Smartphone

মুঠোফোনে মগ্ন, একা

যত মোলায়েম ও মসৃণ হচ্ছে এই ডিজিটাল যাপন, বিপণন ও ব্যবস্থাপনা, ততই ছিঁড়ে যাচ্ছে মানুষে মানুষে মুখোমুখি সংযোগের সুতো।

Advertisement

শ্রীদীপ

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:৩২
Share:

প্রতীকী ছবি।

কালো প্যান্ট পরা দুটো লোক। বুটের খটাখট শব্দ। তার পর সংলাপ: “সাত নম্বর যতীন দাস লেনটা কোথায় একটু দেখিয়ে দেবে খোকা?” পাশের জন বলল, “আমরা বালুচিস্তান থেকে আসছি কিনা!” মোবাইল-উত্তর যুগে সোনার কেল্লা লেখা হলে মন্দার বোসের এ সংলাপ নিশ্চয়ই বাদ যেত, ডক্টর হাজরাকেও অযথা প্রশ্ন করতে হত না। গুগল ম্যাপ আছে তো! একটু ভাবলেই ঝুড়ি ঝুড়ি উদাহরণ পাব, যেখানে প্রযুক্তির প্রকোপে নিঃশেষিত হচ্ছে পাশের মানুষটির সঙ্গে কথা বলার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন, তাগিদ, ইচ্ছে। মেট্রোয়, ময়দানে বা মধুচন্দ্রিমার রাতে, আধো নিদ্রায় ও জাগরণে মুঠোফোন আমাদের গ্রাস করেছে। তা সম্পন্ন হয়েছে চিরাচরিত সামাজিকতার পথগুলি সঙ্কীর্ণ করেই।

Advertisement

পাশে-বসা অপরিচিতার সঙ্গে এ কথা-সে কথায় না গিয়ে, আমরা ডুবে আছি ডেটিং অ্যাপের ভার্চুয়াল বাছাইয়ে। পাশের সিটের লোকটির সঙ্গে আলাপে না গিয়ে বরং দেখে নিচ্ছি স্টেটাস আপডেট ক’জনের চোখে পড়ল, ক’টা লাইক বাড়ল, কে কী লিখলেন। ব্যাঙ্কের কর্মী, পাঠাগারের দিদিমণি, পাড়ার মুদি, মাছওয়ালা, সেলুনদাদা, ট্যাক্সিচালক, রোলের দোকানের ছোকরা— আরও বহু মানুষের থেকে দূরে চলে যাচ্ছি, কারণ আদানপ্রদান আজ মানবশূন্য অনলাইন-প্রক্রিয়ায় বা অ্যাপ-মারফত কোনও অচেনা ব্যক্তির দ্বারা, যাকে বা যাদের চেনার বা জানার কোনও আগ্রহ বা প্রয়োজন নেই আমাদের।

মস্তিষ্কে কম চাপ ফেলে এমন ‘কনটেন্ট’ গিলছি, পাঠাচ্ছি। পেশি সঞ্চালন না করে, কাদা না মেখে, পছন্দের টিম ও তারকা বেছে রিমোট-হাতে, পিৎজ়ায় লালিত হয়ে, ঠান্ডা ঘরে পর্দার গেমে গোল দিচ্ছি, মারছি দুর্বৃত্তকে। সম্পর্কের জটিলতা এড়িয়ে ভার্চুয়াল-রিয়ালিটি উপহার দিচ্ছে স্পর্শহীন অতিবাস্তবিক যৌন উত্তেজনা। এত কিছু দেখছি ও দেখাচ্ছি, কিন্তু কিছুই মনে গাঁথছে না আলাদা করে, এলোমেলো চোখ আর হাত বুলিয়ে যাচ্ছি শুধু। অকারণে ব্যস্ত রাখছি নিজেদের। স্থান-কাল-পাত্র থেকে মনোযোগ উঠিয়ে তা উজাড় করে দিচ্ছি মুঠোফোনে। এমনই আমাদের আত্মসমর্পণ।

Advertisement

গোটা দিন, দিনের পর দিন কাটছে এই জগতের অংশীদার হয়ে। মাত্র এক দশকের মধ্যে হয়ে উঠেছি মুঠোফোন-সর্বস্ব। এক অদ্ভুত আকর্ষণে, অজানতেই চোখ আঙুল মন চলে যাচ্ছে সেই দূরবর্তী দুনিয়ার টানে। মুঠোফোন-মনা মানুষের অস্তিত্ব ও সত্তা নির্ধারণ করছে অফুরন্ত কনটেন্ট, অগুনতি আপডেট। ডিজিটাল যোগাযোগ মুহূর্তের জন্য বিচ্ছিন্ন হলেই মন আনচান, এই বুঝি কিছু ফস্কে গেল। ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’— তীব্র এক অস্থিরতা ও উদ্বেগ: যদি বাদ পড়ে যাই, যদি চোখ এড়িয়ে যায় কিছু!

সামাজিকতার ভঙ্গি ও তার বহিঃপ্রকাশ আমূল পাল্টে দিয়েছে মুঠোফোন-কেন্দ্রিক আদানপ্রদান। অহরহ নিজেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে পেশ করার সুযোগ যতই সহজলভ্য হয়েছে, মানুষে মানুষে দূরত্ব বেড়েছে তত। সমাজমাধ্যমে লাইক কমেন্ট সেলফির আতিশয্য, ফরোয়ার্ডের বাড়াবাড়ি ছেঁটে ফেলছে মানুষের মুখোমুখি সামাজিকতার মুহূর্তগুলিকে। ফেসবুক-সামাজিকতায় যখন কাজ চলে যাচ্ছে, তখন সামনাসামনি দেখা কম হলেই বা ক্ষতি কী? ঘরে বসেই চাখা যাচ্ছে বাইরের খাবারের সুখ, মিলছে আমোদের সব ব্যবস্থা। কমে আসছে বাড়ির বাইরের জগতের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। আহার থেকে বাহার, বাজার থেকে ব্যাঙ্কিং, বাথরুম পরিষ্কার থেকে বারান্দার বাগান, সঙ্গীত থেকে চলচ্চিত্র, সংবিধান থেকে সংস্কৃতি, ট্যাক্সি থেকে হোটেল, রূপচর্চা থেকে রূপের প্রদর্শন, প্রেম থেকে যৌনতা— সব কিছুর জন্যই তৈরি আলাদা আলাদা অ্যাপ। এক দশক আগেও কেউ ভাবেনি, পকেটের ছোট্ট একটা যন্ত্র এত কিছু করবে। চার দেওয়ালের আড়ালে শুয়ে-বসে, দরদামে না গিয়ে, বিনা বাক্যব্যয়ে সব কিছুই হয়ে যাচ্ছে আঙুলের ইশারায়, নিঃশব্দে।

যত মোলায়েম ও মসৃণ হচ্ছে এই ডিজিটাল যাপন, বিপণন ও ব্যবস্থাপনা, ততই ছিঁড়ে যাচ্ছে মানুষে মানুষে মুখোমুখি সংযোগের সুতো। অলক্ষে ততই বাড়ছে একাকিত্বের, বিচ্ছিন্নতার ভার। আর তা হচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে, যেমনটা আগে কখনও হয়নি। মানব-সংযোগের আঙ্গিক পাল্টে দিয়েছে মুঠোফোন। তা ভাল না খারাপ, প্রশ্ন সেটা নয়। সমাজ পর্যবেক্ষণে বা বিশ্লেষণে নীতিগত বিচারের কোনও জায়গা নেই। প্রয়োজন আছে এই পরিবর্তনগুলোকে গভীরে গিয়ে উপলব্ধির, যুক্তি দিয়ে তার ব্যাখ্যার।

এই যাত্রায় আমাদের গতিপথ একান্তই অন্তর্মুখী। ডিজিটাল দুনিয়া মানুষকে মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে, আপাত-নিকটে এনে, তার পর দূরে ঠেলে দিচ্ছে। সগৌরবে সবাইকে জানিয়ে নিরালা সফরে যাচ্ছে মানুষ। এক সঙ্গে থাকার পূর্বনির্ধারিত শর্তেও এখন একে অপরকে পর্যাপ্ত ‘স্পেস’ দেওয়ার দায়বদ্ধতা, বা কোনও রকম দায়বদ্ধতা ছাড়াই মেলামেশার অবাধ সুযোগ। সেখানে পান থেকে চুন খসলেই নির্দ্বিধায় ‘আনফ্রেন্ড’, ‘আনফলো’, ‘ব্লক’। প্রযুক্তির থেকে আজ এতই বেশি চাইছি, সামনের রক্তমাংসের মানুষটার থেকেও তত নয়!

সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement