Imams

ইমাম ভাতার বদলে যা প্রয়োজন

বর্তমান সরকার অনেকাংশে খয়রাতি এবং ভাতার রাজনীতি বেছে নিয়েছে। এই স্ট্র্যাটেজির অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক ইমাম ভাতা প্রদান।

Advertisement

সেখ সাহেবুল হক

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৪:২৯
Share:

ইমামরা মসজিদে নামাজ পড়ান, মুয়াজ্জিনরা আজান দেন। —ফাইল চিত্র।

মুসলমানদের নানান সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বঞ্চনা তুলে ধরা হয়েছিল ২০০৬ সালে প্রকাশিত সাচার কমিটির রিপোর্টে। জনসমক্ষে এসেছিল মুসলিম সমাজের হাঁড়ির হাল। তার পর ২০১১ সালে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা। স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল যে, সরকার সার্বিক মানোন্নয়নে আন্তরিক উদ্যোগ করবে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের বঞ্চনাগুলোও দূর হবে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, সাচার কমিটির রিপোর্টের প্রায় সতেরো বছর পরও সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতির আশানুরূপ বদল হয়নি।

Advertisement

বর্তমান সরকার অনেকাংশে খয়রাতি এবং ভাতার রাজনীতি বেছে নিয়েছে। এই স্ট্র্যাটেজির অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক ইমাম ভাতা প্রদান। ইমামরা মসজিদে নামাজ পড়ান, মুয়াজ্জিনরা আজান দেন। মসজিদ কমিটির তরফে মুসল্লিদের থেকে চাঁদা তুলে এঁদের যৎসামান্য মাসিক পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করা হয়। শহরের নামজাদা মসজিদগুলি বাদ দিলে এই প্রাপ্য অর্থে মূল্যবৃদ্ধির বাজারে সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব। জনগণের করের টাকা খরচ না করে ওয়াকফ সম্পত্তির লভ্যাংশ থেকে ভাতা দেওয়া গেলে দারুণ পদক্ষেপ হত। এতে দু’টি দিক রক্ষিত হত। প্রথমত, ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহার করে ইমামদের একটু ভদ্রস্থ সাম্মানিক দেওয়া যেত, যা খয়রাত মনে হবে না। দ্বিতীয়ত, ইমাম ভাতাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিও বন্ধ হত।

সরকার চাইলে বিপুল ওয়াকফ সম্পত্তির পুনরুদ্ধার করে তার লভ্যাংশ থেকে ইমাম ভাতার বন্দোবস্ত করা খুব কঠিন নয়। দিল্লিতে ইমামরা মাসে ১৮০০০ টাকা এবং মুয়াজ্জিনরা ১৬০০০ টাকা করে পান। ওয়াকফ বোর্ড এই অর্থ সরকারের হাতে দেয়। সরকার বিতরণে সহায়তা করে। কিন্তু বাংলার সরকার একই পথে হাঁটে না কেন?

Advertisement

তার কারণ, ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তির লভ্যাংশ থেকে ইমাম ভাতা দেওয়া হলে সরকার সরাসরি কৃতিত্ব দাবি করতে পারবে না। সেই সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় ক্ষেত্রে ঢালাও অনুদানও প্রশ্নের মুখে পড়বে। কারণ তখন প্রশ্ন উঠবে— “ইমাম ভাতা তো ওয়াকফ বোর্ড দেয়, তা হলে পুজোয় বা মন্দিরের অনুদান সরকার রাজকোষ থেকে দেবে কেন?” গত কয়েক বছরে কোনও বিশেষ ধর্মের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে টাকা খরচ করা নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠেছে। উল্লেখ করা জরুরি যে, বাংলায় প্রায় ৩০০০০ ইমাম এবং ২০০০০ মুয়াজ্জিন প্রতি মাসে ইমাম ভাতা পান। সেই সঙ্গে প্রায় ৩২০০০ পুরোহিতকেও ভাতা দেওয়া হয়। কোষাগার থেকে ভাতা দিলে এক দিকে সংখ্যালঘুদের ‘আমরাই দিই’ বলে প্রভাবিত করা যায়, আবার উল্টো দিকে সংখ্যাগুরুকে তুষ্ট করার কৌশলও জনগণের চোখে মান্যতা পায়। ‘শ্যাম এবং কুল রক্ষা’ করে ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের রাজনীতি চালানো যায়।

সংখ্যালঘু জনসমর্থন হারিয়ে বামেদের কার্যত ভোটবাক্সে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া থেকে রাজ্যের ভোটের বাজারে সংখ্যালঘুদের গুরুত্ব বোঝা যায়। এ রাজ্যে বিজেপি এখনও জয়ের অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটাতে পারেনি, তাও মূলত সংখ্যালঘু ভোটের দৌলতে। সুতরাং ক্ষমতায় টিকে থাকতে যেন তেন প্রকারেণ ‘মুসলমানদের হাতে রাখতে হবে’। যার সহজ পন্থা ইমাম ভাতার রাজনীতি। গ্রামে-গঞ্জে-মফস্‌সলে ইমামরাই মুসলিম সমাজের অলিখিত নেতা। তাঁদের মতামত এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বড় ভূমিকা পালন করে। সরাসরি রাজনৈতিক প্রচার না করলেও মসজিদের চার দেওয়ালের বাইরে তাঁদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এই অবস্থায় ‘ইমামদের ভাতা আমরা দিচ্ছি’ মর্মে প্রচারের গুরুত্ব বিপুল।

সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৩ সালে জানায় যে, ওয়াকফ বোর্ড তাদের পরিচালিত মসজিদের ইমামদের ভাতা দিতে পারবে। সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী এ রাজ্যে ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা প্রায় ১,৪৮,২০০টি। যার আওতায় থাকা জমির পরিমাণ প্রায় ৫৯,০৯০ একর। এই বিপুল সম্পত্তি মুসলমান সমাজের উন্নতিকল্পে ব্যবহারের জন্যই। কিন্তু বাস্তবে ওয়াকফ সম্পত্তি আসল উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করা নিয়ে প্রশ্ন যেমন ওঠে, তেমনই নয়ছয় এবং জবরদখলের অভিযোগ বিস্তর। অথচ সরকার উদ্যোগী হলে এই সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত টাকাতেই ইমামদের সাম্মানিক দিয়ে রাজকোষের যে অর্থ ইমাম ভাতায় এত দিন ব্যয় হত, তা সংখ্যালঘুদের শিক্ষা এবং সার্বিক মানোন্নয়নে ব্যবহৃত হতে পারত।

গত এক দশকে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ অথৈ জলে। স্বাভাবিক পঠনপাঠন ব্যাহত হচ্ছে। পরিকাঠামোগত উন্নতির যে চেষ্টা হয়েছিল তা এখন অনেকটাই স্তিমিত। রাজ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বড় অংশ শিক্ষায় পিছিয়ে। বাল্যবিবাহ কিংবা স্কুলছুট হয়ে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে যাওয়ার মতো জলজ্যান্ত সমস্যাগুলো রয়েছে। সরকারকে স্থির করতে হবে, তাদের কাছে কিসের গুরুত্ব বেশি— তারা সত্যিকারের উন্নয়ন চায়, না কি ইমাম ভাতা দানের প্রক্রিয়াকে বিতর্কের ধোঁয়াশায় রেখে ধর্মীয় টানাপড়েনের রাজনীতি চালিয়ে যাবে? ইমামদের ঘুরপথে ব্যবহার করে ‘ভুলিয়েভালিয়ে ভোটে জেতা’-র মানসিকতা থেকে বেরিয়ে মুসলিম সমাজের মূল সমস্যা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নতির দিকে নজর দেওয়া আশু প্রয়োজন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement