Poush Mela Ground

ফিরে আসুক পৌষমেলা

অন্য কাউকে পৌষমেলা আয়োজনের অনুমতি দিলে বিশ্বভারতীর যে আশঙ্কা থাকা স্বাভাবিক, তা হল এই মেলার মূল চরিত্র হারিয়ে ফেলার চিন্তা। সেই জড়তা অতিক্রম করার যুক্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

Advertisement

নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:১৪
Share:

আন্তরিক: মেলা যাত্রী, নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি। ছবি: বিশ্বভারতীর সৌজন্যে।

নেশন কী, সেই আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “নেশন একটি সজীব সত্তা, একটি মানস পদার্থ।” এই অভিধা অনায়াসে বিশ্বভারতী ও তার শতাব্দীপ্রাচীন পৌষমেলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য: যার একটা অতীত ও বর্তমান আছে, যার বিবর্তন স্বাভাবিক, এবং যার সঙ্গে মনের একটা যোগ রয়েছে। শান্তিনিকেতনে ৭ পৌষের উৎসব বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “সত্য যেখানে সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায় সেইখানেই উৎসব। সে প্রকাশ কবেই বা বন্ধ আছে।” তিন বছরের অনভিপ্রেত বিরতির পর, ৭ পৌষ ফিরে আসছে শান্তিনিকেতন পৌষমেলা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এক ন্যাসপত্রে শান্তিনিকেতনের ‘ট্রাস্টি’বৃন্দকে ধর্মভাব উদ্দীপনের জন্য বছরে বছরে একটি মেলা বসাবার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। বহু বছর ‘পৌষ উৎসব’-এর অঙ্গ হিসাবে এই মেলার আয়োজন করে এসেছে ‘শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট’।

Advertisement

বিশ্বভারতী নিজের মাঠে মেলা না করার সিদ্ধান্ত নিলে, গণ আবেগ, স্থানীয় অর্থনীতি ও ঐতিহ্যের দায় গ্রহণ করে গত তিন বছর বোলপুরে বিকল্প পৌষমেলার আয়োজনের পর বিশ্বভারতীর মাঠে এ বছর মেলা আয়োজনের সম্মতি পেয়েছে বীরভূম জেলা প্রশাসন। সাম্প্রতিক অতীতে মেলা পরিচালনা করতে গিয়ে বিশ্বভারতী কিছু আইনি জটিলতায় বিদ্ধ হয়েছে, যার মূলে রয়েছে নির্দিষ্ট দিনে মেলা শেষ করে, কঠিন বর্জ্য নিষ্কাশন করে, পরিবেশগত ভারসাম্য বজায়ের প্রশ্ন। আশার কথা, এ বছর সেই সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে, মেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত না নিয়ে পরম্পরা রক্ষায় উৎসাহী বীরভূম জেলা প্রশাসনকে এই প্রথম নিজস্ব প্রাঙ্গণে মেলা করার অনুমতি দিয়েছে বিশ্বভারতী। পৌষমেলার আয়োজনে জেলা প্রশাসনের সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ যোগদান নতুন নয়। এ বার তফাত— এই মেলার আয়োজক জেলা প্রশাসন নিজেই। শান্তিনিকেতনের মাঠে, পরিবেশ আদালতের নির্দেশ ও বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য অনুসরণে এ বছর পৌষমেলার আয়োজন যেন একটা নতুন ‘মডেল’-এর পরীক্ষা, যার উপর ভবিষ্যতে আবার এই মাঠে পৌষমেলা বসানোর সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে।

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দুর্গতির নিরসন ঘটিয়েছিল স্বাধীন ভারতে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিশ্বভারতীর স্বীকৃতি। ‘কন্‌স্টিট্যুশনের রাস্তা বেয়ে’ বিশ্বভারতীর ‘কর্তৃত্ব অধিকার’ করতে আসা প্রশাসকদের ‘গোলমাল পাকানো’র, তাঁর অবর্তমানে সেখানে ‘পাঁচ ভূতের’ ‘কীর্তন’-এর যে করুণ আশঙ্কা তিনি লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন, বিশ্বভারতী বার বার তা বাস্তবে প্রত্যক্ষ করেছে। পঠনপাঠনের অভিনবত্ব ছাড়াও, শান্তিনিকেতন আশ্রমে স্থাপত্য, চারুকলা, ভাস্কর্য, নৃত্য-গীত, নান্দনিকতার যে অনুপম ঐতিহ্য রবীন্দ্রনাথ রচনা করে গিয়েছিলেন, তার দায় তিনি এক রকম সমর্পণ করে গিয়েছিলেন অনির্দিষ্টের হাতেই।

Advertisement

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার বর্ষে আমেরিকা ভ্রমণের সময় সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “আমাদের শান্তিনিকেতন আয়তনে ছোট কিন্তু সমস্ত নিউইয়র্কের চেয়ে অনেক বড় একথা সেখানে থেকে তোমরা ঠিক বুঝতে পারবে না।” বিশ্বজগৎ ও মানবতা-কেন্দ্রিক জীবনের যে উচ্চ আদর্শ-চর্চার কেন্দ্র হিসাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষায়তনের প্রতিষ্ঠা করেন, সেই ভাবনার মানদণ্ডেই তিনি শান্তিনিকেতনের ‘বিশালত্ব’ জরিপ করেছিলেন। যে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের আদর্শগত ও আধ্যাত্মিক ব্যাপ্তির বিষয়ে এত নিশ্চিত, তিনি কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন, শান্তিনিকেতনের ভৌগোলিক আয়তনগত ক্ষুদ্রতা এক দিন বিশ্বভারতীর অশেষ বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠবে? এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিপুল সংখ্যক পর্যটকের কথা মাথায় রেখে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতন আশ্রমের উৎসব-অনুষ্ঠান বা দারিদ্রক্লিষ্ট আশ্রমের বাড়িঘরগুলো পরিকল্পিত হয়নি।

মহর্ষি ১৮৬৩-তে রুক্ষ বীরভূমের প্রান্তরে ছাতিমের ছায়ায় ধ্যানের একাকী আসন পেতেছিলেন। পরে সেখানেই প্রতিষ্ঠা শান্তিনিকেতন আশ্রমের। রবীন্দ্রনাথ পাঁচ ছাত্রকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ১৯০১-এ স্থাপন করলেন এক আশ্রম-বিদ্যালয়। কলেবর বৃদ্ধি হয়ে ১৯২১-এ তা হয়ে উঠল বিশ্বভারতী। মহর্ষির ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষার দিন ও শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাদিবস হিসাবে ৭ পৌষের গুরুত্বের কথা রবীন্দ্রনাথ বার বার স্মরণ করেছেন। লিখেছেন, “মহর্ষির ৭ই পৌষের দীক্ষার উপরে আত্মার দীপ্তি পড়েছিল, তাঁর উপরে ভূত ভবিষ্যতের যিনি ঈশান তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। এই জন্যে সেই দীক্ষা ভিতরে থেকে তাঁর জীবনকে... সর্বদেশ সর্বকালের দিকে উদ্‌ঘাটিত করে দিয়েছে। এবং সেই ৭ই পৌষ এই শান্তিনিকেতন আশ্রমকে সৃষ্টি করেছে এবং এখনও প্রতিদিন একে সৃষ্টি করে তুলছে।” বিশ্বভারতী-ভাবনায় ৭ পৌষকে ঘিরে প্রবর্তিত পৌষ-উৎসব বা বসন্তোৎসবের মতো অনুষ্ঠানগুলোর তাৎপর্য অসীম। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নিয়ন্ত্রণহীন ক্রমবর্ধমান জনসমাগমে, নিরাপত্তা ও পরিকাঠামোর অভাবে, শিক্ষার পরিবেশ বাঁচানোর তাগিদে এই উৎসবগুলো বন্ধ করে বিশ্বভারতী নিশ্চিন্ত হলেও বিবেকের কাছে ভারমুক্ত হতে পারেনি। শান্তিনিকেতনে পৌষমেলার ফিরে আসা তাই জরুরি।

কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক ও শিক্ষা মন্ত্রকের সহায়তায় বিশ্বভারতী তার সাংস্কৃতিক সম্পদের, বিশেষত আশ্রমের সাংস্কৃতিক সৌধগুলির যথাযথ সংরক্ষণ করে চলেছে। ‘বিশ্ব-ঐতিহ্য প্রাঙ্গণ’ হিসাবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি শান্তিনিকেতনের প্রহরী বিশ্বভারতীর দায়িত্ব ও দুর্ভাবনা বাড়িয়ে তুলেছে। পঠনপাঠনের পরিবেশ, সাংস্কৃতিক, নান্দনিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে কী ভাবে পর্যটনের সামঞ্জস্যবিধান করা যায়, তা-ই সম্ভবত এখন বিশ্বভারতীর অন্যতম বিবেচনার বিষয়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে, সর্বোপরি বীরভূম জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ যোগাযোগ রক্ষা করে এই দুরূহ সমস্যা সমাধানের কথা খোলা মনে পরিকল্পনা করাই এখন বিশ্বভারতীর পক্ষে সমীচীন বলে মনে হয়। বন্ধ-হওয়া পৌষমেলা ও বসন্তোৎসবের মতো অনুষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য, শান্তিনিকেতনের ক্রমবর্ধমান পর্যটক ও যানবাহনের ভিড় সামলানোর জন্য, চার পাশের অসংখ্য নিয়ম-বহির্ভূত নির্মাণে রাশ টানার জন্য, এলাকার সামগ্রিক পরিচ্ছন্নতার জন্য, পঠনপাঠনের ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় পর্যটন পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য বীরভূম জেলা প্রশাসন যদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসে, বা বিশ্বভারতী তার দ্বারস্থ হয়, তাতে কোনও পক্ষের ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা’ না থাকাই শ্রেয়।

‘শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট’ই হোক বা বিশ্বভারতী, বীরভূম জেলা প্রশাসনই হোক বা আর কেউ— বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রে এই মাঠে মেলার যে কোনও আয়োজকের সামনে সম্ভাব্য সঙ্কটগুলি মোটের উপর একই। সেগুলি সমাধানের ইচ্ছা, আর্থিক সঙ্গতি, ক্ষমতা ও পদ্ধতি ভিন্ন হতেই পারে। এ সবের বাইরে, প্রথা ভেঙে ‘শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট’ ছাড়া আর কাউকে শান্তিনিকেতনের মেলা প্রাঙ্গণে পৌষমেলা আয়োজনের অনুমতি দিলে বিশ্বভারতীর যে আশঙ্কা থাকা স্বাভাবিক, তা হল এই মেলার মূল চরিত্র হারিয়ে ফেলার চিন্তা। একটু ভেবে দেখলে সেই জড়তা অতিক্রম করার যুক্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। প্রশ্ন করাই যায়, মেলার অভিনবত্বগুলো কী?

১৮৯৪-এ প্রবর্তিত এ মেলায় রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী কালে চেষ্টা করেছিলেন আড়ালে থাকা গ্রামীণ কারিগর ও লোকশিল্পীদের সৃজন-সম্ভার বৃহত্তর অঙ্গনে তুলে ধরার সুযোগ করে দিতে। ক্রমে পৌষমেলা তার সেই চরিত্র হারিয়েছে। লোকসংস্কৃতি এই মেলার বিনোদনমঞ্চ আলো করে থাকলেও হতদরিদ্র গ্রামীণ কারিগরেরা বছরের পর বছর তাঁদের শিল্পকর্মের পসরা সাজিয়ে, পৌষমেলার পথে পথে পরিবার পরিজন-সহ চূড়ান্ত দুর্ভোগ সয়ে মেলায় যোগদান করছেন। কবির প্রতিষ্ঠানের প্রচারিত ‘উচ্চ আদর্শ’ মেলা প্রাঙ্গণে এই অসহায় গ্রামীণ শিল্পীদের মাথায় ডিসেম্বরের ঠান্ডায় একটা আচ্ছাদন নিশ্চিত করতে পারেনি। আর পাঁচটা শহুরে মেলার মতোই হালের পৌষমেলায় বিত্ত-বৈভবই চকচক করে। ব্যবহার-উপযোগিতা ও ‘প্রয়োজন’-এর সঙ্গে ‘সুন্দর’ ও মানবিকতা কোথাও যেন মেলায় নিজেদের দূরত্ব বাড়িয়েছে। সময়ের ছন্দে তাল মেলালেও পৌষমেলা তার আদি গ্রামীণ চরিত্র ও সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলবে না, যে কোনও আয়োজকের থেকে এই আশাই এখন সবচেয়ে বড়।

পৌষমেলা বললেই যে সব অনিবার্য ছবি মনে ভেসে আসে, তার অন্যতম পূর্বপল্লির মাঠে গ্রামীণ কারিগরের দল, বিনোদনমঞ্চে লোকসংস্কৃতির অবিরাম উপস্থিতি, রাতে আতশবাজির সমারোহ, ‘মদ্য-মাংস’হীন, পৌত্তলিক আরাধনাহীন, ‘কুৎসিত আমোদ-উল্লাস’হীন মেলা প্রাঙ্গণ, সেই সঙ্গে প্রাক্তনীদের আনাগোনা ও বিশ্বভারতীর প্রদর্শনী, যার মুখ্য আকর্ষণ বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ ও শিল্পসদনের সম্ভার, উদ্যানবিভাগের শীতের ফুল, বিশ্বভারতীর নানা বিভাগের সৃষ্টিশীলতার উপস্থাপন। মেলা অফিস থেকে ভেসে আসা নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা কখন যেন ওতপ্রোত জড়িয়ে গিয়েছে তার সঙ্গে। পৌষমেলার আনন্দসাগরে হারায় অনেকেই, ফেরেও প্রিয়জনের কাছে। প্রাণের উৎসবে যে মন চায়, “সবার সাথে মিলাও আমায়, ভুলাও অহঙ্কার,/ খুলাও রুদ্ধদ্বার...।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement