নেতাজি ছিলেন হিন্দু মহাসভার প্রবল বিরোধী: এটাই কিন্তু তথ্য
PM Narendra Modi

কথায় কাজে এত ফারাক

নরেন্দ্র মোদী সত্যিই নেতাজির দেখানো পথে চললে বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের জেল থেকে মুক্তি মিলত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:২৬
Share:

অনুসারী? নেতাজির মূর্তির আবরণ উন্মোচনে নরেন্দ্র মোদী, নয়াদিল্লি, ৮ সেপ্টেম্বর। পিটিআই

১৯৩৮ সালের ১৯ অক্টোবর। কংগ্রেসের তদানীন্তন সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু মুম্বই থেকে কলকাতার ট্রেনে বসে চিঠি লিখছেন জওহরলাল নেহরুকে। ‘মাই ডিয়ার জওহর’ সম্বোধনে চিঠির শুরুতেই সুভাষচন্দ্র লিখছেন, “তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ আমি কেমন আজব প্রাণী যে তোমার এতগুলো চিঠির একটারও জবাব দিইনি, যদিও সবই ঠিক মতো পেয়েছিলাম।” আর চিঠির শেষে? সুভাষচন্দ্র নেহরুকে লিখছেন, “আমার আশা, তুমি যোজনা কমিটির চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করবে। এই কাজ সফল হতে হলে তোমাকে করতেই হবে।” দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কেন জাতীয় স্তরে পরিকল্পনা বা যোজনা তৈরির দরকার, ১৯৩৮-এর হরিপুরা কংগ্রেসেই তার ব্যাখ্যা করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। বছর শেষের আগেই ডিসেম্বরে তিনি ‘জাতীয় যোজনা কমিটি’ উদ্বোধন করেন। জওহরলাল নেহরুই তার প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৪৬-এ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরে এই জাতীয় যোজনা কমিটিই উপদেষ্টা যোজনা পরিষদের চেহারা নেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তৈরি হয় যোজনা কমিশন।

Advertisement

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে প্রথমেই যে কাজটি করেছিলেন, তা হল নেতাজির পরিকল্পিত যোজনা কমিশন তুলে দেওয়া। সে সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না ভুল, সে প্রশ্নের উত্তর সময় দেবে। আট বছর পেরিয়ে মোদী এখন দাবি করলেন, তাঁর সরকার গত আট বছর নেতাজির নীতি মেনেই চলেছে!

সব ক্ষেত্রে সমালোচকদের প্রশ্ন তোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। সময় নিজেই রাজনীতিকদের মুখের সামনে আয়না তুলে ধরে। সেই আয়নায় রাজনীতিকদের দ্বিচারিতা ফুটে ওঠে। কথা ও কাজের মধ্যে ফারাক ধরা পড়ে যায়। আমজনতার সামনে বুক ফুলিয়ে দাবি ও বাস্তবের নীতির মধ্যে বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

Advertisement

দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদীর ক্ষেত্রে ‘অমৃত কাল’-এর প্রথম এক মাসের মধ্যে দু’বার এই ঘটনা ঘটল।

স্বাধীন ভারতের পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে স্বাধীনতার শতবর্ষ পর্যন্ত আগামী পঁচিশ বছর সময়কালকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই ‘অমৃত কাল’ বলে ঘোষণা করেছেন। সেই অমৃত কালের শুরুতে স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লা থেকে নরেন্দ্র মোদী মহিলাদের সম্মান নিয়ে সরব হয়েছিলেন। নালিশ করেছিলেন, এ দেশের মানুষের রোজকার কথাবার্তায়, আচরণে নাকি মহিলাদের অসম্মান করার অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই বদভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। দেশের স্বপ্নপূরণে নারী-শক্তির গুরুত্বের কথাও বলেছিলেন। সে দিন বিকেলেই মোদীর গুজরাতে চরম অসম্মানের শিকার বিলকিস বানোর গণধর্ষণে দোষী সাব্যস্তদের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। ওই ১১ জন দোষী সাব্যস্ত অপরাধীর আইনজীবী ঋষি মলহোত্র জানিয়েছেন, কেন্দ্রের অনুমতি নিয়েই জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

তার পরে এক মাস সময় কেটে গেলেও নরেন্দ্র মোদী এ নিয়ে মুখ খোলেননি। এ বার তিনি দিল্লির রাজপথের নাম বদলে ‘কর্তব্য পথ’ নাম রেখে সেখানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানেই দাবি করেছেন, স্বাধীনতার পর থেকেই নেতাজির দেখানো পথে চললে দেশ অনেক উচ্চতায় পৌঁছতে পারত। তবে তাঁর সরকার গত আট বছর নেতাজির দেখানো পথেই চলেছে।

নরেন্দ্র মোদী যখন ‘কর্তব্য পথ’-এ দাঁড়িয়ে এই দাবি করছেন, ঠিক সেই সময়ই রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট জানাল, মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে ভারত পিছিয়েই রয়েছে। প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল, স্কুল-কলেজে শিক্ষার মেয়াদের মতো মাপকাঠিতে পিছিয়ে পড়েছে ভারত। ১৯৩টি দেশের মধ্যে ভারত ১৩২তম স্থানে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভুটানের থেকে ভারত পিছিয়েই থাকছে। তার কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে কম ব্যয়।

রাষ্ট্রপুঞ্জের এই রিপোর্ট একটাই বার্তা দেয়। রাজপথ ঢেলে সাজানো বা আকাশছোঁয়া মূর্তি তৈরি নয়। করদাতাদের অর্থ থেকে নরেন্দ্র মোদীকে আসলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি খরচ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নামে স্কুল তৈরি বা নতুন করে ইতিহাস লেখার বদলে শিক্ষায় ব্যয়বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য খাতেও একই প্রয়োজন। সদ্য প্রকাশিত স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অবশ্য বলছে, মোদী জমানায় জিডিপি-র তুলনায় সরকারের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের হার ক্রমশ কমেছে। নেতাজি কিন্তু স্বাধীন ভারত ও তার সমস্যা নিয়ে বক্তৃতা, লেখায় বরাবরই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্রের সমস্যার কথা বলেছিলেন। স্বাধীন ভারতের পুনর্গঠন বলতে তিনি সামাজিক পুনর্গঠনই বুঝতেন।

নরেন্দ্র মোদী সত্যিই নেতাজির দেখানো পথে চললে বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের জেল থেকে মুক্তি মিলত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। নারীদের সম্মানের পক্ষে সওয়াল করার পরে বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের জেল থেকে মুক্তি দিয়ে মহিলাদের অসম্মান করা হল কি না, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মতামত জানা যায়নি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা ধর্ষণকারীদের বীরের মতো সংবর্ধনা জানিয়েছে। বোধ হয় বিলকিস বানোর নারী পরিচয়ের তুলনায় এ ক্ষেত্রে তাঁর মুসলিম পরিচয়ই বড় হয়ে উঠেছিল। সামনে গুজরাতের বিধানসভা ভোট। বিজেপি নেতারা বলছেন, ধর্ষণকারীরা যে হিন্দু ব্রাহ্মণ, সেটা মাথায় রাখা দরকার। উল্টো দিকে আসাদুদ্দিন ওয়েইসি মুসলিমদের প্রতি এই অবিচার নিয়ে সরব হয়ে গুজরাতের ভোট ময়দানে নামছেন। দুই মিলিয়ে ধর্মের নামে বিভাজন তৈরি করে মেরুকরণের মঞ্চ সাজানো হয়ে গিয়েছে।

বিলকিস বানোর মতো ঘটনা নিয়ে বিতর্কের সময় নরেন্দ্র মোদী সাধারণত নীরব থাকেন। যখন স্বঘোষিত গোরক্ষা বাহিনী মুসলিম বলে দরিদ্র চাষি বা গোয়ালাদের পিটিয়ে মারে, তখনও তিনি মুখ খোলেন না। কোনও মুসলিম মোদী সরকারের সমালোচনা করলেই তাঁকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হলেও তিনি কিছু বলেন না। তিনি এ সবের থেকে নিজেকে ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কিন্তু এ বিষয়ে অনেক আগেই সতর্ক করে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশ জমানাতেও এই হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের চেষ্টা হয়েছিল। জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে নেতাজির মত ছিল, মুসলিমরা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বলে ব্রিটিশরাই মিথ্যে প্রচার করে। বাস্তবে দেশের মুসলিমরা জাতীয়তাবাদী। নেতাজির মত ছিল, মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতিতে কোনও রকম হস্তক্ষেপ করা চলবে না। সংখ্যালঘুদের ব্যক্তি আইন বজায় রাখার অধিকার রয়েছে। সংখ্যাগুরুর আইন চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। নরেন্দ্র মোদীর সরকার মুসলিমদের ব্যক্তি আইনে হস্তক্ষেপ করেই তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধের তকমা দিয়েছে। আর মুসলিমদের ব্যক্তি আইন তুলে দিয়ে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সকলের জন্য একই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা তো বিজেপি-আরএসএসের ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যেই পড়ে।

নেতাজির মূর্তির আবরণ উন্মোচন করে নরেন্দ্র মোদী জওহরলাল নেহরুর দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, স্বাধীনতার পরে নেতাজিকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। লাল কেল্লার বক্তৃতায় তিনি মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি, বাবাসাহেব আম্বেডকরের সঙ্গে হিন্দু মহাসভার নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে একই পঙ্‌ক্তিতে নিয়ে এসে বলেছিলেন, তাঁরা কর্তব্যের পথে নিজেদের জীবন ত্যাগ করেছেন। কর্তব্যের পথই তাঁদের জীবনের পথছিল। নরেন্দ্র মোদী হয়তো ভুলে গিয়েছেন, তাঁর তাত্ত্বিক গুরু ও ‘হিন্দুত্ব’ মতাদর্শের জনক সাভারকরের হিন্দু মহাসভা সম্পর্কে নেতাজি ১৯৪৪ সালে টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে কী বলেছিলেন! ‘ভারতের মৌলিক সমস্যা’ শীর্ষক সেই বক্তৃতায় নেতাজি বলেছিলেন, হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগকে ব্রিটিশরাই মদত দেয়। কারণ, তারা নীতিগত ভাবে ব্রিটিশপন্থী।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কি তাঁর ‘অখণ্ড ভারতের প্রথম প্রধান’ নেতাজির এই কথাটিও মেনে চলেন!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement