—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সম্প্রতি নীতি আয়োগ একটি বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক ব্যবহার করে দেখিয়েছে যে, ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২১’এর মধ্যে ভারতে দারিদ্রমুক্তি হয়েছে সাড়ে তেরো কোটি মানুষের। সংখ্যাটি খুবই বড়। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, মাত্র এই ক’বছরে তা কী ভাবে সম্ভব? সূচকের কাঠামোটি কিন্তু নীতি আয়োগের একান্ত নিজস্ব সৃষ্টি নয়। তাই বলা যাচ্ছে না যে ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ করেছে রচনা। ইউএনডিপি এবং অক্সফোর্ড পভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (সংক্ষেপে ‘ওফি’)-এর যৌথ উদ্যোগে নির্মিত এই মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইন্ডেক্স (এমপিআই)। শুধু ভারত নয়, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এই সূচক ব্যবহার করে দারিদ্রের মাপজোখ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। অবশ্য সূচক যেমনই হোক, তা যদি দেখাত যে, ভারতে দারিদ্র কমেনি অথবা বেড়েছে, তা হলে সে ফলাফল দিনের আলো দেখত কি না, সন্দেহ আছে। এর আগে ২০১৭-১৮’র জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ক্ষেত্রে তা দেখেছি। এখন এই এমপিআই-এর কল্যাণে দারিদ্র এক লাফে এতটা কমে গেলে, এবং তা যদি ঘটে থাকে এই সরকারের আমলেই, উদ্যাপনের সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না।
কিন্তু এ বার বিধাতা অলক্ষে একটু মুচকি হেসে নিলেন, কারণ ইউএনডিপি এবং ‘ওফি’র মহাগুরু আর কেউ নন, স্বয়ং অমর্ত্য সেন। তাঁর তত্ত্ব থেকে নির্যাস নিয়ে, তাঁরই প্রদর্শিত পথে ইউএনডিপি প্রথমে আনে মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) ১৯৯০-এর গোড়ায়, আর ২০১০ থেকে বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক এমপিআই। দুষ্টলোকে বলতে পারে, বিধাতার কী বিচিত্র লীলা! শেষে বিজেপির অশেষ বিরাগভাজন অমর্ত্য সেনের প্রদর্শিত পথে মূল্যায়ন করে এনডিএ সরকারের এমন মস্ত ‘সাফল্য’ দেখানো গেল!
এমপিআই পদার্থটিকে একটু উল্টেপাল্টে দেখার আগে দেখে নিই, দারিদ্রের মাপজোখ আগে কী ভাবে হত। আগে দারিদ্র মাপার কাজটি করত যোজনা কমিশন। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা থেকে পারিবারিক মাথাপিছু ব্যয়ের তথ্য নিয়ে দেখা হত, কত শতাংশ পরিবারে মাসিক মাথাপিছু ব্যয় দারিদ্ররেখার নীচে। তখন দারিদ্রের সূচক তথাকথিত একমাত্রিকই ছিল। কমিশন শেষ বারের মতো দারিদ্র মেপেছিল ২০১১-১২ সালের সমীক্ষার তথ্য নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গের জন্যে তখন দারিদ্ররেখা ছিল শহরাঞ্চলে ৯৮১ টাকা আর গ্রামাঞ্চলে ৭৮৩ টাকা। মূল্যসূচক অনুসারে আজকের দিনে অঙ্ক দু’টি দাঁড়াবে যথাক্রমে ১৭৩৬ টাকা ও ১৩৯৪ টাকা। অর্থাৎ শহরে পাঁচ জনের একটি পরিবারে মাসিক আয় যদি হয় ৮৬৮০ টাকার কম হয়, তা হলে পরিবারটি দরিদ্র বলে চিহ্নিত হবে। বোঝাই যাচ্ছে পারিবারিক ব্যয়ভিত্তিক এই মাপকাঠিটি যথেষ্ট কৃপণ। তবু ২০১৭-১৮’এর সমীক্ষার পরিসংখ্যান চেপে দেওয়ায় আর সরকারি ভাবে জানা হল না যে, দারিদ্র কমল না বাড়ল। কিন্তু সে তথ্য ‘লিক’ হয়ে যাওয়ায় দেশবাসী জানল, সাড়ে চার দশকের মধ্যে সেই প্রথম গড়পড়তা ভারতীয় পরিবারে মাথাপিছু ব্যয় কমল। ফলে আশঙ্কা, ২০১১-১২ এবং ২০১৭-১৮’র মধ্যে দারিদ্র বেড়েছে। তা হলে? এই তথ্যের সঙ্গে সাড়ে তেরো কোটির দারিদ্রমুক্তির সংবাদ যে একেবারেই মিলছে না! এ বিষয়টি খানিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন।
দারিদ্রের মূলে যে অর্থাভাব, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে পরিবারে অর্থাগম এবং ভোগ্যপণ্যের উপরে তার ব্যয়ের পরিমাণ জানা থাকলেই বলে দেওয়া যাবে না পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান কেমন। ন্যূনতম প্রয়োজনগুলি মিটছে কি না, তা আলাদা করে জানা দরকার। কারণ, কেনার ক্ষমতা ছাড়া অন্য ভাবেও মিটতে পারে সেগুলি। যেমন পানীয় জল, শিক্ষা, বা স্বাস্থ্যসেবা। দু’টি পরিবারের মাথাপিছু ব্যয় সমান হলেও তাঁদের পক্ষে কতখানি স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়া সম্ভব, তা সমান না-ও হতে পারে। তাই দারিদ্রের মাপজোখ নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের একাংশ অর্থাভাবজনিত দারিদ্রের পরিবর্তে বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচকের পক্ষে সওয়াল করেন। মাত্রাগুলি হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার অন্যান্য আবশ্যিক বিষয়।
দারিদ্র নিয়ে এমনধারা সূক্ষ্মবিচারের অবতারণায় অনেকেই বিরক্ত হন। বলেন, “এত কচকচির প্রয়োজন কী! এই তো অনেক বছর পর আমার গ্রামের বাড়িতে গেলাম, দেখলাম সেখানে কেউ আর গরিব নয়; ভারতের মানুষ এখন আর তেমন গরিব নয়।” একটি গ্রামে খালি চোখে কী দেখলাম, তা থেকে ১৪২ কোটির দেশ সম্পর্কে কোনও ধারণাই করা চলে না, কোনও কথাই বলা চলে না— যদিও অনেকেই তা করে থাকেন। নির্দিষ্ট মাপকাঠি ছাড়া শুধু ‘চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা’ থেকে বলা যায় না কে কতটা ভাল বা মন্দ আছেন। তবে সরকার বিলক্ষণ জানে দেশে গরিব নেই বললে পরিসংখ্যান ছেড়ে দেবে না। তাই সতর্ক থাকতে হয়, কোনও পরিসংখ্যান বেফাঁস কিছু দেখিয়ে ফেলল কি না। তেমন সম্ভাবনা দেখলে চেপে দিতে হয়, বা বলতে হয় পদ্ধতিতে ভুল আছে।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, যে বারোটি সূচক একত্রিত করে এমপিআই নির্মিত হয়, তাদের মান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমতেই থাকে। যেমন বিদ্যুৎ, কলের জল, কিংবা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই এমন পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ কমতেই থাকে। পরিবারের অন্তত এক জন চোদ্দো বছর বয়সের আগেই স্কুল ছেড়ে দিলে, কিংবা গত পাঁচ বছরে ১৮ বছর বয়সের নীচে কেউ মারা গেলে, দারিদ্র সূচকের মান বেশি হবে। এই সূচকগুলির মানও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমতেই থাকে। আবার গড়পড়তা পরিবারের মাসিক ব্যয়, যা গড়পড়তা আয়ের হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত, তা সাধারণত বেড়ে চলার কথা আর্থনীতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু তা যে হল না, সে কথা ২০১৭-১৮’র ফাঁস হওয়া রিপোর্ট থেকেই জানা গিয়েছিল। তাই একটু দ্বন্দ্বে পড়ে যেতে হয়। অতীতের ব্যয়ভিত্তিক পদ্ধতি আর সাম্প্রতিক বহুমাত্রিক পদ্ধতির মধ্যে তুলনা করতে বসলে বেশির ভাগই হয়তো বলবেন যে, একমাত্রিক সূচকের থেকে বহুমাত্রিক সূচক শ্রেয়তর নয় কি? না, তা বলা যায় না, কারণ তারা ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা নির্দেশ করছে। বিচক্ষণতার পরিচয় হবে, যদি দু’ধরনের সূচককে একে অপরের পরিপূরক হিসাবে দেখা হয়। আর সে ভাবে দেখলে দারিদ্রের যে ছবিটি উঠে আসে তা অবিমিশ্র পতনের নয়।
এমপিআই-এর তথ্যভিত্তি জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (এনএফএইচএস)-র চতুর্থ ও পঞ্চম রাউন্ড। বারোটি সূচককে একত্রিত করে বিস্তর ভগ্নাংশ ত্রৈরাশিক কষে পাওয়া সাড়ে তেরো কোটির অঙ্কটি যেমন এক কথায় উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, আবার ওই দুই রাউন্ড থেকে অন্য কিছু সূচক নিয়ে দেখলে ছবিটা অন্য রকম হয়ে যায়। যেমন শিশুদের অপুষ্টি। কত শতাংশ শিশুর উচ্চতা তাদের বয়সের তুলনায় কম (যাদের ‘স্টান্টেড’ বলা হয়), এবং কত শতাংশের ওজন তাদের উচ্চতার তুলনায় কম (‘ওয়েস্টেড’), এই দুই সূচক থেকে পাঁচ বছর বা তার কমবয়সি শিশুদের অপুষ্টির আন্দাজ পাওয়া যায়। এনএফএইচএস (২০১৯-২১) অনুসারে ভারতীয় শিশুদের ৩৫.৫% স্টান্টেড আর ১৯.৩% ওয়েস্টেড। ২০১৫-১৬’র সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে যে, অনুপাতগুলি কমেছে অতি সামান্য। শতাংশের হিসাবে এত বেশি ওয়েস্টেড শিশু বিশ্বের আর কোনও দেশে নেই। পরিবারগুলিকে আর্থনীতিক শ্রেণি অনুসারে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করলে দেখা যাবে, ধনীতম ২০ শতাংশ পরিবারের মধ্যে বয়সের তুলনায় খর্বকায় শিশুর অনুপাত যেখানে ২৩.১%, সেখানে দরিদ্রতম ২০ শতাংশের মধ্যে তা ৪৬.৪%। আর্থনীতিক শ্রেণিভেদ অনুসারে অপুষ্টির এমন চরম বৈষম্য বিশ্বের কম দেশেই দেখা যায়। এ সব তথ্যের সঙ্গেও বহুমাত্রিক দারিদ্র হ্রাসের গল্পটি মেলে না।
বিধাতার মুচকি হাসির আর একটি কারণ রয়ে যাচ্ছে। এমপিআই তথাকথিত ‘গুজরাত মডেল’ নিয়ে আর এক বার প্রশ্ন তুলে দেয়। ২০১৯-২১’এর তথ্যে দেখছি যে, গুজরাত আর পশ্চিমবঙ্গের বহুমাত্রিক দারিদ্র প্রায় সমান— যথাক্রমে ১১.৬৬% আর ১১.৮৯%। শুধু তা-ই নয়, ২০১৫-১৬ থেকে দারিদ্র কমেছেও বেশি পশ্চিমবঙ্গে, যদিও গুজরাতের মাথাপিছু অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মূল্য পশ্চিমবঙ্গের দ্বিগুণেরও বেশি! এই চমকপ্রদ বৈপরীত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আর কেউ নয়, সরকারের নীতি আয়োগ।