হয়তো নতুন কিছু হয়নি এই বছরটায়। কাকে বলে ‘নতুন’? যা ছিল না, সবে এইমাত্র হল, সেটাই তো? তা হলে তো তেমন নতুন বলতে পারি না— যা কিছু দেখলাম আমরা বছরভর। হৃদয়বিদীর্ণ হয়ে গেলেও স্বীকার করতেই হয়, এর সবই যেন ছিল। সুতোগুলো বিছানোছিল, গালিচা বোনা চলছিল। গালিচার নকশাটা চোখের সামনে ফুটে উঠল, এই মাত্র। এ আমাদেরই দোষ যে আগে থেকে এই সব সুতোবুনুনি তৈরি হয়ে ওঠাটা চোখ খুলে দেখিনি, নিজেদের প্রস্তুতকরে নিইনি।
একটা ভয়াল যুদ্ধের মধ্যে ২০২৩ সালটা শুরু করেছিলাম আমরা, চলতে চলতে সংগ্রহ করেছি ভয়ঙ্করতর আর একটা যুদ্ধ। ইউক্রেন সংঘর্ষ ‘ছিল’ থেকে ‘আছে’ হল। তার মধ্যেই এসে গেল প্যালেস্টাইনের নিষ্ঠুরতম ‘যুদ্ধ’, যদিও সেটা যুদ্ধ নয়, গণহত্যা বা জেনোসাইড। কিন্তু সেও কি নতুন? এখন যা ঘটছে, তার সমূহ ইঙ্গিত কি ছিল না আগেই? আজ প্যালেস্টাইনে যা হচ্ছে, তা অভাবিত ছিল না ৩৬৫ দিন আগেও। ২০২২-এর শেষে দ্য গার্ডিয়ান একটা তালিকা প্রকাশ করে ছিল, ‘আগামী বছর’ মানে ২০২৩-এ কিসের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। তার মধ্যে ছিল ‘দ্য থার্ড ইন্তিফাদা’র কথা। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাবে জেরুসালেম এবং প্যালেস্টাইনের অধিকৃত অঞ্চলে সাধারণ মানুষ এক ভয়ঙ্করতম— ‘ডেডলিয়েস্ট’— সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন: এবং তাই, “আনফরচুনেটলি,... দ্য গ্রিম পসিবিলিটি ইজ় মোর লাইকলি ইন ২০২৩ দ্যান এভার বিফোর।” আমরা অনেকেই ভুলে বসেছি, ২০২২ সালে ইজ়রায়েলি ‘ব্লকেড’ যে ভয়ানক আকার নিয়েছিল, আগে কখনও তা দেখা যায়নি। আর জবাবে প্যালেস্টাইনি জঙ্গিরাও ক্রমে যেমন সক্রিয় হয়ে উঠছিল, ২০০৮ সালের পর সেটাও দেখা যায়নি।
ও দিকে ইউক্রেন যুদ্ধ সহজে মিটবে না, মেটার কোনও ‘কূটনীতিগ্রাহ্য’ কারণ নেই, সেটাও বলেছিল এই রিপোর্ট। নিজেদেরই আজ মনে করিয়ে দেওয়া ভাল যে, অপ্রত্যাশিত, আকস্মিক বলে যে সব ঘটনাকে আমরা ভাবি— সেগুলোর পিছনে আমাদেরই ‘প্রত্যাশা’ বা ‘প্রস্তুতি’র বিশেষ অভাব। এবং এই উপলব্ধির ভিত্তিতে, এই বছরশেষে দাঁড়িয়ে আজও নিজেদের একটু তৈরি করে নিলে ভাল হয়, পরের সময়টার জন্য। কেননা, যে-হেতু সবই আপেক্ষিক, হতেই পারে যে ২০২৪ সালের শেষে দাঁড়িয়ে ২০২৩-এর শেষ দিনটিকেও হয়তো মনে হবে— ‘তুলনায়’ শান্ত, স্বাভাবিক।
‘স্বাভাবিক’ শব্দটাই মজার। স্ব-ভাব বলতে তো এখানে সময়ের স্ব-ভাবই বোঝাই আমরা? সময়ের কঠিনতার সঙ্গে সঙ্গে সেই স্ব-ভাব ও স্বাভাবিক তাই পাল্টে পাল্টে যায়। আজকাল এমন দাঁড়িয়েছে যে, যা কিছু অতি অ-স্বাভাবিক বলে জানা ছিল, যা ঘটলে আমাদের শিউরে ওঠার কথা ছিল, সে সবই আমাদের কাছে বড্ড ‘স্বাভাবিক’ হয়ে গেছে। বন্দুকে-বোমায়-ড্রোনহানায়-বিস্ফোরণে মানুষ ছিন্নভিন্ন হলেও সে খবর আমাদের সংবাদের হেডলাইন পায় না। প্যালেস্টাইনে নিহত-সংখ্যা কত শ বা কত হাজার বাড়ল, হিসাবটা প্রথম দিকে রাখলেও দ্রুত তা আমাদের গা-সওয়া হয়ে যায়। আর ইউক্রেনের খবর? সত্যি বলতে কী, রাখার সময়ই হয় না।
সমস্যা হল, যুদ্ধই তো একমাত্র বিপদ নয়, যুদ্ধের বাইরেও পৃথিবী বড়ই নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। ২০২৩ সালে প্যালেস্টাইনের নিহত-সংখ্যার থেকেও অনেক বেশি মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন ‘গান-ভায়োলেন্স’-এর দরুন। এক আমেরিকাতেই এই বছর চলে গেছে চল্লিশ হাজারের বেশি প্রাণ, বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যা-সহ। গড়ে দিনে ১১৮। এর মধ্যে ১৩০৬ টিনএজার, ২৭৬টি শিশু। আমেরিকার বন্দুক-হিংসা নিয়ে অনেক কথা হয় বটে,তবে ইউরোপও দ্রুত ধরে ফেলছে অতলান্তিক পাড়ের মিত্র দেশকে। এই ডিসেম্বরে প্রাগ ইউনিভার্সিটিতে বন্দুকবাজ ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে নিয়ে নিল ১৪টি প্রাণ, আহত ২৫। এমন ঘটনা সে দেশের ইতিহাসে কস্মিন্কালেও ঘটেনি। কিন্তু এ সবও ‘স্বাভাবিক’ আমাদের কাছে, তাই ‘বড় খবর’ হয় না।
স্বাভাবিক, কেননা এই সময়ের স্ব-ভাবই হল এক পরিব্যাপ্ত স্বাধীনতাবিরোধী মানস-আবহ। এই সেই আবহ, যা স্বৈরতন্ত্রের ধ্বজা হাসতে হাসতে উড়িয়ে দেয়। এই সেই আবহ, যা গণতন্ত্রের শিকড়ে কুড়ুল মেরে নিজ লক্ষ্যে পৌঁছয়। নেদারল্যান্ডস-এর গিয়ার্ট ওয়াইল্ডার্স তো নতুন মুখ নন, দশকাধিক কাল ধরে তিনি ও দেশে চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির জাল বিছিয়ে চলেছেন, কিন্তু এই বছরেই ফল ফলল, জাতীয় নির্বাচনে তিনি পৌঁছলেন চূড়ান্ত সাফল্যে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতি থেকে শুরু করে ইউরোপীয় সমাজের হাওয়া পাল্টাচ্ছে, শরণার্থী-উদ্বাস্তু বিরোধিতার জোর বাড়ছে। প্রাগ আর অ্যামস্টারড্যাম-এর ঘটনাকে তাই বিচ্ছিন্ন ভাবা চলে না। তবে সে যা-ই হোক, আমাদের কাছে দুটোই সামান্য, স্বাভাবিক খবর।
এমন ভাবেই ‘স্বাভাবিক’ ছড়িয়ে আছে গোটা পৃথিবীতে। এশিয়ায়— আমাদেরই ঘরের পাশে পাকিস্তান তর্জন-গর্জন করে দেশছাড়া করল হাজার হাজার আফগান শরণার্থীকে, শীতের পাহাড়ে তাঁরা পথ হেঁটে চলেছেন পশ্চিমপানে, যেখানে তালিবান কঠোর হাতে লোফালুফি খেলবে তাঁদের নিয়ে। ভারতও এই হিংসাবিশ্বে একটি আলাদা শিরোপা দাবি করতে পারে মণিপুরের সৌজন্যে। অনেক রেকর্ড টপকে যেতে পেরেছে ৭৫ বছর পার করে ‘অমৃতকাল’-এ পৌঁছনো এই দেশ। আফ্রিকায়— গণতন্ত্রবিরোধী অভ্যুত্থান এ বছর ফুলেফেঁপে বিজয়ী: নাইজারে, সুদানে, গ্যাবনে। প্রতি দেশেই প্রধান চেষ্টা থেকেছে নির্বাচন নামক জঞ্জালটাকে কোনও মতে সরিয়ে দেওয়ার। দক্ষিণ আমেরিকায়— আর্জেন্টিনার নতুন প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই বিদ্বেষবাণী ছড়িয়েই ভোটে বিপুল ভাবে জিতে এলেন।
২০২২ সালকে বলা হয়েছিল বিশ্বময় গণতন্ত্র-যাত্রার ধারাবাহিক ভাবে নীচের দিকে নামার সতেরোতম বছর। ২০২৩ সেই ধারায় আঠারোতম। কেবল গণতন্ত্রের পরীক্ষায় পিছিয়ে-থাকা দেশগুলি আরও পিছিয়ে যাচ্ছে, এটাই নয়। যারা এত দিন বিরাট নম্বর নিয়ে গণতন্ত্র-আকাশে তারকা হিসাবে গণ্য হয়েছিল, সে-সব দেশের মানুষ স্থির করছে গণতন্ত্রের সাহায্য নিয়েই উদারতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে টুঁটি টিপে মারার ব্যবস্থা করবে। এই সুতোতেই বাঁধা আমেরিকায় এলোপাথাড়ি বন্দুকবাজি আর গর্ভপাত-বিরোধিতার উদ্দামতা। যে দেশের দিকে কয়েক বছর আগেও বিশ্বদুনিয়া তাকিয়ে থাকত ব্যক্তি-স্বাধীনতার ব্যাকরণ শিখতে, সেই দেশের মেয়েরা ২০২২ সালে বহুলাংশে হারাল নিজ দেহের উপর অধিকার, আর ২০২৩ সালের শেষে দেখা গেল ওহায়োর এক মেয়ের ‘মিসক্যারেজ’ হওয়ায় এখন তাঁর কঠিন শাস্তি হতে চলেছে— দীর্ঘ কারাবাস।
সুতরাং যা কিছু দেখছি আমরা, সবই সময়ের স্ব-ভাব: পরিবেশ পরিবর্তন, বিশ্ব উষ্ণায়ন, শক্তি সঙ্কটের প্রচণ্ডতা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর উদ্দাম গতি ও অপব্যবহার, যুদ্ধসংঘর্ষে দেশছাড়া মানুষের ঢল, অর্থব্যবস্থা সঙ্কট, তার থেকে জন্ম নেওয়া বিরাগ-বিতৃষ্ণা, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া জাতিবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ। আর সব মিলিয়ে, পাশের মানুষ, যে কোনও মানুষের প্রতি অকারণ আক্রমণপ্রবণতা।
এ বার তা হলে প্রস্তুত হতে হবে। একের পর এক তীব্র ঘটনার অভিঘাতে স্তব্ধ থাকা বা বিলাপ করা সহজ। কিন্তু সে সব অতিক্রম করে আবার পথ চলার ‘প্রস্তুতি’টা সহজ নয়। কী ভাবে শুরু করা যায়, ভাবতে বসেছিলাম বছরশেষে। “পৃথিবী পায়ের নীচে চুপি চুপি করিছে মন্ত্রণা/ সরে যাবে বলে/ আঁকড়ি ধরিতে চাহি উৎকণ্ঠায় শূন্য আকাশেরে/ দুই বাহু তুলি’/ চমকিয়া স্বপ্ন যায় ভেঙে/ দেখি তুমি নতশিরে বুনিছ পশম/ সৃষ্টির অমোঘ শান্তি সমর্থন করি।” (রবীন্দ্রনাথ: রোগশয্যায়) আচ্ছা, অনাথ অসহায় অন্নহীন আশ্রয়হীন শিশু যদি গাজ়ায় নতুন বছরে ঘুম ভেঙে নতুন করে দিন শুরু করতে পারে, তা হলে আমাদের এই হতাশায় ডোবা, যন্ত্রণায় সরে যাওয়ার চেষ্টা করা কি একান্ত অন্যায় ‘প্রিভিলেজ’ বা সুবিধাবাদ নয়, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নয়?
সেই বস্তাপচা জিনিসটাতেই বোধ হয় ফিরতে হবে আবার— ‘ভরসা’। ভরসা ধরে এবং ভরে রাখতে হবে মনের কোণে, না হলে প্রস্তুতির প্রথম পা-ও ফেলা যাবে না। ভরসা বা আশা বলতে অনেকে ভাবেন অকারণ স্বপ্ন, অবোধ প্রগতি-বোধ। কিন্তু যদি সে ভাবে না দেখি? যদি ভাবি, ভরসা হল একটা দায়িত্ব, একটা কর্তব্য— নৈতিকতাবোধে নিষিক্ত জীবন বাঁচার প্রাথমিক ও আবশ্যিক ধাপ? নৈষ্কর্ম্য আর অবসাদের সঙ্গে লড়ার একমাত্র অস্ত্র?
যত ধাক্কা খাব, যত ভেঙে যাব, ততই বরং নিশিদিন পণ করে ভরসাটাকে বাঁচিয়ে রাখি। স্বাভাবিক বলে মেনে না নিয়ে এ সব কিছু নিয়ে নিরন্তর প্রশ্ন তুলি। ‘সময়ের স্বাভাবিকতা’রদলে বরং একটা ভিতর-বিশ্বাসের স্বাভাবিকতার কথা জানি, ভাবি, বলে যাই। এটাই তবে হোক প্রস্তুতি।