে, মত্ততা থেকে, গণ-নেতার অনিবার্য ধর্মচ্যুতি থেকে।’ লিখেছিলেন, “এই তাঁর পূর্ণতা, তাঁর প্রায়শ্চিত্ত, যুধিষ্ঠিরের মতো কঠিন, শোকাচ্ছন্ন নিঃসঙ্গ স্বর্গারোহণ।”
কোন স্বর্গে? বুদ্ধদেব লিখেছেন, “যেখানে ভয় নেই, বীরত্বও নেই। ...যেখানে আশ্রয় নেই, তবু নিশ্চয়তা আছে। যেখানে বিফলতা নিশ্চিত, তবু আশা অন্তহীন। ...আসল কথা, স্বর্গকে তিনি পেয়েছেন এতদিনে, সেই স্বর্গ নয়, যা দিয়ে রাজনৈতিক রচনা করেন জনগণের সমস্ত বঞ্চিত কামনার, ঈর্ষার, কুসংস্কারের তৃপ্তিস্থল... সেই স্বর্গ, যা মানুষ সৃষ্টি করে একলা তার আপন মনে, সব মানুষ নয়, অনেক মানুষও নয়, কেউ কেউ যার একটুমাত্র আভাস হয়তো মাঝে মাঝে পায়।”
আশ্চর্যের নয়, যে বুদ্ধদেব তাঁর মহাভারতের কথা-য় যুধিষ্ঠিরের স্বর্গারোহণের মূহূর্তটিকেই স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছেন, যেখানে যুধিষ্ঠির, সর্বান্তকরণে এক মর্ত মানুষ, কোনও দেবতার দ্বারা বরপ্রাপ্ত বা অভিশাপপ্রাপ্ত নন, যিনি স্ত্রী ও ভাইদের মৃত্যুতে অবিচলিত থাকলেও একটি সারমেয়ের টানে স্বর্গ প্রত্যাখ্যান করেছেন, সেই মুহূর্ত। বুদ্ধদেব লিখেছেন, “সব যুদ্ধ থেমে যাবার পর এবং সব আশ্রয় ভেঙে যাবার পর আমাদের জীবনে যা অবশিষ্ট থাকে, যা কেউ দান করেনি আমাদের, কিন্তু আমরা নিঃসঙ্গভারে নিভৃত চিত্তে উপার্জন করেছি— কোনো জ্ঞানের ক্ষীণ রশ্মিরেখা, অতি ধীরে গ’ড়ে ওঠা কোনো উপলব্ধির হীরকবিন্দু, বেদনার অন্তর্নিহিত কোনও আনন্দবোধ... আমাদের সেই শেষ সম্পদের প্রতীকরূপে, কোনো দুর্লভ অথচ প্রাপণীয় সার্থকতার প্রতিভূরূপে আমাদের হৃদয়ে চিরকালের মতো বাসা বাঁধলেন যুধিষ্ঠির...।”
একলা বৈশাখ তাই হাঁটছে। খুঁজছে তার পূর্ণতা, তার প্রায়শ্চিত্ত।