—প্রতীকী চিত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা তাঁর কাছে অতি গভীর। প্রয়াণের দু’দিন আগে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, বেলুড়কে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া অধ্যাত্মশক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেবে। গত দশকের মাঝামাঝি থেকে বিশ্বময় সাংস্কৃতিক বিনিময়, জনসংযোগ, শান্তি ও অহিংসা প্রসারে রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জোট বেঁধেছে ইউনেস্কোও। রবীন্দ্রনাথ শঙ্কিত হয়েছিলেন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনার অভিমুখ আন্দাজ করে, মাটির স্পর্শ ছেড়ে তার পরাশ্রয়ী হয়ে ওঠার প্রবণতায়, ভাবগত আত্মসমর্পণে। তাই তৈরি করেছিলেন বিশ্বভারতী। শান্তিনিকেতন আজ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মাননায় ভূষিত; অন্য দিকে চার পাশে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমে আদর্শহীন হয়ে পড়ছে।
বিরাট এই দেশে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাচুর্যকে এক দিক থেকে দেখলে ‘সকলের জন্য শিক্ষা’ ভাবনার মহৎ প্রয়াস বলে ভাবা যেতে পারে। উল্টো দিকও আছে: পরিকল্পনা ছাড়াই যত্রতত্র তৈরি হচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলি হচ্ছে অবহেলিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণ অনেক সময়েই মেলে না। ও দিকে বিগত বেশ কিছু বছর ধরে শিক্ষক তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভবিষ্যতের শিক্ষকদের দেওয়া হচ্ছে শিক্ষাকে ‘পেশা’ করে তোলার নিপুণ পাঠ, শিক্ষার আসল দায়িত্ব এড়িয়ে। বি এড কলেজে লাভের নেশায় শিক্ষা নিজেই হয়ে উঠেছে বাজারি পণ্য। বহু বেসরকারি বি এড কলেজে নিয়মিত নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয় বিদ্যা নিধন কর্মসূচি; অনেক সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানেও ধারাবাহিক অনাচারের নজির।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীন সংস্থা ‘নাক’ (ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল) আসে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলির মূল্যায়ন করতে। সাতটা আলাদা বিষয়ে মূল্যায়ন: পাঠ্যক্রম, গবেষণা, শিক্ষার্থীদের অবস্থা, ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যবিধি ও সার্বিক ভাবে প্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামো ও সম্পদের নিরিখে নির্ধারিত হয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা। এক বার এই প্রক্রিয়ায় অসঙ্গতি ধরা পড়লে পরিদর্শক দল আবারও আসেন পুনর্মূল্যায়নে। কেন্দ্রীয় মূল্যায়নের আগে সংশ্লিষ্ট শিক্ষায়তনের তৎপরতা থাকে তুঙ্গে। ঠিক যেমন ভোটের আগে রাস্তা মেরামত বা প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা। প্রতিনিধি দল আসে ভিন রাজ্য থেকে, মূল্যায়নের স্বচ্ছতা রক্ষায় নিজ রাজ্যের কাউকে রাখা হয় না। অনেক সময় মূল্যায়নের ঠিক আগে কলেজে চলে আসে লক্ষ লক্ষ বই বোঝাই আস্ত একটা ‘ভাড়া করা গ্রন্থাগার’। সঙ্গে নিপুণ ক্যাটালগ, নিখুঁত রেজিস্টার। পরিদর্শকেরা দেখেন পড়ুয়ারা নিয়মিত গ্রন্থাগারের বই পড়ছে, কিন্তু বাংলায় স্বাক্ষর করা ছাত্রছাত্রীরা আসলে কোন প্রতিষ্ঠানের নথিভুক্ত শিক্ষার্থী তা অজানাই থেকে যায়। রাতারাতি কলেজে ঘটে যায় ‘সবুজ বিপ্লব’, আকাশমণি সোনাঝুরি দেবদারু সে-ও ভাড়ায় মেলে; সঙ্গে সাত-আট বছরের ‘গ্রিন অডিট’। মূল্যায়ন শেষে সে-সব গাছপালা চলে যায় অন্য কোথাও সবুজায়নের কথা রাখতে, কিংবা মালিকের কাছে। এখানেই শেষ নয়— কলেজের স্টাফ রুমও সেজে ওঠে ডেকরেটরের চেয়ার-টেবিলে!
কিছু বেসরকারি কলেজে পরতে পরতে দুর্নীতি। যিনি মালিক, তিনিই আবার ভিন্ন আধার বা প্যান কার্ডে একাধিক বিষয়ের শিক্ষক। কাউকে আবার পরিদর্শনের আগে শিক্ষক, পার্শ্বশিক্ষক বা অধ্যক্ষ ‘চরিত্র’-এ নিয়ে আসা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভাড়া করে আনা হয় স্থানীয় নাচের স্কুলের ছেলেমেয়েদের, তৈরি হয় নকল পরিচয়পত্র। নিজেদের সুবিধা মতো সাজিয়ে নেওয়া হয় ছাত্র-শিক্ষককে। রাজ্যের শিক্ষক শিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সব অজানা, বিশ্বাস হয় কি? কানাঘুষো চলছে, আপাতত অনির্দিষ্টকালের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম নাকি বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন উপসর্গ, এম এড শেষে শিক্ষার্থীরা নেট পরীক্ষার ফর্ম ভরতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটাও অনলাইন তালিকায় খুঁজে পাচ্ছে না। এতে বেজায় চটেছে বেসরকারি কলেজের মালিকবর্গ। জোট বেঁধে হুমকি দেওয়া হচ্ছে উপাচার্যকে।
ত্রিপুরা, মণিপুর, অসমের মতো প্রতিবেশী রাজ্য থেকে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী আসে বেছে বেছে এই সব কলেজেই পড়তে, বলা ভাল ‘শংসাপত্র কিনতে’। এ ভাবেই চলছে দেশ জুড়ে শিক্ষক প্রস্তুতির কাজ। কর্তৃপক্ষ শুধু ভাবেন নিজেদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের কথা, ছাত্র শিক্ষক বা পড়াশোনার গুণমান মূল্যহীন। সাধারণ মানুষ জানেনও না, শিক্ষকেরা এই সব প্রতিষ্ঠানে বাংলা প্রবাদের উলুখাগড়া মাত্র।
শিক্ষাব্যবস্থার এই ভিতর-কথা অনেকের জানা। তবু যে প্রতিবাদ নেই কোনও, সেটাই আতঙ্কের। শিক্ষার ঐতিহ্য বিস্মৃত হলেই এই দশা হয়। এখন শিক্ষা নিয়ে আলোচনা মানেই দুর্নীতির মুচমুচে তথ্য, কে জেলে গেল আর কে কত পকেটে ভরল। কেন্দ্রের নতুন শিক্ষানীতিতে চমকের শেষ নেই। সংবিধানে শিক্ষা যুগ্ম তালিকাভুক্ত, কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্যের শিক্ষানীতিতে বিস্তর তফাত। এদের পরস্পর-বিরোধিতার বলি হচ্ছে শিক্ষা, এ এটা পাল্টায় তো ও তড়িঘড়ি ওটা। শিক্ষায় সংস্কার জরুরি, কিন্তু রাজনৈতিক প্ররোচনায় শিক্ষা-সংস্কার গিমিক ছাড়া আর কী! ক্ষতি যা হওয়ার, হয়ে গিয়েছে এর মধ্যেই।