দাবি: ছাত্র ভর্তিতে অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন নীতি বাতিল হওয়ার প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্টের সামনে বিক্ষোভ। ওয়াশিংটন, ২৯ জুন ২০২৩। পিটিআই।
কয়েক মাস আগে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট এক জোড়া মামলায় ঐতিহাসিক রায় দিল। স্টুডেন্টস ফর ফেয়ার অ্যাডমিশন (এসএফএফএ) বনাম হার্ভার্ড কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলিনা মামলা দু’টিতে আদালত রায় দিল যে, জাতিভিত্তিক অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন বা ইতিবাচক বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা সে দেশের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত সমান সুযোগের অধিকারকে লঙ্ঘন করে। ‘অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন’-এর মাধ্যমে সংবিধানকে সামান্য পাশ কাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ শুরু করা হয় ১৯৬০-এর দশকে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মতো প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান-সহ বেশ কিছু আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় বর্ণবৈচিত্র এবং মূলত কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে এই সংরক্ষণ বজায় রেখেছিল গত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে। তবে এই ব্যবস্থাকে কোটা বা বর্ণভিত্তিক সংরক্ষণ না বলে ইতিবাচক জাতি-চেতনা বলেই মনে করেছেন উদারপন্থী মানুষজন।
কিন্তু উদারপন্থীদের সংখ্যা কোনও দেশেই তেমন বেশি নয়। ফলে ১৯৭৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বনাম বাক্কে, ১৯৯৭ সালে গ্রুটার বনাম ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান ল স্কুল, ২০১৬ সালে ফিশার বনাম ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস ইত্যাদি বিভিন্ন মামলায় এই পদ্ধতি কোনও বার সমর্থন পেয়েছে বিচারকদের, এবং কখনও তা সংবিধানবিরুদ্ধ বলে বিবেচিত হয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রেই আবেদনকারীর বক্তব্য এই যে, তাঁর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় জাতি-চেতনার দোহাই দিয়ে অন্য কাউকে নিয়েছে, যা আসলে সংবিধানের ‘সমান সুরক্ষা আইন’-এর পরিপন্থী। ১৮৮৬ সালে চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে আমেরিকার সংবিধানে ‘ইকোয়াল প্রোটেকশন ক্লজ়’ অন্তর্ভুক্ত হয়, যাতে বলা হয়েছিল, আমেরিকার কোনও প্রদেশের কোনও প্রতিষ্ঠানই সে দেশের কোনও নাগরিককে সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। এর সুবিধা জাতি, বর্ণ এবং জাতীয়তা নির্বিশেষে সবাই পেতে পারেন। এই আইন সত্ত্বেও, যাঁরা অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশনে বিশ্বাসী তাঁরা মনে করেছেন, কৃষ্ণাঙ্গদের একটু বেশি সুযোগ দিলে সামাজিক ক্ষেত্রে সমতা আসবে; এবং শিক্ষার সার্বিক প্রভাব যে-হেতু সুদূরপ্রসারী, ফলে সংবিধানের যেটুকু ব্যত্যয় ঘটছে তা অন্য উপকার দিয়ে পূরণ করা যাবে।
শিক্ষার সামগ্রিক উপকার শুধু ব্যক্তির মধ্যে সীমিত থাকে না। এক জন মানুষ শিক্ষিত হলে তাঁর সংস্পর্শে অনেকের মধ্যে শিক্ষার উপকার প্রসারিত হয়— অর্থাৎ শিক্ষার বিপুল ইতিবাচক অতিক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষ সামাজিক ভাবে যতটা প্রয়োজন তার থেকে কম শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন। মানুষকে আরও শিক্ষিত করা গেলে সামাজিক উপকার হবে, এই যুক্তিতেই শিক্ষায় অনুদান এবং প্রয়োজনমতো কিছু (ঐতিহাসিক ভাবে বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া) গোষ্ঠীকে বিশেষ সুযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন অনেকেই।
অন্য দিকে যাঁরা এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে, তাঁরা বরাবরই বলে এসেছেন যে, ঐতিহাসিক ভাবে ক্রীতদাস প্রথার দরুন যা ক্ষতি হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের, তা পূরণ করার দায় বর্তমান সমাজের শ্বেতাঙ্গদের উপর বর্তায় না, ফলে সংবিধানবিরুদ্ধ পদ্ধতি স্থগিত করতে হবে। উল্লেখযোগ্য যে, সুপ্রিম কোর্টের এক কৃষ্ণাঙ্গ সহকারী বিচারক কিন্তু ভোট দিয়েছেন এই পদ্ধতি রদ করার পক্ষে— এমন একটা সময়ে, যখন শিক্ষার সাহায্যে কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকেই উঠে এসেছেন আর্থ-সামাজিক মূলস্রোতে, যদিও বড় অংশই এখনও রয়ে গিয়েছে এর বাইরে।
সংরক্ষণের বিষয়টি সর্বত্রই সমস্যাদীর্ণ। ভারতও ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষা, সরকারি চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণির স্বার্থে একই যুক্তিতে তৈরি করা ইতিবাচক বৈষম্য ভারতেও বিচ্ছিন্ন সমস্যা হিসাবে রয়ে গিয়েছে, যদিও মণ্ডল কমিশনের নির্দেশ পরবর্তী সময়ে সাময়িক গন্ডগোল হলেও সরকারি নিয়ন্ত্রণের দরুন তা মাত্রাছাড়া হয়নি। তবে যাঁদের অনুকূলে এই সংরক্ষণ যাচ্ছে না, তাঁদের মধ্যে অপ্রাপ্তি বোধ যে যথেষ্টই, তা মাঝে মাঝে প্রকাশ পায়। সুতরাং, সংরক্ষণের দরুন পরিমাপযোগ্য আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যথাযথ খতিয়ানই একমাত্র উপায়, যার মাধ্যমে এই নীতির রাজনৈতিক গুরুত্ব বজায় থাকে।
এ ছাড়াও মনে রাখতে হবে যে, এই ধরনের অতি-সংবেদনশীল বিষয় সংবিধানের অন্তর্গত না হলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমেরিকায় এটি চিরস্থায়ী নীতিতে উন্নীত না হওয়ার পিছনে সরকারি নজরদারিবিহীন, কোটাবিহীন মুক্ত বাজারব্যবস্থার প্রতি অসীম আগ্রহ কাজ করে থাকতে পারে। আবার সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় না, সেই কারণেও হতে পারে। অথচ, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এখনও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে একই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অশ্বেতাঙ্গ আবেদনকারীরা তুলনায় কম সুযোগ পান। অনেকে বলে থাকেন যে, এই পদ্ধতির আড়ালে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলে তাদের ধনী অর্থদাতাদের পরিবার পরিজনকে শিক্ষা প্রদান করে থাকে। সংরক্ষণের দরুন কতটা উন্নতি ঘটেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, সেই হিসাবও বেশ কমজোরি। তবে এই ব্যবস্থা না থাকলে কী হতে পারে, সেই প্রশ্নই এখন সমীচীন।
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন-এর মাধ্যমে ছাত্র বাছাইয়ের নীতি বাতিল হয়ে যাওয়ায় সে দেশে পড়তে চাওয়া বিদেশি পড়ুয়াদের সুযোগ বাড়ল না কমল? আমেরিকা কিংবা অন্য উন্নত দেশে, যেখানে প্রচুর সংখ্যায় ভারতীয় পড়ুয়া যান, তাঁদের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য প্রকট হয়েছে অনেক ভাবে। যে-হেতু এশিয়া থেকে আবেদনকারীর সংখ্যা বেশি, ফলে যোগ্যতা থাকলেও তাঁদের মধ্যে অনেককেই এর আগে সুযোগ দেওয়া হয়নি প্রতিষ্ঠানে জাতিগত ভারসাম্য ও বৈচিত্র বজায় রাখার অজুহাতে। অভিবাসীদের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য। একই দেশ থেকে অনেক অভিবাসী এলে জাতিগত বৈচিত্র কমে যায়; কোনও একটি জাতি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারে, সে সম্ভাবনাও থাকে। যেমন অতীতে ইটালীয় অভিবাসীরা এবং ইদানীং ভারতীয়রা রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত সক্রিয় ও ক্ষমতাসীন।
এই ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার ফলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসারে শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া জারি থাকবে। এশীয় দেশগুলোতে স্কুল থেকেই বেশ কঠিন অঙ্ক, বিজ্ঞান এবং বিদেশি ভাষা যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে পড়ানো হয় বলে সুযোগের নিরিখে পড়ুয়ারা এগিয়ে থাকবেন। জনবহুল এশীয় দেশগুলোর জন্য এই বর্ধিত সুযোগের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। এর সঙ্গে যদি আবেদন করার খরচও কমিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়, তা হলে অনেকেই আকর্ষিত হবেন। তাঁদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মানুষ দেশে ফিরে এলে তার দরুন দেশেও উন্নত মানের মানবসম্পদ বাড়বে বহু গুণ।
তবে নিজেদের প্রথা বজায় রাখতে ভাল প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে চলেছে। কোভিড-এর দোহাই দিয়ে আন্তর্জাতিক যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষার নম্বর ভর্তির মানদণ্ড হিসাবে মানতে অরাজি হচ্ছে বহু বিশ্ববিদ্যালয়। আগে আবশ্যিক ছিল, কিন্তু এখন নিচ্ছে না। এর কারণ হিসাবে অনেকে মনে করছেন যে, কোনও নির্দিষ্ট মাপকাঠি না থাকলে কাকে নেবে আর কাকে নেবে না, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত হিসাবে থেকে যাবে, এবং সেটি চ্যালেঞ্জ করা খুবই দুরূহ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তো পড়ুয়া ছাড়া চলবে না, ফলে যে পদ্ধতিই অবলম্বন করুক, সুযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হবে না। ভারতে যে-হেতু নতুন শিক্ষানীতিতে আমেরিকান ব্যবস্থার ছায়া পড়েছে বড় আকারে, ফলে এ দেশের পড়ুয়াদের আগামী দিনে হয়তো সুযোগ বর্ধিতই হবে আগের তুলনায়।