এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মারিয়া রেসা বিবিসি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, সমাজমাধ্যম বেশি ব্যবহারে মানুষের কিছু আচরণগত বদল হচ্ছে। ফিলিপিন্সে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল, তা নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ হয়তো দেশের নাগরিকেরা প্রচার আর সত্যির তফাত করতে পারছেন না। যাঁরা শিক্ষাতত্ত্ব নিয়ে পড়েছেন, তাঁরা জানেন যে, মানুষের আচরণগত পরিবর্তন করতে পারলেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। শিশুদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের মত হল, করোনা পরিস্থিতি শিক্ষাব্যবস্থা আমূল বদলে দিয়েছে। যে শিশু-কিশোরেরা এখন পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে, তারা অনলাইনে পড়ছে। এবং, সমাজমাধ্যম কী ভাবে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে ব্যবহার করা যায়, বেশির ভাগ অভিভাবকেরই সে সম্পর্কে ধারণা নেই। কী দেখা উচিত বা উচিত নয়, এ কথা কিশোরদের যদি বা বলা যায়, শিশুদের ক্ষেত্রে তা কী ভাবে সম্ভব, তা বুঝে উঠতে পারেন না অভিভাবকেরা। শিশুদের তো ভাল-খারাপের বোধই তৈরি হয় না। অথচ এক দিকে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বিষয়বস্তু, অন্য দিকে পর্নোগ্রাফি, ইন্টারনেট ও সমাজমাধ্যমের দৌলতে সহজলভ্য। এর থেকে কী ভাবে বাঁচানো যাবে শিশুকে? তাদের মানসিক সমস্যার দিকটি তাই ফের আলোচনায় উঠে আসছে।
যারা এই ধরনের জিনিস তৈরি করে, তারা খুব ভাল করেই জানে যে, যত কম বয়সে এ সব কারও কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তত লাভ। কোনও শিশু বা কিশোরের তাই মোবাইল ও ডিজিটাল মিডিয়ার প্রতি আসক্তি কী ভাবে কমানো যায়, তা নিয়েই কথা হওয়া দরকার। আবার যাঁরা শিক্ষাতত্ত্ব নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা জানেন যে, এই অনলাইন শিক্ষার যুগে মোবাইল বা ল্যাপটপের সঙ্গে ছোটদের ঘনিষ্ঠতা অবিচ্ছেদ্য হলেও কতখানি ক্ষতিকর। বছর পাঁচেক আগেও কি সমস্যাটা এই রকম ছিল? তখনও হয়তো শিশু-কিশোরদের কাছে মোবাইল-ল্যাপটপ ছিল, কিন্তু তাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লাস করতে হত না। আজ তারা বাধ্য হয়েই দিনের বেশির ভাগ সময়টা মোবাইলে কাটাচ্ছে। কোভিড পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাস তাদের করতেই হবে। ফলে, ক্ষতি যা হওয়ার, হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।
বস্তুত, এক সময়ে যে জগৎটা ছিল স্কুল আর পরিবারের, এখন তা হরেক কিসিমের প্রযুক্তির। এত দিন এই দুই প্রতিষ্ঠান মিলিত ভাবে প্রযুক্তির হিংস্র থাবা থেকে শৈশবকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। আজ যখন প্রযুক্তিই সফল ভাবে এই দুই প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, তখন আমাদের জানা নেই যে, কী ভাবে আমরা শিশুদের রক্ষা করব।
শিশুর হাতে ফোন— কোন মেসেজ তার দেখা উচিত, কোনটা উচিত নয়? ফেসবুক-সহ নানা অ্যাপে ভেসে ওঠা ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক লেখা, ছবি, ভিডিয়ো দেখা থেকে কী করে তাকে বিরত রাখা হবে? অজস্র মিথ্যা প্রচার, যাতে প্রাপ্তবয়স্করাই বিভ্রান্ত হয়ে যান, শিশুরা তা বিচার করবে কী উপায়ে? কিছু দিন আগে আমেরিকার সেনেটে ফেসবুকের প্রাক্তন কর্মী ফ্রান্সিস হাউগেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বীকার করে নিয়েছেন, তাদের মতো বৃহৎ কর্পোরেটের কাছে লভ্যাংশ বাড়ানো ছাড়া অন্য কিছুরই কোনও দাম নেই। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য তাদের কাছে তুচ্ছ, গৌণ। এবং তাঁর অভিযোগ, কী ভাবে মেঘের আড়াল থেকে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করা যায়, কী করে শিশু-কিশোরদের আরও হিংস্র ও অপরাধপ্রবণ করে তোলা যায়, তার সমস্ত উপকরণ ফেসবুকের কাছে আছে। কর্তৃপক্ষ যথারীতি সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করলেও এ কথা মেনে নিয়েছেন যে, প্রচুর সংখ্যায় ঘৃণা-বিদ্বেষবাহী, আঘাতমূলক এবং বিভাজনের বার্তাবহনকারী পোস্ট তাঁদের সরাতে হয়েছে। ইনস্টাগ্রাম থেকেও প্রচুর ছবি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর।
কী ভাবে শৈশব-কৈশোরকে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে ইউরোপ-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার বহু দেশে আইন আছে। প্রচুর মানুষ এ প্রসঙ্গে নানা চিন্তা করছেন অনেক আগে থেকেই। এমনকি, রাষ্ট্র ও সমাজ ঐকমত্যের ভিত্তিতে কেমন করে এই ডিজিটাল শিকারির হাত থেকে ছোটদের বাঁচানো যায়, তা-ও নিরন্তর আলাপের বিষয়। কিন্তু, ভারতে এই সংক্রান্ত আইন অনেক নমনীয়। এ দেশে ডিজিটাল আগ্রাসন নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয় না। আজ যখন চার দিক থেকে অভিযোগ আসছে যে, এই ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-হোয়াটসঅ্যাপ শুধুমাত্র মেসেজ, ছবি ইত্যাদি এক জনের থেকে অন্য জনকে পাঠানোর প্ল্যাটফর্ম নয়, তার মাধ্যমে সূক্ষ্ম ও চতুর ভাবে অনেক মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তখন কি ভাবা হচ্ছে যে, এই অনলাইন পড়াশোনার ফাঁক দিয়ে শিশু-কিশোরদের মনস্তত্ত্ব বদলে দেওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব কাজ নয়?
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের আচরণই যদি বদলে যেতে পারে, যদি সমাজমাধ্যম সংস্থাগুলোর লাভের স্বার্থে তাতে কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তা হলে কী করে বলি যে বাচ্চারা নিরাপদ আছে এবং থাকবে? আর বাচ্চারা যদি নিরাপদ না থাকে, কী করে আশা রাখি সামনের দিনের পৃথিবীর উপর, সভ্যতার উপর?