দ্রষ্টা: ভীমরাও রামজি আম্বেডকর। ১৯৫১ সালে।
ভারতীয় সংবিধানের মূল রচয়িতা কে, এই প্রশ্নের উত্তরে স্কুলপড়ুয়ারাও নির্দ্বিধায় হাত তুলে বলবে, ভীমরাও রামজি আম্বেডকর। তাঁর নাম আমরা স্মরণে রেখেছি, কিন্তু তাঁর উচ্চারিত কথাগুলো গণস্মৃতি থেকে প্রায় মুছে গিয়েছে। এখন আম্বেডকরের কিছু কথা স্মরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে; অন্তত এ কারণে যে, আম্বেডকর এ দেশের সংবিধানের পিতা। জাতি হিসেবে নানা বজ্জাতি সত্ত্বেও আমরা টিকে আছি— কিন্তু দেশ, দেশের অর্থনীতি, দেশের সংবিধান, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র আজ সঙ্কটাপন্ন, নানা প্রশ্নের মুখোমুখি।
আর্থিক বৈষম্যের কথাই যদি ধরি, অর্থনীতিবিদ তোমা পিকেটি ও তাঁর সহযোগী গবেষকদের এক সমীক্ষা বলছে যে, ভারতে অসাম্যের মাত্রা বাড়তে বাড়তে পৌঁছে গিয়েছে ঔপনিবেশিক আমলের স্তরে। মাত্র এক শতাংশ মানুষ দেশের প্রায় অর্ধেক সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছেন। অন্য দিকে, শক্তি খুইয়েও বিজেপি আবার ক্ষমতায়। ফলে, গণতন্ত্রের যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল গত দফায়, তার থেকে মুক্তি মিলবে, তেমন আশা করতে সাহস হয় না। এখনই না হলেও সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতেই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি চালু হবে। ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ বলবৎ হবে। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে দল বা তার নেতাদের ভূমিকা মহাভারতের নকুল-সহদেবের চেয়েও নগণ্য, তারাই আজ সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক! গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বিরোধী দলগুলির উপস্থিতি। আশ্চর্য লাগে যে, রাজনীতির ময়দানে অহি-নকুল সম্পর্ক, এমন দলগুলিও নিজেরা যেখানে ক্ষমতায় আছে, সেখানে বিরোধীদের সম্বন্ধে একই রকম মনোভাব পোষণ করে— কেউ বিরোধীদের বিসর্জন দিতে বলে; কেউ আবার বিরোধীদের ‘দেশদ্রোহী’ আর বুদ্ধিজীবীদের ‘আরবান নকশাল’ বলে দেগে দিয়ে জেলে ভরতে চায়। ভাবতে অবাক লাগে, এ রকম একটা পরিস্থিতির নিশ্চিত উদ্ভব-সম্ভাবনার কথা আম্বেডকর অনুমান করেছিলেন, আজ থেকে প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে।
১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বর ভারতীয় গণপরিষদে তাঁর সর্বশেষ বক্তৃতায় আম্বেডকর এই বিপদের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে ঠিকই, কিন্তু এ দেশের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ কী? দেশবাসী কি এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে, না কি আবার তারা স্বাধীনতা হারিয়ে স্বৈরাচারের কবলে পড়বে? এই প্রশ্নটিই আম্বেডকরকে সবচেয়ে বেশি পীড়িত করেছিল। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন— এমন নয় যে, ভারত আগে কখনও স্বাধীন ছিল না। দেশ স্বাধীন ছিল, কিন্তু দেশ তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারেনি। ভারত তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল পারস্পরিক সন্দেহ আর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। আমাদের কপালে সুদীর্ঘ দাসত্ব জুটেছিল। ইতিহাস কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে?
আম্বেডকরের দুশ্চিন্তার কারণ ছিল, কেননা আমাদের পুরনো শত্রু জাত আর বর্ণবিভাজনের সঙ্গে নতুন শত্রু পরস্পর-বিরোধী বহু রাজনৈতিক দল আর তাদের সঙ্কীর্ণ মতাদর্শের আবির্ভাব ঘটেছিল। রাজনৈতিক দলগুলি যদি দেশের কল্যাণের চেয়ে তাদের মতাদর্শকেই প্রাধান্য দেয়, তা হলে স্বাধীনতার বিপদ অবশ্যম্ভাবী। গণতান্ত্রিক সংবিধানের বিপন্নতা অনিবার্য, অপ্রতিরোধ্য। আর যদি দেখা যায় সংবিধানের অপব্যবহার ঘটছে, তা হলে ‘আই উইল বি দ্য ফার্স্ট টু বার্ন ইট’। অপব্যবহার ঘটলে তাঁরই তত্ত্বাবধানে রচিত সংবিধান তিনি জ্বালিয়ে দেবেন, বলেছিলেন আম্বেডকর।
অথচ এমন নয় যে, এ দেশ গণতন্ত্রের কথা জানত না। আম্বেডকর স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, একটা সময় ছিল, যখন ভারত শাসিত হত প্রজাতন্ত্রের দ্বারা। রাজতন্ত্রও ছিল। কিন্তু রাজা হতেন নির্বাচিত রাজা। তাঁর ক্ষমতাও ছিল সীমিত। তাঁরা কেউই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। এ দেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের কথাও জানত। আম্বেডকর বৌদ্ধ ভিক্ষু সঙ্ঘের কথা উল্লেখ করে বললেন যে, বৌদ্ধ সঙ্ঘ আসলে এ কালের পার্লামেন্ট। সঙ্ঘের অধিবেশন পরিচালনায় নিয়মতান্ত্রিকতা বুদ্ধ নিশ্চয়ই সমকালীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকেই গ্রহণ করে থাকবেন। কালক্রমে দেশ এই ব্যক্তিস্বাধীনতা আর তার গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেছিল। দেশ কি আবার তা হারাতে চলেছে? আম্বেডকর সঠিক জানেন না। কিন্তু তিনি নিশ্চিত জানতেন— ভারতবর্ষের মতো দেশ, যেখানে গণতন্ত্রের অনুশীলনে দীর্ঘ দিন ছেদ পড়ে গেছে, সেখানে গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত একনায়কতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে। আকারে-প্রকারে গণতন্ত্রের ঠাট বজায় রইল, কিন্তু কাজকর্মে তা নায়কতন্ত্রের শাসনে পর্যবসিত হল।
এর থেকে অব্যাহতির উপায় কী? আম্বেডকর জন স্টুয়ার্ট মিল-এর সতর্কবাণী স্মরণ করেছেন— গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে কোনও মহাপুরুষের চরণে স্বাধীনতা বিসর্জন দেওয়া চলবে না; কিংবা তাঁকে এতটা ক্ষমতা অর্পণ করা যাবে না যাতে তিনি সমস্ত গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলতে পারেন। আম্বেডকর মনে করতেন, ভারতের মতো ব্যক্তিপুজোর এমন বাড়াবাড়ি পৃথিবীর আর কোনও দেশে নেই। ধর্মের ক্ষেত্রে ভক্তি বা ব্যক্তিপুজো আত্মমুক্তির একটা পথ হতে পারে। কিন্তু রাজনীতিতে ব্যক্তিপুজো নিশ্চিত ভাবে স্বৈরতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে। এ দেশে ‘বিশ্বগুরু’র প্রাদুর্ভাব সে সম্ভাবনাকে স্পষ্ট করে তুলেছে।
আম্বেডকরের মনে হয়েছিল যে, রাজনৈতিক গণতন্ত্র যথেষ্ট নয়। রাষ্ট্রের প্রকৃত বিকাশে প্রয়োজন সামাজিক গণতন্ত্র— যা সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতাকে সমাজজীবনের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসাবে স্বীকৃতি দেবে। সাম্য না থাকলে স্বাধীনতা সমষ্টির উপরে মুষ্টিমেয়র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। সাম্য না থাকলে স্বাধীনতা ব্যক্তি-উদ্যোগ বিনষ্ট করবে। ভারতীয় সমাজে দু’টি জিনিসের প্রকট অভাব আম্বেডকর লক্ষ করেছিলেন। প্রথমত, সাম্যের অভাব। এ দেশের সমাজ সুদীর্ঘকাল ক্রমান্বয়ী অসাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। সমাজের উপরতলায় মুষ্টিমেয় মানুষ প্রভূত বিত্তের অধিকারী। বাকিদের দিন গুজরান করতে হয় অপরিসীম দারিদ্র আর দৈনন্দিন লাঞ্ছনার মধ্যে। আম্বেডকর স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি দেশ আনুষ্ঠানিক ভাবে এই সামাজিক বৈপরীত্যের মধ্যে প্রবেশ করতে চলেছে। তিনি বললেন, রাজনীতিতে আমরা ‘ওয়ান ম্যান, ওয়ান ভোট অ্যান্ড ওয়ান ভোট ভ্যালু’ স্বীকার করেছি। কিন্তু আর্থ-সামাজিক জীবনে, বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কাঠামোর কারণেই আমরা ‘ওয়ান ম্যান, ওয়ান ভ্যালু’র নীতিকে বিসর্জন দিয়েছি। এই ব্যবস্থার আশু সমাধান দরকার। এই বৈপরীত্য অবসানে বিলম্ব হলে, আম্বেডকর মনে করতেন, যারা এর জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারাই যত শীঘ্র সম্ভব এই ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে উদ্যোগী হবে। দ্বিতীয় যে অভাবটির কথা আম্বেডকর বলেছিলেন, তা ভ্রাতৃত্ববোধের অভাব। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন সবাইকে বিকাশের সমান সুযোগ দিতে হবে। মুখে বলব, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’, আর কর্মক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রাখব, এ চলতে পারে না।
আম্বেডকর স্মরণ করেছেন, সংবিধানের ‘দ্য পিপল্ অব ইন্ডিয়া’ কথাটি অনেকেরই মন-পসন্দ হয়নি। তাঁরা চাইছিলেন ‘দ্য ইন্ডিয়ান নেশন’ কথাটি ব্যবহার করা হোক। আম্বেডকরের মনে হয়েছিল যে, নিজেদের জাতি হিসাবে পরিচয় দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা আছে। হাজার হাজার জাতি-জনজাতিতে বিভক্ত নাগরিক সমাজ কী ভাবে নিজেদের এক জাতি বলে পরিচয় দেবে? ‘দ্য কাস্ট্স আর অ্যান্টিন্যাশনাল’। কেননা, জাতবিভাজন সমাজজীবনে বিভেদ আনে। পরস্পর বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। ভ্রাতৃত্ববোধ ছাড়া সাম্য ও স্বাধীনতা অর্থহীন।
আম্বেডকর সঠিক বুঝেছিলেন যে, এ দেশ দীর্ঘ দিন ধরেই মুষ্টিমেয়র রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রের কবলে পড়ে আছে। বাকিরা কেবল দেশের ভারবাহী পশুই নয়, ক্ষমতাবানদের শিকারের জন্যই বলিপ্রদত্ত। ক্ষমতার এই একচেটিয়া ভোগবাদ ক্ষমতাবানদের নির্মম ও দুর্বিনীত করে তুলেছে। আর কোটি কোটি দলিত সুদীর্ঘ ভারবহনের ন্যুব্জ ক্লেশ সইতে সইতে আজ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। আম্বেডকরের স্থির বিশ্বাস ছিল, দলিতরা এর অবসান চাইবেই। সেই চাওয়াটা সুস্থির শান্তিতে, না কি অস্থির শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে, তা নির্ভর করবে ক্ষমতাবানদের সুবুদ্ধি আর সুবিবেচনার উপর।