উনিশ শতকের শেষ দশক। কেমব্রিজ-শিক্ষিত উদ্যমী তরুণ কেশবরাও গণেশ দেশপান্ডে তখন বম্বে থেকে প্রকাশিত হিন্দি-ইংরেজি দ্বিভাষিক সাপ্তাহিক পত্রিকা ইন্দুপ্রকাশ-এর সম্পাদনা করছিলেন। ১৮৯৩ সালের অগস্ট মাস থেকে সেই পত্রিকায় ‘নিউ ল্যাম্প্স ফর ওল্ড’ শীর্ষনামে ধারাবাহিক ভাবে কয়েকটি নিবন্ধ লিখতে শুরু করলেন দেশপান্ডেরই কেমব্রিজ-বান্ধব, মাস কয়েক আগেই দেশে প্রত্যাগত আইসিএস-ত্যাগী অরবিন্দ ঘোষ (ছবি)। রাজনারায়ণ বসুর দৌহিত্র অরবিন্দ উজ্জ্বল ছাত্র, কবি, পেশায় সয়াজিরাও গায়কোয়াড়-শাসিত বরোদা রাজ্যের রাজস্ব দফতরের কর্মী। ধীরস্থির জীবন তাঁর, কিন্তু সমসাময়িক ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা তাঁকে বিচলিত করে, উদ্বিগ্ন করে।
‘নিউ ল্যাম্প্স ফর ওল্ড’, এ নামের ভিতরেই এক প্রতিস্থাপনের ইশারা ছিল। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আট বছর হয়েছে তখন। অরবিন্দ তত দিনে, চোদ্দো বছর ইংল্যান্ডে থেকেও, বুঝে গিয়েছেন, কংগ্রেস বস্তুত গুটিকয় এলিট ভারতীয় ও তাঁদের ব্রিটিশ সহযোগীদের দল, যাঁরা ‘প্রার্থনা ও প্রস্তাব’ ছাড়া কিছু করবেন না। অরবিন্দ-র নিবন্ধগুচ্ছের উদ্দেশ্যই ছিল এই দুর্বল, শ্লথ মানসিকতা ও কর্মপদ্ধতির তীব্র, কঠোর সমালোচনা করা।
আজ বোঝা যায়, জাতীয়তাবাদের উন্মেষলগ্ন থেকেই কী আশ্চর্য আধুনিক ছিলেন অরবিন্দ। না-হলে যে যুগে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতা রানি ভিক্টোরিয়াকে ‘আমাদের মাতা’ আখ্যায় সম্বোধন করতেন, সে যুগে কে-ই বা বলতে পারতেন এমন করে— ইংরেজদের কাছ থেকে আমরা কী করে প্রত্যাশা করছি যে, ওরা আমাদের হিতকারী হবে! ওরা তো এসেছে শাসন করতে, শোষণ করতে, বণিকসুলভ মনোভাবে তাড়িত হয়েই। অরবিন্দ-চিহ্নিত প্রতিরোধের রূপরেখা ছিল, প্রথমে আমাদের আত্মকে পুনর্গঠন করা, যে-আত্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে ঔপনিবেশিক আবহ। তার পর, স্পর্শ করা ‘দ্য সাইলেন্ট অ্যান্ড সাফারিং পিপল অব ইন্ডিয়া’-কে। অরবিন্দ লিখেছিলেন, আমাদের শত্রু আমাদের শরীরের বাইরে নেই, আছে ভিতরেই— আমাদের কাপুরুষতা, স্বার্থপরতা, দ্বিচারিতা, আমাদের প্রায়ান্ধ আবেগবিহ্বলতা। ইতিহাসের আবর্তে, এই একই শব্দের, একই ভাবের অনুরণন ধ্বনিত হবে ফের, কয়েক বছর পরেই, যখন স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বর্তমান ভারত-এ লিখবেন সেই কথাগুলি, “সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল— আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল— মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই... বল দিনরাত... আমার দুর্বলতা, কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ কর।”
অরবিন্দ ছিলেন অনেকের আগে। দুর্ভাগ্য, কয়েক জন ছাড়া অধিকাংশ ইতিহাস-রচনাকারই তাঁর প্রতি এক পূর্ব-প্রোথিত, প্রচলিত ধারণা নিয়েই এগিয়েছেন। যদি এমনটা না-করতেন তাঁরা, তা হলে দেখতে পেতেন, দেখাতেও পারতেন, অরবিন্দ ঘোষই সম্ভবত প্রথম ভারতীয় যিনি ওই ১৮৯৩ সালে ‘প্রোলেতারিয়েত’ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, যখন এই শব্দের কোনও পরিচিত প্রচলনই ছিল না এ দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক সংস্কৃতিতে। এবং সেই ব্যবহার তৎকালীন ইউরোপীয় মার্ক্সিজ়ম-কমিউনিজ়ম বা উত্তরকালের ভারতীয়-বঙ্গীয় কমিউনিস্টদের ব্যবহার থেকে দূরের নয়, বরং চমকে দেওয়ার মতো কাছের। প্রোলেতারিয়েত, অরবিন্দর ভাষায়, ‘দ্য গ্রেট মাস অব দ্য পিপল’, যাদের কথা সকলে বললেও কেউ-ই তাদের নিয়ে যথার্থরূপে ভাবিত নন। এই সাধারণ জনগণের মধ্যেই অরবিন্দ দেখেছেন ভবিষ্যতের আশা, তারাই ‘দ্য রিয়েল কি অব দ্য সিচুয়েশন’। ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো বাইশ বছরের যুবক অরবিন্দ লিখতে পেরেছিলেন, প্রোলেতারিয়েতদের মধ্যে নিহিত ক্ষমতা ও সম্ভাবনা যিনি উপলব্ধি করতে পারবেন, যিনি তাদের শক্তিকে বার করে আনতে পারবেন, তিনিই হয়ে উঠবেন আগামীর চালক, ‘দ্য মাস্টার অব দ্য ফিউচার’। নভেম্বর বিপ্লব তখনও কল্পনাতীত। ইতিহাসবিদরা অরবিন্দ-অনুধ্যানের সময় এ দিকে প্রবেশই করেন না। তাঁরা কেবল বিস্ময় বোধ করেই থেমে যান যে, অগ্নিযুগের ফায়ারব্র্যান্ড বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ কী করে যোগী শ্রীঅরবিন্দয় পরিণত হলেন। লঘু চালে যাকে অনেকেই বলেছেন ‘বোম থেকে ওম’। আর এই সূত্রে ঢুকে এসেছে— কালবিপর্যয় ঘটিয়েই— অরবিন্দর সঙ্গে হিন্দুবাদী রাজনীতির যোগ। এর অন্যতম উৎস, অরবিন্দর বিখ্যাত উত্তরপাড়া অভিভাষণ (১৯০৯), যেখানে তিনি বলেছিলেন, সনাতন ধর্মই জাতীয়তাবাদ। সমস্যার বীজ এখানেই। সনাতন ধর্ম কেন বলেছিলেন তিনি। এ-কথা উচ্চারণ সাম্প্রদায়িকতাকে এক প্রকার প্রশ্রয়েরই নামান্তর, অভিযোগ করেন এক মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক। আর এক জন জানালেন, অরবিন্দর জাতীয়তাবাদ-রাজনীতিচিন্তা রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীর মতো উদার হতে পারেনি।
নিরপেক্ষ ইতিহাস পর্যবেক্ষণ জানাবে, দুই ভাবনাই ভ্রান্ত। হিন্দুত্ববাদী বা হিন্দুবাদী যে সাম্প্রদায়িকতার সাক্ষী আমরা অনতিঅতীত ইতিহাসে হয়েছি, তার কাঠামো অতি নবীন এক নির্মাণ। এই আলোকে অরবিন্দ-কথিত সনাতন ধর্ম বিচার করলে তা শুধুমাত্র মেধাচর্চার বিপুল ব্যর্থতাই নয়, ইতিহাস-আশ্রিত ‘ইম্যাজিনেশন’-এরও চরম ব্যর্থতা। অরবিন্দর সনাতন ধর্ম কিন্তু আবহমান মানুষের ধর্ম। এর কোনও সীমানা-সীমান্ত নেই, ভেদ-অভেদ নেই। এ ধর্ম হল এক ‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন হুইচ এমব্রেসেস অল আদার্স’। ইতিহাসবিদ সুগত বসু অরবিন্দ-বিষয়ক তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, অরবিন্দর সনাতন ধর্ম-য় আসলে প্রোজ্জ্বল এক বিকল্প সার্বভৌমত্বের সন্ধান। অরবিন্দ বলেছিলেন, যে ধর্ম সঙ্কীর্ণ, সাম্প্রদায়িক, অনুদার তা কখনও বিশ্বজনীন হতে পারে না, সনাতনও হতে পারে না।
অথচ, এই দিকটিতে যথেষ্ট গুরুত্ব না দিয়ে প্রথাগত আলোচনায় অরবিন্দকে যেন ঠেলে দেওয়া হল হিন্দুত্ববাদীদের হাতেই। যে অরবিন্দ আলিপুর বোমা মামলার রায় প্রকাশের পরও লর্ড মিন্টোর মতে ছিলেন ‘দ্য মোস্ট ডেঞ্জারাস ম্যান উই হ্যাভ টু ডিল উইথ’, সেই বিপ্লবীর যোগী বা ‘ঋষি’ অরবিন্দ’তে যাত্রা অনেকের কাছে স্রেফ পলায়ন, অনেকের কাছে ব্রিটিশ শাসকের ‘কোলাবোরেটর’ হওয়া, অনেকের কাছে অবোধগম্য এক আত্মকেন্দ্রিক উল্লম্ফন। চিন্তার দৈন্য, ইতিহাস-অসচেতনতা (শিবরাম চক্রবর্তীও ব্যতিক্রম নন। তাঁর মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী-তে আবেগ আছে, রস আছে, ইতিহাস নেই) থেকেই বোঝা যায়নি যে, অরবিন্দ ঘোষ আর শ্রীঅরবিন্দ কোনও খণ্ডিত, বিভাজিত ব্যক্তি নন। বাহ্যিকস্তরে তাঁর জীবন দু’টি পর্বে বিভক্ত, কিন্তু তাঁর অন্তর্জীবনে কোনও ছেদ ছিল না। ছিল একটি অখণ্ড চেতনাতরঙ্গ। তাঁর রচিত-ভাবিত পূর্ণযোগ বা দিব্যজীবন রহস্যাবৃত, জটিল অধ্যাত্ম-তত্ত্ব নয়, তা মানবজীবনকে বৃহত্তর এক মননের সঙ্গে যোগ করার অতিমানসিক প্রয়াস। সেখানেও তিনি বিপ্লবী। ভারতীয় দর্শনমার্গে তাঁর যোগ-দর্শন— বৈপ্লবিক।
মূল ধারার রাজনীতিতেও এক অকৃত্রিম আদিপুরুষ অরবিন্দ। ভারতীয় গণপরিসরে এমন এক ধারণার জন্ম তিনি দিয়েছিলেন যার উত্তর-সাধনা ভারতকে পৌঁছে দিয়েছিল স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, ‘প্যাসিভ রেজ়িস্ট্যান্স’, নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ। মোহনদাস গান্ধীর মাধ্যমে এর পূর্ণতর প্রয়োগ ঘটেছিল। কিন্তু গান্ধীর অহিংস-নীতি আর অরবিন্দর নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ নীতিতে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য ছিল। অরবিন্দর উষ্মা প্রকাশ, “গান্ধী কি করছেন? অহিংসা পরম ধর্ম্ম, jainism, হরতাল, passive resistance ইত্যাদির খিচুড়ি করে সত্যাগ্রহ বলে একরকম Indianised Tolstoyism দেশে আনছেন।” গান্ধীর অহিংসা কখনওই হিংসাত্মক হয় না, অরবিন্দ একটি জানলা খোলা রেখেছিলেন সহিংস প্রতিবাদের। এখানেই তাঁর বিশেষত্ব, তাঁর স্বাতন্ত্র্য। তাঁর আন্তর্জাতিকতাও। সমগ্র বিংশ শতক একাধিক নেতার সাক্ষী থেকেছে যাঁরা ‘কমিশন অ্যান্ড অমিশন’ পন্থা বা গেরিলা-মিলিট্যান্ট যুদ্ধে আস্থা রেখেছেন স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে। অরবিন্দ বহু আগেই তেমন সব ভাবনাচিন্তা ও কাজ করে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে তাই তো তিনি একাধারে রুদ্রদূত, আবার ‘স্বদেশ-আত্মার বাণীমূর্তি’ও। ডোমিনিয়ন স্টেটাস, ব্রিটিশ অধীন স্বায়ত্তশাসন নয়, অরবিন্দ সেই কবে ডাক দিয়েছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতার। ধর্ম্ম পত্রিকায় (১৯০৯) লিখেছিলেন, “আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা চাই, বিদেশীর আদেশ ও বন্ধন হইতে সম্পূর্ণ মুক্তি, স্বগৃহে প্রজার সম্পূর্ণ আধিপত্য, ইহাই আমাদের রাজনীতিক লক্ষ্য।” কংগ্রেসের আরও দু’দশক লেগেছিল সম্পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্য সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করতে।
‘হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো’, গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন। কত জন জানেন যে, অনুরূপ একটি বাক্য উপস্থিত অরবিন্দর তার আগের একটি লেখায়? বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৯৪) রচনায় তিনি লিখেছিলেন, “হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুমরো, ইন্ডিয়া উইল বি থিঙ্কিং টুমরো উইক”; বাংলা আগামী কাল যা ভাববে, ভারত তা ভাববে সে-আগামীর পরের দিন। তিনি বুঝেছিলেন, “আমাদের সভ্যতা হয়ে গেছে অচলায়তন, ধর্ম্ম বাহ্যের গোঁড়ামি, অধ্যাত্মভাব একটী ক্ষীণ আলোক বা ক্ষণিক উন্মাদনার তরঙ্গ। এই অবস্থা যতদিন থাকিবে, ভারতের স্থায়ী পুনরুত্থান অসম্ভব।”
এই ১৫ অগস্ট তাঁর সার্ধশতবর্ষ পূর্তি। আর স্বাধীন ভারতের পঁচাত্তর বছর পূর্তি। এই মুহূর্তে এর চেয়ে প্রাসঙ্গিক বাচন আর কী হতে পারে।