সদ্য মাধ্যমিক পাশ করেছে ছেলেমেয়ে, আলো-করা মার্কশিট পেয়েছে হাতে। তবু অভিভাবকদের চোখে-মুখে অন্ধকার। সুন্দরবন-হিঙ্গলগঞ্জ দ্বীপ অঞ্চলের বিশপুর, খেজুরবেড়িয়া, স্যান্ডেলেরবিল, যোগেশগঞ্জে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’ সংসারের সন্তানরা ভাল ফল করেও বিপদে ফেলেছে বাবা-মাকে। কারণ, পরের রাস্তাটা আর খুঁজে পাচ্ছেন না বড়রা। একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান পড়ানো হয়, এমন স্কুল পেতে হন্যে হচ্ছেন। গোটা হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের তেতাল্লিশটি মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের মাত্র একটাতে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি নেওয়া হচ্ছে একাদশে, তা-ও তিন বছর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞানের পঠনপাঠন বন্ধ থাকার পরে।
“অথচ এই হিঙ্গলগঞ্জের স্কুলে বিজ্ঞান পড়ে এক সময় অসামান্য ফল করে ছাত্রছাত্রীরা কলকাতার নামীদামি কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে সোনার মেডেল পেত। জাতীয় স্তরের বিজ্ঞান গবেষণায় নজির তৈরি করেছে, এমন ছেলেমেয়েও আছে,” খুব আক্ষেপ করে বলছিলেন গোবিন্দকাটি শিক্ষায়তনের অবসরপ্রাপ্ত এক বিজ্ঞান-শিক্ষক। কয়েক বছর আগে ওই স্কুলের বিজ্ঞান শাখা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
সুন্দরবনের স্কুলগুলোতে বিজ্ঞানশিক্ষা আজ নোনাধরা ইতিহাসের মতো। ভাঙাচোরা, বন্ধ ল্যাবরেটরির ফাটল-ধরা মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ। স্কুলে বিজ্ঞানচর্চায় ভাটা পড়ার জন্য ছাত্রদের আগ্রহও কমেছে। যে স্কুলটিতে একাদশে বিজ্ঞানের ছাত্র ভর্তি হচ্ছে, সেখানেও পড়ুয়ার সংখ্যা মাত্র ১৬! ব্লকে একটিমাত্র কলেজ, হিঙ্গলগঞ্জ মহাবিদ্যালয়। সেখানেও বিজ্ঞান শাখায় ভর্তির ব্যবস্থা নেই। এর সবটাই শিক্ষকদের অনাগ্রহে নয়। দীর্ঘ সাত বছর ধরে আমার নিজের বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান শাখা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি।
এর অন্যতম কারণ, বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক নেই! ২০১৪ সালে শিক্ষক বদলির নীতি নিয়েছে রাজ্য। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াও। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শিক্ষা দফতর ক্রমশ ‘কলকাতামুখী’ এক ব্যবস্থা তৈরি করছে। অভাবের যূপকাষ্ঠে আটকে ছটফট করেছে হাজার হাজার পড়ুয়ার স্বপ্ন। হিঙ্গলগঞ্জের স্কুলগুলোতেই এই সমস্যা সীমাবদ্ধ, এমনটা নয়। শিক্ষক সহকর্মীদের থেকে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ, সন্দেশখালি, মিনাখাঁ, বাগদা ব্লকের পাশাপাশি, পুরুলিয়ার মানবাজার, পুরুলিয়া ১, পশ্চিম মেদিনীপুরের জামবনি, রামজীবনপুর, উত্তর দিনাজপুরের চোপরা, ইটাহার, বীরভূমের রাজনগর, রামপুরহাট ১ ও ২ ব্লকের চিত্র হুবহু এক! হয় এই সব ব্লকে বিজ্ঞান পড়ানোর একটিও স্কুল নেই, অথবা সামান্য দু’একটা স্কুলে বিজ্ঞান রয়েছে।
রাজ্যে কত স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান পড়ানো হয়, সে বিষয়ে শিক্ষা দফতর কোনও তথ্য প্রকাশ করেছে বলে জানা নেই। তবে, ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ত প্রায় ৩ লক্ষ পড়ুয়া। ২০১৫ সালের সমীক্ষায় দেখা গেল, সেই সংখ্যা কমে ৯৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে। তার পরে, কমতে কমতে গোটা রাজ্যে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ুয়ার সংখ্যা ঠিক কোন তলানিতে নেমে এসেছে, পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের ওয়েবসাইটে আর আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভারতের শিক্ষা মন্ত্রকের সরকারি ওয়েবসাইটেও বিজ্ঞান পড়ুয়ার সাম্প্রতিক সংখ্যা উধাও হয়ে গিয়েছে! এই তথ্যও কি তবে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে পড়ে?
আক্ষেপ, যা কিছু অস্বস্তিকর, সরকারের ভাবমূর্তির পরিপন্থী, তাকে যেন তেন প্রকারেণ ধামাচাপা দেওয়ার আগ্রহ কেন্দ্র ও রাজ্য, সব সরকারি ব্যবস্থাতেই সমান। যথাযথ সুযোগের অভাবে দেশের মানবসম্পদের কতটা অবমূল্যায়ন হচ্ছে, কোন বিপর্যয়ের দিকে দেশ যাচ্ছে, দেশবাসীকে সে উপলব্ধি করার সুযোগটিও দিতে চায় না রাষ্ট্র! একটার পর একটা জনমোহিনী প্রকল্পের নীচে চাপা পড়ে যাচ্ছে আমাদের সন্তানদের বিজ্ঞান পড়ার অধিকার, শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ! এ ভাবেই আমরা স্মরণ করছি নবজাগরণের বাংলাকে, যা তৈরি করেছিল বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীদের। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহেন্দ্রলাল সরকার প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে এই বাংলাতেই ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। অত্যাধুনিক লেকচার থিয়েটার হল এবং বিশ্বমানের ল্যাবরেটরি গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। সেই ছাদের নীচেই একদা পদার্থবিদ্যায় জগদীশচন্দ্র বসু, রসায়নে কানাইলাল দে, গণিতে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ভূতত্ত্বে প্রমথনাথ বসু, জীববিজ্ঞানে নীলরতন সরকার-এর মতো পণ্ডিতরা ক্লাস নিতেন।
একটি সাক্ষাৎকারে, বাংলার বরেণ্য বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ বলেছিলেন, “গ্রামের স্কুলগুলি থেকেই বাংলার আগামীর বিজ্ঞানীরা উঠে আসবে!” বিজ্ঞানী মণি ভৌমিকের মতামতও তেমনই ছিল। অথচ, বছরের পর বছর বিজ্ঞান-শিক্ষকের অভাবে, জাতীয় পরিকল্পনায় সামগ্রিক বিজ্ঞান-চৈতন্যের অভাবে, গ্রামবাংলা জুড়ে, স্কুলের পর স্কুলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞান শাখা। গ্রামের স্কুলে পঠন-পাঠনের খামতি তুলে ধরতেও ভয় পাচ্ছেন শিক্ষক, পাছে সরকারি রোষানলে পড়ে যান!
বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান-শিক্ষাকে আকর্ষক না করে তোলার দায় থেকে শিক্ষকসমাজও মুক্ত নয়। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের বাইরেও মহাবিশ্বের যে অপূর্ব রহস্য ছড়িয়ে রয়েছে, তার অনুসন্ধানে শিশু-কিশোর মনকে প্রণোদিত করার চেষ্টা দেখা যায় না অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষে। নোটবই, পাঠ্যপুস্তকে বিজ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা চলে। কোন অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এখন বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন, বিগত দশকে কোন আবিষ্কারগুলো চমকে দিচ্ছে পৃথিবীকে, তার আলোচনা অধিকাংশ বিদ্যালয়ের ক্লাসঘরে ঢুকতেই পারে না!
সুতরাং সব দায় সরকারের, এমনও নয়। বিজ্ঞানের চাহিদা তৈরি করা শিক্ষকের কাজ, স্কুলের কাজ। শেষ অবধি রাষ্ট্র, শিক্ষক, অভিভাবক হাতে হাত রেখেই তো কাজ করতে হবে। আধুনিক বিশ্বকে গ্রহণ করার চৈতন্য জাগুক রাজ্যের প্রতিটা প্রান্তে, প্রত্যেক পাঠশালার ভিতরে এবং বাইরে। জীবনের চর্চায় বিজ্ঞান থাকুক স্বমহিমায়!
প্রধান শিক্ষক, কনকনগর এসডি
ইনস্টিটিউশন, হিঙ্গলগঞ্জ