কোভিডে আমেরিকা ও ইউরোপে যে শিল্পক্ষেত্রটি পর্যুদস্ত, তা হল কনট্যাক্ট ইনটেনসিভ বা স্পর্শনিবিড় শিল্পক্ষেত্র। যেখানে মানুষ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বা বসে কাজ করেন, সেখানেই ভয়াবহ হয়েছে সংক্রমণ। আর তার ফলে জাতীয় উৎপাদনের বড় ক্ষতি হয়েছে। আমেরিকা ও ইউরোপে আলাদা গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, এ সব ক্ষেত্রে অতিমারির আগের সময়ের চেয়ে উৎপাদন ৩০% অবধি কমে গিয়েছে। বিশাল ক্ষতি হয়েছে বিনোদনক্ষেত্রের— যেমন সিনেমা, থিয়েটার, অপেরা গান-বাজনা ইত্যাদি। যেখানে মানুষে মানুষে মুখোমুখি আলোচনা বা পাশাপাশি কাজ করার প্রশ্ন ওঠে না— অর্থাৎ ভার্চুয়াল বা কম্পিউটারের মাধ্যমে কাজকর্মের ক্ষেত্রগুলো— অতিমারির মধ্যেও সেগুলো ক্রমে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। স্পর্শনিবিড় ক্ষেত্রগুলো এখনও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আবার কী হয়, এই আশঙ্কায়।
মানুষের ভিড় যেখানে দ্রব্যের বা পরিষেবার চাহিদা নির্ধারণ করে, সেই সব বিনোদনের জায়গা যে প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, শুধু তা-ই নয়— সেগুলো আদৌ আর চালু হবে কি না, তা কেউ বলতে পারছেন না। কবে ভ্রমণ ও পর্যটন শিল্প আবার পুরনো জায়গায় ফিরে যাবে, কেউ জানেন না। যখনই অতিমারিতে একটু ভাটা পড়ছে, তখনই এ দিক ও দিক বেড়াতে যাওয়া এবং উৎসবে অংশগ্রহণ আবার সংক্রমণের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। তা হলে পৃথিবী এবং দেশের অর্থনীতি যদি ঘুরেও দাঁড়ায়, স্পর্শনিবিড় অর্থনৈতিক কাজকর্ম বা শিল্পের অবস্থায় একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আসছে।
বারে বারে কোভিড পরীক্ষা ব্যয়বাহুল্য। মানুষ বাড়িতে কাজের লোক না রেখে, রোবট দিয়ে ঘর পরিষ্কার করাতে শুরু করছে। ভারতের মতো দেশের দীর্ঘকালীন সমস্যা বিদেশি প্রযুক্তির উপর চরম নির্ভরতা। ভারত বণিকের মানদণ্ডকে রাজদণ্ড হতে দিয়ে দু’শো বছরের পরাধীনতার দুঃস্বপ্ন ডেকে এনেছিল— স্বাধীনতার পর তাই এ দেশে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সরকারি উদ্যোগে নিজেদের মতো। কিন্তু, এ দেশের বেসরকারি শিল্পপতিরা অনেকেই নতুন কোনও প্রযুক্তি সৃষ্টি করতে পারেননি বা চাননি। তাই শ্রমনিবিড় শিল্প কালে কালে পাশ্চাত্যের অনুকরণে সর্বাধিক ভাবে যন্ত্রনির্ভর প্রযুক্তির দাস হয়ে গিয়েছে। যা কিছু নতুন, উন্নত, আমাদের চেয়ে সেরা তা নিশ্চয় ভারতের নিজের কিছু হতে পারে না— এমন একটা বিশ্বাস ক্রমে সর্বজনীন হয়েছে। স্বাধীনতার পর ভারত ধীরে ধীরে পরাধীনতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে নির্দ্বিধায় ঔপনিবেশিক তাঁবেদারিতে মনঃসংযোগ করতে পেরেছে— নিজের সব জলাঞ্জলি দিয়ে। তার মধ্যে প্রযুক্তি একটি। যখন অতিমারির জন্য, স্পর্শনিবিড় শিল্পের জন্য আরও রোবট-প্রযুক্তি তৈরি হবে, আমরা আবার চটজলদি সেগুলো আমদানি করব। যদি পাঁচ-দশ টাকা লাভ হয়, তা হলে সস্তায় কিনে, স্বদেশে দুর্নীতি-প্রসূত ক্ষমতার জোরে একাই সেটা বিক্রি করার অধিকার জোগাড় করে মুনাফা করব। কম পয়সায় কিনে বেশি পায়সায় বিক্রি করাকে এখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে দেখা হয়।
যে দেশগুলোতে রোবট তৈরি হয়েছে, তাদের অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা অন্য ধরনের— এই কাজটা এক কালে নামজাদা অর্থনীতিবিদরা জোর গলায় বলতেন। এখন আর বলেন না। ফলত, আমাদের দেশে প্রচুর বিনিয়োগ না হলে স্বল্পশিক্ষিত, অদক্ষ কমবয়সি শ্রমিকদের অসংগঠিতক্ষেত্র ছাড়া কোনও গতি থাকবে না। কিন্তু আমরা নবতম প্রযুক্তিতে শিল্পায়ন করছি, এমন কথা জোর গলায় নির্লজ্জ ভাবে ঘোষণা করতে থাকব।
কখন মানুষ নির্ভয়ে ভিড় বাড়িয়ে সিনেমা বা থিয়েটার হল, গান-বাজনার আসর, আর্ট গ্যালারি, অপেরা হাউস, যাত্রার আসরে ফিরবে, তা কেউ জানে না। হয়তো বিখ্যাত শিল্পীরা দলবেঁধে অনলাইন শো করবেন। কিন্তু এক বিশাল অংশের কলাকুশলী কর্মীদের পেশাদারি রোজগারের ক্ষেত্র অনিশ্চিত আশঙ্কায় ঝুঁকির ভয়ে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটাই গোটা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। বিনোদন শিল্পের ছোটখাটো কর্মী, শিল্পী, সহযোগী যন্ত্রবাদক এই অতিমারির সময়ে বাড়ি বাড়ি বাজার পৌঁছে দিয়েছেন। কায়িক শ্রমকে খুবই অসম্মানের চোখে দেখে, এমন একটা দেশের নাগরিক হিসেবে আমি লজ্জিত। কিন্তু শিল্পীরা এহেন দুরবস্থা থেকে কবে ঘুরে দাঁড়াবেন? এ প্রশ্নের এখনও কোনও উত্তর নেই।
আকাশচুম্বী বৈষম্যের দিকে এগোচ্ছি আমরা। গত দেড় বছরে পৃথিবীর অনেক জায়গার মতোই ভারতেও মারাত্মক ছাঁটাই হয়েছে। সম্পদশালী উন্নত দেশে নতুন চাকরি পেতে এ দেশের চেয়ে অনেক কম সময় লাগে। চাকরি খোয়ানো বয়স্ক পেশাদার মানুষজন কী করবেন?
বিনোদন জগতের একটি অংশ ধ্রুপদী সঙ্গীতের মানুষদের নিয়ে। বহু ছোট বড় মাঝারি মাপের শিল্পীর সম্বৎসরের রোজগার হত বিদেশের অনুষ্ঠান দিয়ে, এই ছোট বড় মাঝারি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। ভয়াবহ লকডাউনের ফলে এবং শঙ্কিত ধনবানদের ‘গেল গেল’ রবে বিদেশ যাওয়াই বন্ধ হয়ে গেল। কবে যে রোজগারের রাস্তা খুলবে কেউ জানে না। আর, দু’পয়সা মুনাফা বাড়ছে না কমছে, তা যাচাই করা অর্থনীতিবিশারদ ও নীতি নির্ধারকদের এঁদের দুঃখকষ্টের ইতিবৃত্ত নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই, থাকার কথাও নয়।
জনঘনত্বে জেরবার যে দেশ, সেখানে সংক্রমণের ভবিষ্যৎ অন্য জায়গার চেয়ে অনেক বেশি বিপদসঙ্কুল। স্পর্শনিবিড় শিল্পের মতো স্পর্শনিবিড় গণ মানসিকতার জেরে সমূহ বিপদ।
এখনই সাবধান হওয়া ভাল।
ভূতপূর্ব উপাচার্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়;
অর্থনীতি বিভাগ, হ্যানইয়াং ইউনিভার্সিটি,
দক্ষিণ কোরিয়া