নিজেদের সর্ব অর্থে ‘বঞ্চিত’ মনে করা বাঙালির পুরনো বদভ্যাস। এই ‘শহিদ শহিদ ভঙ্গি’ নিয়েই এক চূড়ান্ত আত্মপ্রসাদে তার দিন কেটে যায়। এ বিষয়ে তার অন্যতম প্রধান অবলম্বন যে ব্যক্তি, তাঁর নাম সুভাষচন্দ্র বসু। এক জন যথার্থ দেশনায়ক হিসাবে নয়, বাঙালি বরং সুভাষচন্দ্র বসুর মূল্যায়ন করতে শিখেছে ‘সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিক রাজনীতির শিকার’ এক জন বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবেই। ঠিক যেমন পাকিস্তানকে পরাভূত করতে না পারলে ভারতের জাতীয়তাবাদ পরিতৃপ্ত হয় না, তেমনই যে কোনও আলোচনায় ‘নেতাজি বনাম গান্ধীজি’— এই চিরন্তন বিতর্কে নেতাজিকে নৈতিক ভাবে জিতিয়ে না দিতে পারলে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সম্পূর্ণতা পায় না। এর বেশি কিছু আমরা নেতাজি সম্পর্কে জানি না, জানতে চাই-ও না।
আমাদের এই অনাগ্রহ অনিবার্য ভাবেই সঞ্চারিত হয় জাতীয় স্তরেও। এমনকি বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ তাঁর বই মেকার্স অব মডার্ন ইন্ডিয়া-তে যে উনিশ জনকে আধুনিক ভারতের রূপকার হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, তাঁদের মধ্যে অনুপস্থিত সুভাষচন্দ্র বসু। সঙ্কীর্ণতার অভিযোগ অবশ্য রামচন্দ্র গুহর বিরুদ্ধে তোলা যাবে না, কারণ তিনি তো তালিকার একদম শুরুতেই রেখেছেন রামমোহন রায়কে। কিন্তু নেতাজিকে তিনি সচেতন ভাবেই বাদ দিয়েছেন। কারণ হিসাবে বইয়ের ভূমিকাতে জানিয়েছেন যে, নেতাজির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বহুধাবিস্তৃত হলেও তাঁর মৌলিক লেখালিখির পরিমাণ খুবই কম হওয়ায় তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ও জাতিগঠনে তাঁর সুনির্দিষ্ট দর্শন বা পরিকল্পনার কথা বিশেষ জানা যায় না।
রামচন্দ্র গুহ এমন বলেছেন। আমরা বাঙালিরাই কি জানি, এক তরুণের স্বপ্ন ছাড়া নেতাজির লেখালিখির বিষয়ে? আমাদের যাবতীয় আগ্রহ তো বিমান দুর্ঘটনার সত্যাসত্য তাঁর কাল্পনিক প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে। পড়া তো দূরস্থান, অধিকাংশই খবর রাখি না যে দি এসেনশিয়াল রাইটিংস অব সুভাষচন্দ্র বোস নামে মোট বারো খণ্ডে সুভাষচন্দ্রের যাবতীয় লেখালিখি প্রকাশিত হয়েছে। নেতাজির এই বিপুল পরিমাণ মৌলিক লেখার খোঁজ রাখার প্রয়োজন কি আমাদের নেই? বাঙালি বলে তাঁকে নিয়ে উৎসব করার সঙ্গে তাঁকে জানার দায়িত্ব কি আমাদের নেই?
আরও খোঁজ করলে দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল নামে একটি বইয়ের সন্ধানও পাওয়া যেত। প্রথমে লন্ডনের এক প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত এই বইতে সমকালীন ভারতীয় রাজনীতি নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা এবং নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন বিধৃত রয়েছে। বইটি সে কালে বিদগ্ধ মহলে খুবই প্রশংসিত হয়েছিল। বিশিষ্ট ভারততত্ত্ববিদ রোম্যাঁ রঁল্যা বইটি পড়ে নেতাজিকে লেখেন, “এক জন যথার্থ ইতিহাসবিদের সমস্ত গুণাবলিই এই বইতে প্রকাশিত। …সক্রিয় রাজনীতিতে থেকেও নিজেকে দলমতের ঊর্ধ্বে রেখে নিজেকে বিচার করতে পারার দুর্লভ ক্ষমতা আপনার রয়েছে।”
সুভাষচন্দ্রের সেই গভীর রাজনৈতিক দর্শন কিন্তু আমাদের আকৃষ্ট করেনি। বাঙালি তাই আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক হিসাবে সামরিক পোশাক পরিহিত অশ্বারোহী নেতাজির মূর্তিতে মাল্যদান করেই নিজের বীরপূজক চরিত্রের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। খবর রাখেনি যে, তারও আগে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হিসাবে প্রশাসক সুভাষচন্দ্র একাধিক ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ করেছিলেন। কলকাতা কর্পোরেশনে জনসংখ্যার অনুুপাতেরও একটু বেশি সংখ্যক মুসলিমকে চাকরি দেওয়ার মাধ্যমে সম্প্রদায়-অসাম্য দূর করার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছিলেন। এ নিয়ে শিক্ষিত বর্ণহিন্দু বাঙালিদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হলে সুভাষ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছিলেন, অতীতে হিন্দুরা এই সমস্ত চাকরিতে একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে রেখেছিল, তাই আজ তাদের গাত্রদাহ হলেও কিছু করার নেই। সংখ্যালঘু মুসলিম, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদেরই এই বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া এখন কর্তব্য।
ভাবতে মজা লাগে, আজকের কোনও রাজনৈতিক নেতা যদি এই রকম একটি পদক্ষেপ করতেন, তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে কী ধরনের আক্রমণ করা হত! ‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর অভিযোগে তাঁকে কী ভাবে জর্জরিত করা হত! তীব্র ভাবে সংরক্ষণ-বিরোধী এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি যুগসঞ্চিত বঞ্চনাকে বেমালুম অস্বীকার করা হিন্দু উচ্চবর্ণীয়রা নেতাজির এই ঐতিহাসিক ভূমিকার বিষয়ে যে হিরণ্ময় নীরবতা অবলম্বন করবেন, বলাই বাহুল্য।
মুদ্রার অপর পিঠে আছে আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার। প্রজাতন্ত্র দিবসে প্যারেডে ‘নেতাজির ১২৫ বছর’ সংক্রান্ত ট্যাবলোর প্রদর্শনী বাতিলের পিছনে শুধু আমাদের রাজ্যের শাসকের প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসাই ক্রিয়াশীল নয়, রয়েছে অন্যতর কিছু গভীর উদ্দেশ্যও। ১৯৪২ সালে লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের যে প্রধান তিন জন অফিসারের বিচার হয়েছিল, তাঁদের নাম ছিল যথাক্রমে প্রেমকুমার সহগল, শাহ নওয়াজ় খান এবং গুরুবক্স সিং ধিলোঁ। অর্থাৎ নেতাজির তিন প্রধান সেনাপতি ধর্মপরিচয়ে ছিলেন হিন্দু, মুসলমান এবং শিখ। বলা বাহুল্য, এই ‘নেতাজি’ বর্তমান ভারতের শাসকদের পক্ষে যথেষ্ট ‘বিপজ্জনক’। নেতাজির এই রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন যথাযথ ভাবে চর্চিত এবং প্রচারিত হয়ে গেলে সঙ্ঘ পরিবারের যাবতীয় কর্মসূচি বানচাল হয়ে যেতে পারে।
১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, সেটিই প্রশাসক হিসাবে তাঁর জাত চিনিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেই বক্তৃতাতেই তিনি প্রথম ভাষাভিত্তিক অঞ্চলগুলির জন্য সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন, জমিদারি প্রথা অবসানের দাবি তোলেন, সমাজতান্ত্রিক ধাঁচায় ভূমি-সংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভারী শিল্প-স্থাপনের পক্ষে সওয়াল করেন। শুধু তা-ই নয়, আমরা জানি যে ভারতের ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির প্রথম সভাপতি ছিলেন জওহরলাল নেহরু, কিন্তু আমরা কেউ মনে রাখিনি যে, ওই পদটির জন্য নেহরুর নামটি সুপারিশ করেছিলেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর, বিশ্বায়িত ভারত যখন ক্রমশই নেহরু-সুভাষের সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে সরে আসছে, বিপুল সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে অস্বীকার করে যখন একমাত্রিক ভারত গড়ার সূক্ষ্ম কার্যক্রম চলছে, কতিপয় শিল্পপতিকে যখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন ভারতের সামন্তপ্রভু হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা চলছে— তখন নেতাজির জন্মদিনটিকে ‘জাতীয় পরাক্রম দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করার মধ্যে এক রকমের আত্মপ্রতারণা ক্রিয়াশীল বলে মনে হয়। ‘নেতাজি’-কে পূজার ছলে এ ভাবেই তাঁকে ‘ভুলে থাকার’ আয়োজন সম্পূর্ণ করা হচ্ছে। আমরা বাঙালিরাও তা নিয়ে ভারী খুশি।
অতএব দেখা যাচ্ছে, এক জন যথার্থ দেশনায়ক হিসাবে নেতাজির যথাযথ মূল্যায়ন যে আজও হয়নি, তার জন্য কেবল সে কালের আর্যাবর্তীয় রাজনৈতিক নেতারাই নন— আমরা, তাঁর স্বজাতীয়রাও কম দায়ী নই।
জাতি হিসাবে বাঙালির আত্মবিস্মৃতির এর থেকে বড় নজির আর কী-ই বা হতে পারে?