দেশ ছেড়ে চলে আসার কিছু দিন আগের কথা রোমন্থন করছেন অজয় গুপ্ত। পশ্চিমের বারান্দায় বেলাশেষের আলো। তাঁর মা আর কাকিমা বসে গল্প করছেন। মা চুল বেঁধে দিচ্ছেন কাকিমার। লেখক তখন নিতান্ত বালক। কাকিমার বাপের বাড়ি থেকে এক জন আসেন। কাকিমার কাছে না গিয়ে সোজা ঠাকুমার কাছে চলে যান। কী যেন বলেন! তার পর, সারা বাড়ি জুড়ে একটা আর্তনাদ। বালকের কিছু বোধগম্য হয় না। ভয় লাগে কেমন। সে ছুট দিল। উঠোন, বাড়ি, শিবমন্দির পেরিয়ে সে চাচির কাছে আসে। চাচি মানে, হানিফদাদার মা। হানিফদাদা তার বাবার ছাত্র। এই বাড়িতে শিশুবেলা থেকে গতায়াত তার। হানিফদাদা তার বাবার কাছে পড়া শেষ করে শিশুকে কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে আসতেন এই বাড়িতে। সে দিনও একই, হানিফদাদা যথারীতি কাঁধে চাপিয়ে বাড়িতে নিয়ে এল বালককে। বাবা হানিফদাদার উদ্দেশে বলেন, “তোমার বাড়িতে গেছিল বুঝি? আমরা তো খুইজ্জা মরি। এদিকে তো বাড়িতে বড় দুঃসংবাদ হানিফ।” ক্রমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সাঁকো পেরোনোর সময় কারা যেন কাকিমার ভাইকে ছুরি মেরে হত্যা করে খালের জলে ফেলে দিয়েছে। এই স্মৃতিচারণ করছেন অজয় গুপ্ত তাঁর উদ্বৃত্তের ইতিবৃত্ত বইতে। লিখছেন অজয়: “আমার স্মৃতির সরণি জুড়ে একই ক্যানভাসে আঁকা এই দুখানি ছবি। চিত্রকর এখনও এই ছবির কোনো নাম দেননি। এক দিন দেবেন। আপাতত আমি একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন দিয়ে রেখেছি।”
এই জিজ্ঞাসার চিহ্ন ঘিরেই আজ আমরা ভাবতে চাইছি। এই যে উপরের স্মৃতির টুকরো, এই রকম বহু টুকরো ঘটনার কথা শুনতে শুনতে বড় হয়ে গিয়েছে প্রায় তিনটে প্রজন্ম। দেশ ছেড়ে আসার কষ্ট, ভিটেমাটি, গ্রাম, পুকুরপাড়, ইস্কুল ছেড়ে আসার কষ্ট, সে এক রকম। কিন্তু মানুষ ছেড়ে আসার কষ্টও কিছু কম না। বন্ধু, প্রেমিক, ছাত্র, মাস্টারমশাই, পাড়াতুতো ভাইবোন, উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া ভিন্ন ধর্মের পড়শি, আরও সব কত নাম দিতে না পারা সম্পর্ক ছেড়ে আসার কাহিনি।
এই সব চর্চা হয়েছে এক সময় নতুন দেশের অস্থায়ী ঠিকানায়, অদ্ভুত সব অন্ধকার ব্যক্তিগত সংগ্রামের দিনান্তে নিজের মানুষদের কাছে। অথবা, নতুন পড়শির কাছে। ধীরে ধীরে সয়ে গিয়েছে সবই জীবনের নিয়মে। দেশভাগ একটা দগদগে ক্ষত থেকে ক্রমাগত হয়ে উঠেছে ইতিহাস অথবা সাহিত্যের বিষয়। খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে যাকে নিরীক্ষণ করা যায়। অপরের গল্প হিসেবে ভেবে নেওয়া যায়। অ্যাকাডেমিক চর্চার পরিসরে সিনেমা, সাহিত্য, ইতিহাসের জট ছাড়াতে ছাড়াতে এক সময় তত্ত্বের আশ্রয় নেওয়া যায়। এ দেশের মানুষের ইতিহাসের চলমানতার এক অনিবার্য দলিল হয়ে যায় দেশভাগ। তাকে নিয়ে আলোচনা, লেখালিখি, দূরত্বের নরম পশমের প্রলেপ চলে ক্রমাগত।
তার পর ১৯৭১। বাংলাদেশ। রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীত, বাঙালি মানুষের জন্য, বাংলা ভাষায় কথা বলা একটা নতুন দেশ। একটা সখ্য, চলাচল, বিনিময়ের নতুন আশ্বাস। আর রয়েছে প্রজন্মের ফারাক। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নতুন করে ভাবতে শিখেছে, দ্বেষ, হিংসার ইতিহাসের অন্তরালে ঢাকা পড়ে যাওয়া সংস্কৃতির স্বাভাবিক টান। বাংলা গান, বাংলা কবিতা, উপন্যাস, নাটক সব মিলিয়ে নতুন একটা সম্পর্কের সূচনা। খবর আসতে থাকে যে ও দেশে গেলে কী অপূর্ব আপ্যায়ন, জড়তাবিহীন মধুর ধ্বনি বাজে। হিন্দু-মুসলমান ধর্ম পরিচয়ের সঙ্কীর্ণ পরিসর ছাড়িয়ে আত্মার সম্পর্কের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে। আমাদের অতীনের সঙ্গে মিলে যায় ওদের ইলিয়াস, আমাদের স্বপ্নময়ের সঙ্গে মিলিয়ে পড়ি ওদের শহীদুল, আমাদের জয় তো ওদের শামসুল। বইমেলায় একে অপরের সঙ্গে মত বিনিময়, তার পর রাত পেরিয়ে আড্ডা।
না, সবটাই যে সব সময় এমন সুন্দর আর অপার্থিব ছিল, সে কথা বলছি না মোটে। রাজনীতির টানাপড়েন ছিল দুই দেশের মধ্যে, তিস্তার জল নিয়ে হয়েছে তিক্ততা, দুই দেশেই ক্রমাগত মাথাচাড়া দিয়েছে মৌলবাদী শক্তি। ও-দেশে দাড়ি-টুপি আর এ-দেশে তিলক-ত্রিশূলকে মিথ্যা অস্ত্র বানিয়ে হিংসা বিনিময় ছিল অব্যাহত। সাধারণ নাগরিকের ভিতরেও কি মৌলবাদ ছিল না? ষোলো আনা ছিল। সামান্য উস্কানিতে দাঁত-নখ বেরিয়ে পড়ার নজির কিছু কম নেই। ওই দেশে যত সংখ্যালঘুর উপরে অত্যাচার বাড়তে আরম্ভ করল, এ-দেশেও ততটাই জোরদার হতে লাগল মৌলবাদের রেটরিক। ডাক্তার, আমলা, অধ্যাপক, তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায় থেকেই বুঝি বেশি করে ছড়িয়ে পড়ল এই বার্তা, ‘মনে রেখো এই দেশ তত ক্ষণই ধর্মনিরপেক্ষ যত ক্ষণ এ দেশে হিন্দুরা সংখ্যাগুরু’। তবে, ভারতবর্ষের সুবিধা হচ্ছে তার বিস্তার। নানা ভাষার, নানা পরিধানের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে চলে নানা মত। তাই ভিন্নমত প্রকাশ করার মানুষ রয়েছেন এখনও অনেক। সংখ্যালঘুর উপর আক্রমণ হলে আজও প্রতিবাদে মুখর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মৌলবাদের বিবিধ কুযুক্তি সত্ত্বেও আছে। অন্তত আজ যখন এই লেখা লিখছি, তখনও আছে।
আর বাংলাদেশ? সেখানকার মৌলবাদ নিয়ে ভাবিত হতে হয়। ভারতবর্ষের উপর সেখানকার আম নাগরিকের অযথা আক্রোশে অবাক হতে হয়। ভারত ক্রিকেট খেলায় হেরে গেলে, সে যে দেশের কাছেই হোক, তাদের উল্লাস দেখে বিমর্ষ হয়ে পড়ি। এ দেশের বাঙালির প্রতি তাদের বিদ্বেষে, রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ নিয়ে তাদের কটূক্তি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে আজকাল। তবুও সংস্কৃতির যুক্তি মনে রাখতে সচেষ্ট হই প্রতি দিন। অন্যরা তো রয়েছেন, যাঁরা আমাদের ডাকেন, আপ্যায়ন করেন, আমাদের বাড়ি আসেন, মত বিনিময়ের আন্তরিকতায় আপন হয়ে গিয়েছেন যাঁরা। আজ, এই পরিস্থিতিতে, তাঁদের কণ্ঠস্বর খোঁজার চেষ্টা করছি। তাঁরা কী বলছেন জানতে ইচ্ছে করছে। ও-দেশে প্রতি দিন যখন সংখ্যালঘুর জীবন বিপন্ন, যখন তাঁদের স্বাভাবিক জীবনের উপর মৌলবাদী আক্রমণ নেমে আসছে প্রতি দিন, দেশছাড়া হওয়ার উপক্রম যাঁদের, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে আপনাদের কণ্ঠস্বর শুনতে চাইছি আজ। অজয় গুপ্তের সেই জিজ্ঞাসার চিহ্নের জটিলতা নিয়ে আজ কান পেতে রয়েছি এ-বাংলার অনেকে। হানিফদাদাকে খুঁজছি আমরা। এত দিন যে বললাম সব “আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি”, তা তো আর কথার চালাকি নয়। ফাঁকি নয়। এত দিন তো মনে হত, দুই দিকেরই অনেক মানুষ এ কথা বিশ্বাস করেছি প্রাণপণ। এই মনে হওয়া কি ভুল ছিল? আপনাদের কণ্ঠস্বর শুনতে চাইছি আজ। খুব চাইছি। এখনও শুনতে পাচ্ছি না যে!
ইংরেজি বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়