আচ্ছা দাদা, নিরাপত্তা মানে কি শুধু কয়েকখানা কোলাপসিবল গেট? কথাটা এক জন তরুণী হাউসস্টাফ বলল। আমাদের এখানেও ওই একই অবস্থা, দাদা। অন-কলদের থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। কোনও কোনও ডিপার্টমেন্টে ঘর থাকলেও দরজার ছিটকিনি নেই। ছেলেরা রাতে হস্টেলেই থাকে, হস্টেল থেকে বাইক নিয়ে আসে। আর, আমরা মেয়েরা, লম্বা লবি পেরিয়ে ওই রকম একটা সেমিনার রুমেই শুতে যাই। প্যাসেজের খানিকটা আবার অন্ধকার। আমাদের সঙ্গেও যে কোনও দিন...
একত্রিশ বছর বয়সি তরুণী ডাক্তারের উপর অত্যাচার এবং খুনের যে ঘটনা আমাদের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়, যেগুলি উঠে আসছে জমায়েত থেকে, মিছিল থেকে। এক জন পিজিটি বলল, কী জানো, আমাদের কাছে এটা শিক্ষাক্ষেত্র, আবার কর্মক্ষেত্র। কর্তৃপক্ষ বলছে, রাতে সেমিনার রুমে একা থেকে যাওয়া মেয়েটার বোকামি। মেয়েটার বোকামি কী ছিল বলো? শিক্ষাক্ষেত্রে বা কর্মক্ষেত্রে এই সুরক্ষাটুকু আশা করা? এক জন হাউসস্টাফ বলল, আচ্ছা, এখন তো শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের যৌন হেনস্থা রোধ করার জন্য বিভিন্ন আইন আছে, কর্মক্ষেত্রেও তাই। তা হলে, ছত্রিশ ঘণ্টা ডিউটির মাঝে দু’ঘণ্টা একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য এই মূল্য দিতে হবে কেন? এক জন ইন্টার্ন বলল, থানার ভিতরে পুলিশ খুন হয়েছে শুনেছ কখনও? দেখো, হাসপাতালে ডাক্তার খুন হয়ে গেল। এক জন রেসিডেন্ট ডাক্তার ইউটিউব ভিডিয়ো দেখিয়ে নিচু গলায় বলছিলেন, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখলে কেমন ভাবে পরিষ্কার হয়ে যায়, যৌন নিপীড়ন এবং হত্যা নয়; যথেচ্ছ অত্যাচার করাই যেন লক্ষ্য ছিল।
এত আক্রোশ কার? না কি কাদের? কিসের আক্রোশ? কথামতো চলেনি তাই? না কি, প্রতিবাদ করেছিল এমন কিছুর— যার স্বার্থ অনেক উপর তলা পর্যন্ত জড়িত! রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে এর পাশাপাশি সারা দেশের বিভিন্ন স্বাস্থ্য-প্রতিষ্ঠান কর্মবিরতিতে অংশগ্রহণ করে এই ঘটনার প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। কিন্তু প্রতিবাদ কি কেবল এই ঘটনার? আমরা কি জানি না, মাঝরাতে এক দল মত্ত লোক এক জন মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে এসে কী অপরিসীম চাপ তৈরি করে, হুমকি দেয়। কখনও কখনও তা হেনস্থার জায়গায় পৌঁছয়। রাতে পুলিশ ডাকলে ভোররাতে বা সকালে পুলিশ আসে খবর নিতে। কখনও বা আসেই না। সিভিক পুলিশ এসে খবর নিয়ে যায়। আমরা কি জানি না, কত সীমিত পরিকাঠামো নিয়ে কত কম লোকবল নিয়ে গ্রামীণ হাসপাতালগুলো কাজ করে।
একটা মৃত্যু কি খুব জরুরি এই প্রশ্নগুলো ওঠার জন্য— মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে এক জন আশাকর্মী এই প্রশ্ন করলেন। তাঁর মেয়েও ডাক্তারি পড়বে বলেছে। মাধ্যমিকে রেজ়াল্ট ভাল। মেয়ে বলেছে ‘জয়েন্টে’ ঠিক চান্স পেয়ে যাবে। মায়ের মুখে আশঙ্কা। সহকর্মী জড়িয়ে ধরছেন। সতীর্থরা মুছিয়ে দিচ্ছে সতীর্থের কপালের ঘাম, চোখের জল। জড়িয়ে ধরছে। তীব্র স্লোগান দিয়ে তারা ঢেকে নিচ্ছে তাদের মুখের আশঙ্কার দাগ।
এটা একটা মানসিকতা। ক্ষমতার প্রতি, সিস্টেমের প্রতি অনুগত না হলে, জোর করে চুপ করিয়ে দেওয়ার মানসিকতা। আর, প্রতিবাদী কোনও মেয়ে হলে তার রূপ কী হয়, তা তো দেখাই গেল। আর সেই জন্যেই, ভাতার স্টেট জেনারেল হাসপাতালে মত্ত সিভিক পুলিশের গলায় শোনা যায় আর জি করের ঘটনার পুনরাবৃত্তির হুমকি।
সিবিআই তদন্ত করবে এই ঘটনার। আশা করা যায়, তারা খুঁজে বার করতে সক্ষম হবে প্রকৃত অপরাধী(দের)। কাদের স্বার্থে ঘা লাগায় এমন ঘটনা ঘটল, তা-ও হয়তো সামনে আসবে। তবে তাতেই রাজ্যের সব দায় শেষ হয়ে যায় না। কথায় কথায় শোনা যায় ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ হল ‘স্টেট সাবজেক্ট’। তাই, সিবিআই তদন্ত করলেও এই আন্দোলনকারীদের এবং পরবর্তী কালে ডাক্তার, নার্স-সহ সমস্ত পেশার মানুষের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দায় কিন্তু থেকেই যায় রাজ্য সরকারের উপর।
স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পার করে, যে সময় দাঁড়িয়ে— গর্ভের অধিকার, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে; মাতৃত্বকালীন ছুটি অথবা বিভিন্ন পেশায় মাতৃত্বকালীন অবস্থায় কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির কথা বলা হচ্ছে— সেই সময়ে, এমন একটি ঘটনা সমাজকে অনেক অনেকখানি পিছনে ঠেলে দেয়। যে স্বাধীনতায় মেয়েরাও ছিলেন অংশীদার, সেই স্বাধীনতার রাতে, তাঁদের যখন আবার অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ের ডাক দিয়ে রাস্তায় নামতে হচ্ছে, তার অর্থ বুঝতে হবে, অর্ধেক আকাশের যতখানি প্রাপ্য ছিল, তাতে গ্রহণ লেগেছে।