বার্থা বেনজ়। —ফাইল চিত্র।
মোটরগাড়িও পেট্রল খায়, তেল খায়, ধোঁয়া ছাড়ে, চার পায়ে দাপিয়ে বেড়ায়। জীবনের সব লক্ষণই তো বর্তমান। (‘একগুঁয়ে বার্থা’, পরশুরাম)। তবে তো মালিকের মৃত্যুর প্রতিশোধও নিতে পারে মোটরগাড়ি। যেমন নিয়েছিল একগুঁয়ে বার্থা। সে ছিল ‘জার্মান বার্থা কার, রোলস রয়েস তার কাছে লাগে না’ এই গাড়ির আসল মালিক ছিলেন সলিসিটর জলদ রায়, তাঁর স্ত্রী হেলেনা পালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরই বন্ধু কুমার ইন্দ্রপ্রতাপ সিংহের সঙ্গে। বার্থায় চড়ে ওঁদের পিছনে ধাওয়া করতে গিয়ে ইন্দ্রপ্রতাপের রাখা পাথরের চাঙড়ে ধাক্কা খেয়ে মারা পড়লেন জলদ রায়। বার্থাকে পরে কিনলেন মাখন মল্লিক। কিন্তু বার্থা ভোলেনি তার মালিকের সঙ্গে ঘটা অন্যায়ের কথা। সে প্রতিশোধ তুলল ইন্দ্রপ্রতাপকে খুন করে।
বার্থা গাড়ি যাঁর নাম বহন করছে সেই বার্থা বেনজ় (ছবি) মানুষটিও ছিলেন এমন একগুঁয়ে। তাঁর জন্ম জার্মানির এক ধনাঢ্য পরিবারে। জন্মের দিনই বাবা পারিবারিক বাইবেলে লিখেছিলেন ‘দুর্ভাগ্যক্রমে আবার একটা মেয়ে’। স্কুলে তাঁর পছন্দের বিষয় ছিল ন্যাচারাল সায়েন্স, বাবা যখন মোটরগাড়ি নিয়ে কথা বলতেন, সম্মোহিতের মতো শুনতেন মেয়েটি। কিন্তু এ সবের পরেও মেয়েদের জন্য বিয়ে আর সন্তানপালন ছাড়া কোনও পথ ভাবাই হত না তখনও। বিয়ে অবশ্য বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে করলেন বার্থা, কপর্দকহীন মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার কার্ল বেনজ়-কে, তেইশ বছর বয়সে, সালটা ছিল ১৮৭২। এর দু’বছর আগে নিজের টাকা তিনি দিয়েছিলেন কার্লকে তাঁর বেনজ় অ্যান্ড কোম্পানি তৈরির কাজে। এই কোম্পানির উচ্চাকাঙ্ক্ষী ফসল প্রথম বেনজ় পেটেন্ট মোটরওয়াগন ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বরে তৈরি হল। কেউ কিনছিল না তেমন। আসলে সেটা ছিল ঘোড়ার গাড়ির যুগ। ঘোড়াগাড়িতে অভ্যস্ত লোকে ইঞ্জিনচালিত মোটরগাড়িকে সন্দেহের চোখে দেখত।
সচেতনতা বাড়ল ধীরে ধীরে। ১৮৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি পত্রিকা ছিল মোটরগাড়ির প্রচারে খুব উৎসাহী। তারা লিখেছিল ‘ইন সিটিজ় অ্যান্ড ইন টাউন নয়েজ় অ্যান্ড ক্লাটার অব দ্য স্ট্রিটস উইল বি রিডিউসড বিকজ় অব কারস রাবার টায়ার।’ রাস্তায় ঘোড়ার খুরের শব্দ, তার পর ঘোড়ার পুরীষ দূষণের অন্যতম কারণ ছিল। এর নামই হয়ে গেছিল ‘গ্রেট ম্যানিয়োর ক্রাইসিস’ ১৮৭০ সালে লেখা হয় ম্যানহাটনের ব্রডওয়ে একদম যাতায়াতের অযোগ্য। তার কারণ ঘোড়ার পুরীষ। ট্রেন চালু হওয়ার পর তা আরও বেড়ে গেল। কারণ ট্রেন ধরার জন্য অপরিহার্য ছিল ঘোড়ার গাড়ি। সায়েন্টিফিক আমেরিকান লিখেছিল (১৮৯০), সপ্তাহে তিন চার দিন রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কার্পেটের মতো ছড়িয়ে থাকে পুরীষ। এর থেকে মাছি এবং রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছিল। এই ঘোড়ার গাড়ির জায়গায় যখন মোটরগাড়ি এল, তখন তার নামের মধ্যেও কিন্তু রয়ে গেল জীবন্ত চতুষ্পদটি— ‘হর্সলেস ক্যারেজ’। বাংলায় এখনও আমরা যন্ত্রচালিত যানবাহন বলতে যেমন গাড়িঘোড়া শব্দটা ব্যবহার করে থাকি।
যা-ই হোক, ঘোড়ার গাড়ির জন্য কার্ল বেনজ়-এর মোটরগাড়ি বিক্রি হচ্ছিল না তেমন। শেষে ১৮৮৮ সালের ৫ অগস্ট ভোরে, স্বামীর ঘুম না ভাঙিয়ে দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সেই তিন চাকার গাড়ি চড়ে বাপের বাড়ির দিকে রওনা হলেন বার্থা। বন্ধুর পথে টানা ১৫ ঘণ্টা, দূরত্ব হিসাবে ৬৬ মাইল। সে এক দুঃসাহসিক অভিযান। বার্থা শুধু বিশ্বের প্রথম নারী মোটরগাড়ি চালকই নন, তাঁকে বলা যায় প্রথম মোটর মেকানিকও।
একে তো গাড়ি চলাচলের জন্য উপযোগী রাস্তা ছিল না। পথে কোনও পেট্রল স্টেশন বা ওয়ার্কশপের প্রশ্নই নেই। যাত্রাপথে নানা সমস্যা, ইঞ্জিন গরম হচ্ছিল, পেট্রল শেষ, ব্রেক-শু খয়ে যাওয়া ইত্যাদি। পেট্রল শেষ হলে তিনি পথে যে ফার্মেসি থেকে বেনজ়িন কেনেন, তাকে বলা হয় বিশ্বের প্রথম পেট্রল পাম্প। ইঞ্জিনের তেলের লাইনে ময়লা জমে আটকে গেলে বার্থা বেনজ় তাঁর হ্যাট থেকে একটি পিন খুলে নিয়ে জায়গাটি পরিষ্কার করে নেন, এমনকি মোজার রাবার দিয়ে মেটান গরম ইঞ্জিনের সমস্যা।
শুধু কি মেকানিক? তিনি উদ্ভাবকও। মার্সিডিজ় বেনজ়-এর তথ্য অনুযায়ী তিনি মোটরগাড়ির নকশা নিয়েও অনেক ভাবনাচিন্তা করেছিলেন, যেমন ফুয়েল লাইন ডিজ়াইন, কাঠের ব্রেকে চামড়ার আস্তর লাগানোও তাঁর ভাবনার ফসল। পরামর্শ দিয়েছিলেন গাড়ি নিচু গিয়ারে ভাল চলবে।
এই ঘটনার পর মিউনিখে গাড়ির একটি প্রদর্শনীতে বেনজ় দম্পতি গোল্ড মেডেল অর্জন করেন। সেই সময়ের জার্মানির আইনে কোনও বিবাহিতা নারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারতেন না। কিন্তু শুধু উৎসাহ নয়, উদ্ভাবন ও প্রয়োগে বার্থা ছিলেন প্রকৃত অংশীদার। তাঁদের নির্মিত প্রতিষ্ঠান আজকের মার্সিডিজ় বেনজ়। বার্থা বেনজ়ের অবদান নিয়ে একটি চলচ্চিত্রও তৈরি করা হয়। বেগম রোকেয়া এক বার বলেছিলেন, কোনও শকটের (গাড়ির) দু’টি চাকা যদি সমান না হয়, তা হলে সেই গাড়ি চলতে পারে না।
অসমান চাকা নিয়ে গাড়িটি চালাতে গেলেই সেটি একই চক্রে শুধু ঘুরপাক খেতে থাকবে। আমাদের সমাজের দু’টি চাকা অর্থাৎ নারী ও পুরুষ ভীষণ ভাবে অসমান। এই অসাম্য আজও প্রকট। অটোমোবাইল শিল্পে মেয়েদের অতি সামান্য উপস্থিতি। শহরের রাস্তায় নারী-চালক আনুপাতিক হিসাবে অত্যন্ত কম, এবং যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রায়ই শুনতে হয় টিটকারি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ায় নারী ও গাড়ির তুলনা টেনে কদর্য রসিকতা।
অথচ ক’জন জানেন আজ মোটরগাড়ি শিল্প যে জায়গায় পৌঁছেছে, তার গোড়ায় আছেন ‘একগুঁয়ে বার্থা’ও— আছে একক এক নারীর মেধা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর ঝুঁকি নেওয়ার সাহস।