COP27

পরিবেশের ক্ষতি নিয়ে মিশর চুক্তি এক অর্থে উন্নত দুনিয়ার পাপের প্রায়শ্চিত্ত

কপ ২৭-এর আলোচনায় উন্নত দুনিয়া উষ্ণায়নে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছে।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২২ ১০:০০
Share:

বার্মিংহামের পর পরিবেশ নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের কনফারেন্স অফ পার্টিজের ২৭তম আলোচনার দ্বিতীয় দফা ছিল মিশরে। ছবি: সংগৃহীত

পাপের প্রায়শ্চিত্ত! গ্লাসগোর পর পরিবেশ নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের কনফারেন্স অফ পার্টিজের ২৭তম আলোচনার দ্বিতীয় দফা ছিল মিশরে। কপ ২৭ নামে বেশি পরিচিত এই আলোচনায় অবশেষে উন্নত দুনিয়া উষ্ণায়নে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছে। সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে পরিবেশবিদ সবাই একে ঐতিহাসিক আখ্যা দিয়েছেন। কারণ একটাই। সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষ থেকে শুরু করে পরিবেশ বদলের জন্য যে ক্ষতি তার শুরু উন্নত দুনিয়ার বেপরোয়া প্রকৃতি শোষণ। আর্থিক সমৃদ্ধির লোভে।

Advertisement

কিন্তু এই বেপরোয়া মনোবৃত্তি উন্নত দুনিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ভারত-সহ অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোও একই রাস্তায় হেঁটে একই আকাশ ছুঁতে চেয়েছে। বিগত কয়েক দশক ধরে তাই উন্নয়নশীল বনাম উন্নতের মধ্যে পরিবেশ রক্ষা নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছে দায় ও কর্তব্যের ভাগীদারি নিয়ে। পৃথিবীর সবুজ ধ্বংসের দায় কার, আর মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর খরচের ভাগীদারি কার ঘাড়ে কত। আকচাআকচি চলেছে বহুদিন ধরেই।

উন্নয়নশীল দেশগুলির যুক্তির মোদ্দা অংশটি ছিল কিছুটা এই রকম। গরিব দেশের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তোমরা ক্ষীর খেয়েছ। বদহজমের দায়টাও নিতে হবে তোমাদেরই। একই সঙ্গে আরও একটা যুক্তিও ছিল। যে প্রযুক্তি পরিবেশ বান্ধব, তা উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনামূলক দারিদ্রের প্রেক্ষিতে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই তাদের প্রথাগত প্রযুক্তি, যেমন কয়লার ব্যবহারে বেড়ি পরানো যাবে না। মিশরেই ভারতের কয়লার ব্যবহার হ্রাসের প্রসঙ্গ ওঠে। যুক্তি ছিল গত এক বছরে উষ্ণায়নে যে দু’টি দেশ অন্যতম ভাগীদার তার মধ্যে একটি আমেরিকা, অন্যটি ভারত! এই চাপে ভারত জল ঢেলেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে বহুবছর ধরে ভারত কার্বন নিঃসরণ নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। অবশেষে, গত বছর বার্মিংহামে প্রথম ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।

Advertisement

কার্বন নিঃসরণ শূন্য করার মানে এই নয় যে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ করা হবে না।কিন্ত সহজ করে বললে তা এমন জায়গায় থাকবে যাতে তা প্রকৃতি তা শুদ্ধিকরণ করে নিতে পারে। আর এইখানেই গাছ এবং জঙ্গলের মাহাত্ম্য। কিন্তু এটা আমরা জানি। কার্বন নিঃসরণের হার বাড়তে থাকলে এবং পাশাপাশি গাছের সংখ্যা কমলে প্রকৃতির পক্ষে সেই কার্বন নিঃসরণকে পরিবেশবান্ধব করে রাখতে পারে না। আর তাতে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ে। যেমন এখন বাড়ছে আর শুরু হয় প্রকৃতির প্রতিশোধ। ঝড়, বন্যা আর খরা আমাদের ধ্বংস করার রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে। করে বলা ভুল শুরু করে দিয়েছে।

ক্লাইমেট ট্রান্সপ্যারেন্সির হিসাব অনুযায়ী উষ্ণায়নের কারণে ভারতে ২০১৬ থেকে ২০২১ এর মধ্যে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ হেক্টর জমির শস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে ক্ষতির মূল্য ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। মাথায় রাখতে হবে ভারতে চাষযোগ্য জমি কিন্তু ১৫ কোটি ৫০ লক্ষ হেক্টরের মতো। তাহলে উষ্ণায়নের কারণে দেশের ক্ষতির পরিমাণটা কিন্তু সাংঘাতিক। পূর্ব উপকূলে তাপমাত্রা বাড়ছে। বাড়ছে ঝড়ের তীব্রতা ও সংখ্যা। বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি।

প্যারিস চুক্তিতে এই শতাব্দীর শেষে গিয়ে যাতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপর না বাড়ে তার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তিতে সই না করে গোটা আলোচনা থেকেই নিজেদের সরিয়ে নেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মিশরে এসে গোটা দেশের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে আবার এই আলোচনায় যোগ দেন। যাই হোক, এই ২ ডিগ্রির অঙ্কটা কিন্তু করা হয়েছে ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের গড় তাপমাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে।

কিন্তু আমরা কি পারব? পারতে গেলে প্রথমেই তো ঠেকাতে হবে সবুজের উপর কোপ। ব্রাজিল তার হঠকারী আর্থিক নীতির কারণে অ্যামাজনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সবুজের ধ্বংস যে মাত্রা নিয়েছে বিশ্বের ফুসফুস বলে পরিচিত অ্যামাজনের অরণ্যে তা আদৌ পূরণ করা সম্ভব কি না তা নিয়ে চলছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা। কিন্তু অ্যামাজনের ২০ শতাংশ বনাঞ্চল ইতিমধ্যেই আমাদের সভ্যতার বলি।ভারত ও বাংলাদেশের ১ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হারিয়ে গিয়েছে সভ্যতার আগ্রাসনে। জনসংখ্যা বেড়েছে। আর প্রকৃতি হারিয়েছে তার সবুজ। বন কেটে তৈরি হচ্ছে বসতি। আর কমছে প্রাকৃতিক কার্বন ফিল্টার গাছের সংখ্যা।

এই চুক্তিকে ন্যায় হিসাবেও দেখা হচ্ছে। কিন্তু কিসের প্রতি ন্যায়? ২০১৬ সালে ভুটানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরিং টবগে একটি আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রে প্রশ্নটি তুলেছিলেন। ভুটান শুধু ‘কার্বন নিউট্রাল’ নয়, ‘কার্বন নেগেটিভ’। মানে তাদের পরিবেশ শুধু ভুটানে নিসৃত কার্বন পরিশোধন করছে তাই নয়, প্রতিবেশি দেশগুলির কার্বনও পরিশোধন করে চলেছে। অথচ উষ্ণায়নের মূল্য তাদেরও চোকাতে হচ্ছে।

দুর্ভিক্ষ নিপীড়িত সোমালিয়া এবং নাইজ়ারেও একই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। উষ্ণায়নে এদের কোনও অবদান নেই। অথচ দশ বছরে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার খরার কারণে সেখানে দুর্ভিক্ষ। লক্ষাধিক শিশুর প্রাণ সংশয়ে।

ভারতে খরা, বন্যা, ঝড় কাড়ছে জীবনের শান্তি। ইউরোপ বা আমেরিকাও প্রকৃতির এই রোষ থেকে মুক্ত নয়।

টনক নড়তে শুরু করেছে। মিশর চুক্তি যার প্রতিফলন। ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণকে কমিয়ে শূন্যে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতিও আমাদের টনক নড়ার প্রমাণ। কিন্তু ক্ষতির মাপ ও তা সামলানোর পদক্ষেপও কিন্তু অত সোজা নয়। তাতেও কিন্তু পেটের টান পড়ার আশঙ্কা। আর এটাই কিন্তু একটা বড় ভয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের। কিন্তু সে প্রসঙ্গ অন্য আলোচনার দাবি রাখে। আপাতত মিশর চুক্তিকে উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক বড় পদক্ষেপ হিসাবে মানতেই হবে। কারণ, উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পথে উন্নত দুনিয়ার দায় স্বীকার করাটাই যে একটা বড় প্রতিবন্ধক হয়েছিল। প্রশ্ন একটাই, তাতেও মানব সভ্যতা বাঁচবে তো?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement