—প্রতীকী চিত্র।
অসাম্য বাড়ছে, দেশের এক শতাংশ অতিধনীর হাতে দেশের সত্তর শতাংশ সম্পদ— কথাগুলো বেশ চালু হয়ে গিয়েছে। এতে মনে হয়, যেন অতিধনীরা এক দিকে, আর উল্টো দিকে গরিব শ্রমজীবী, মেধাজীবী মধ্যবিত্ত। উচ্চশিক্ষিত, বাক্যবাগীশ মধ্যবিত্তরাই জনমত গঠনে সবচেয়ে তৎপর। রাজনীতি ও প্রশাসনের উপর তাঁদেরই প্রভাব যথেষ্ট। তাঁরা সক্রিয়, সরব হওয়া সত্ত্বেও কেন অসাম্য বাড়ছে?
এর একটা সূত্র মিলতে পারে আয়ের বণ্টনের প্রকৃত ছবিটা দেখলে। প্রধানত দু’টি তথ্যসূত্র থেকে তার হিসাব মেলে, সরকারি (পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে) আর বেসরকারি (কনজ়িউমার পিরামিড হাউসহোল্ড সার্ভে, যা করে সিএমআইই সংস্থা)। দু’টি সমীক্ষা থেকেই রোজগেরে মানুষকে ১০টি সমান বর্গে ভাগ করলে, প্রতি বর্গে থাকবেন দশ শতাংশ ব্যক্তি। সরকারি সমীক্ষার নমুনা ছিল কম, প্রতিটি বর্গে পড়বেন একচল্লিশ হাজার ব্যক্তি, বেসরকারি সমীক্ষার ক্ষেত্রে সত্তর হাজার।
সরকারি তথ্য দেখাচ্ছে, ২০২১-২২ সালে প্রথম বা সর্বনিম্ন বর্গের মাথাপিছু মাসিক গড় আয় ছিল ৯২১ টাকা। পরিবারের সদস্যসংখ্যা সাড়ে চার, আর টাকার হিসাবটা ২০২২-এর বাজার দরে কষলে পরিবারগুলির মাসিক গড় আয় দাঁড়ায় ৪১৪৪ টাকা। আর সর্বোচ্চ, মানে দশম বর্গের ব্যক্তির গড় আয় ১৭,৬০৭ টাকা, পারিবারিক গড় আয় ৭৯,২৩১ টাকা। মানে, আয়ের তফাত উনিশগুণ!
‘মধ্যবিত্ত’ কথাটির অর্থ, বিত্তের নিরিখে যিনি মাঝামাঝি। আয়ের হিসাবে তাঁরা হবেন পঞ্চম বর্গের মানুষ। ২০২১-২২ সালে এই বর্গের মাথাপিছু মাসিক গড় আয় ছিল তিন হাজার টাকা, আর পারিবারিক গড় আয় ১৩,৫০২ টাকা। যে মধ্যবিত্তের ঘরে টিভি-ফ্রিজ রয়েছে, অনেকের হয়তো এসি, গাড়িও রয়েছে, বেসরকারি স্কুল-কলেজে যাঁরা সন্তানদের পড়ান, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করান, অর্থনীতির দৃষ্টিতে তাঁরা আসলে ‘মধ্যবিত্ত’ নন। তাঁদের গৃহপরিচারিকাকে বরং মধ্যবিত্ত বলা চলে।
অসাম্যের চিত্রটি অন্য একটি কারণে লক্ষণীয়। মাসিক মাথাপিছু গড় আয়ের নিরিখে প্রথম থেকে ষষ্ঠ, প্রতিটি বর্গের মধ্যে পারস্পরিক তফাত কম-বেশি মাত্র ৫০০ টাকা। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম বর্গের মধ্যে সেই তফাত কম-বেশি ১২০০ টাকা, অষ্টম ও নবম বর্গের মধ্যে ২১০০ টাকা। কিন্তু শুধু নবম আর দশম বর্গের মধ্যে তফাত দশ হাজার টাকা! এই দু’টি বর্গের মধ্যে আয়ের অসাম্য আড়াইগুণ। এ ভাবেও দেখা চলে যে, সর্বনিম্ন বা প্রথম বর্গের সঙ্গে নবম বর্গের তফাত আটগুণ। কিন্তু প্রথম বর্গের সঙ্গে দশম বর্গের তফাত উনিশগুণ। অর্থাৎ দশম বর্গটি একাই অসাম্যের এক বিশাল ব্যবধান তৈরি করছে।
বেসরকারি সমীক্ষা আরও বড় ফারাক দেখাচ্ছে— সর্বনিম্ন আর সর্বোচ্চ বর্গের মধ্যে আয়ের অসাম্য উনিশগুণের জায়গায় বাইশগুণ। সে জায়গায় সর্বনিম্ন বর্গের সঙ্গে নবম বর্গের ব্যবধান দশগুণ। অর্থাৎ, এই হিসাবেও শুধু দশম বর্গটি অসাম্যের পরিমাণ অনেকখানি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই সমীক্ষায় পঞ্চম বর্গের মাথাপিছু মাসিক গড় আয়ের পরিমাণ ৪,৬০২ টাকা আর পারিবারিক গড় আয় ২০,৮২৯ টাকা (২০২১-২২)। লক্ষণীয়, সমীক্ষার প্রশ্নের গঠন ও পদ্ধতির তফাতের জন্য বেসরকারি সমীক্ষায় প্রতিটি বর্গে মাথাপিছু এবং পারিবারিক আয়ের পরিমাণ সরকারি সমীক্ষা থেকে বেশি।
কিন্তু দু’টি সমীক্ষাই দেখাচ্ছে, সবচেয়ে উপরের বর্গে রয়েছেন সরকারি কর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, এবং অন্য সমগোত্রীয়রা, অর্থাৎ অধিকাংশ উচ্চশিক্ষিত এবং পেশাদার ব্যক্তি। যাঁরা নিজেদের মধ্যবিত্ত ভাবেন, আয়ের বিচারে তাঁদের সিংহভাগই দেশের ‘এলিট’।
অর্থাৎ ‘বিলিয়নেয়ার’ নন, তথাকথিত মধ্যবিত্তই অসাম্যের যথার্থ প্রতীক। কারণ দরিদ্র, শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে তাঁদের ব্যবধান সে ভাবে সামনে আসে না। সত্তর-আশির দশকেও দরিদ্র, নিম্নবিত্তের সঙ্গে স্বার্থের সংহতি তৈরি করতে আইন, প্রশাসনের আমূল পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন করেছে মধ্যবিত্ত। এখন অসাম্যের প্রশ্ন তুললে এঁরাই বিলিয়নেয়ারের দিকে আঙুল তোলেন।
মধ্যবিত্তের সঙ্গে দরিদ্রের এই ক্রমবর্ধমান ফারাকের কয়েকটি কারণ বলতেই হয়। গত ত্রিশ বছরে শিক্ষায় বেসরকারিকরণের ফলে শিক্ষার অসাম্য রোজগারের অসাম্যতে পরিণত হয়েছে। কর্মসংস্থানেও সেই চিত্র— ক্ষুদ্র উৎপাদন উদ্যোগে কর্মসংস্থান হয় চল্লিশ শতাংশ কর্মীর, আর বৃহৎ উদ্যোগে কর্মসংস্থান হয় ৩০ ভাগ রোজগারির। মাঝারি উদ্যোগে কর্মসংস্থান সবচেয়ে কম। কর্মসংস্থানের অসাম্যও তাই রোজগারের অসাম্য হয়ে দেখা দিয়েছে।
সরকারের ভূমিকাও কম নয়। সরকারি কর্মী যখন শহরে থাকেন, তাঁরা ভুলে যান যে শহুরে ধনীর থেকে শহুরে গরিবের তফাতটা গ্রামীণ অসাম্যের থেকে বেশি। অথচ, তাঁরা আক্ষেপ করেন যে তাঁদের করের টাকায় সরকার গরিবদের খয়রাতি দেয়। আয়কর কমানোর পক্ষে সওয়াল করেন। জনপরিসরের আলোচনায় এক শতাংশের সঙ্গে নিরানব্বই শতাংশের তুলনা করতে গিয়ে আসল অসাম্য এ ভাবেই আড়াল হয়ে যায়।