অনর্থক হেনস্থা, অর্থনষ্ট
Assam

আইনি জটিলতায় অসমে এনআরসি-র কাজ কেবলই পণ্ডশ্রম

করোনা পরিস্থিতিতে বেকারত্বের হার ক্রমশ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে অসমে এন‌আরসি পরবর্তী কাজকর্মের জন্য টাকা খরচ করার কোনও যুক্তি আছে কি?

Advertisement

কমল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০২১ ০৪:৩১
Share:

উৎকণ্ঠা: ২০১৮ সালে অসমের করিমগঞ্জে এনআরসি সেবাকেন্দ্রে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজ।

অসমে কোটি কোটি বাংলাদেশি অবৈধ ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে— এই প্রচার এক সময় সারা ভারতে ছড়িয়ে দিয়েছিল উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদী দল-সহ তাদের দোসরেরা। অসমে ‘ডি ভোটার’ বা সন্দেহজনক নাগরিকদের তালিকা তৈরি শুরু হয় ১৯৯৮ সাল থেকে। ২০০৮ সাল থেকে সে রাজ্যে নতুন করে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তৈরি শুরু হয়। বিভিন্ন জেলায় মোট ১০০টি ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তৈরি হয়। নির্বাচন দফতর, এসপি বর্ডার অফিসে শুরু হয় ডি ভোটার তালিকা তৈরি, এবং হিন্দু, মুসলিম দুই ধর্মেরই বিভিন্ন অ-অসমিয়া ভাষাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নোটিস দেওয়া। এর পরেও অসমিয়ারা সন্তুষ্ট না হ‌ওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার অসমের ক্ষেত্রে সরাসরি এন‌আরসি করার ঘোষণা করে, যার ভিত্তিবর্ষ ২৫ মার্চ, ১৯৭১।

Advertisement

অসমের এন‌আরসি-র নবায়নের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম প্রকাশিত খসড়ায় ৯০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছিল। ৩০ জুলাই, ২০১৮-র দ্বিতীয় খসড়ায় ৪০ লক্ষের নাম, এবং ৩১ অগস্ট, ২০১৯-এ এন‌আরসি-র চূড়ান্ত তালিকার সময় এন‌আরসি-ছুটের সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৯৬,৬৫৭! প্রায় দু’বছর হতে চলল এন‌আরসি-ছুটদের এখনও ‘রিজেকশন স্লিপ’-সহ ‘স্পিকিং অর্ডার’ দেওয়া হয়নি, যেখানে নাম না আসার কারণ উল্লেখ থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার আগেই অসমের এন‌আরসি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছিল, ২০২০ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে এন‌আরসি-র কাজ শেষ করতে হবে। সেই কাজ শেষ করা তো দূরস্থান, এখনও শুরুই করা যায়নি। নতুন ২০০টি ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তৈরির কথা ঘোষণা করা হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে। অসম সরকার তাদের পছন্দমতো ২০০ সদস্যকে নিযুক্ত করেছিল ২০১৯ সালে, যাঁদের মাসিক বেতন ৯০,০০০ টাকা। বিভিন্ন মহকুমার এন‌আরসি-ছুটদের জন্য পৃথক পৃথক ফরেনার্স ট্রাইবুনালের অফিস‌ও সরকার ভাড়া নিয়েছিল। এই ২২ মাসে সরকারের খরচ হয়েছে কম করে ৫০ কোটি টাকা! অথচ কাজের পরিসংখ্যান, এক কথায়, ‘বিগ জ়িরো’।

এ দিকে, কেন্দ্রীয় সরকার ১৬০২.৬৬ কোটি টাকা খরচ করার পর অসমের বিজেপি সরকার এন‌আরসি-র পরবর্তী কাজের জন্য প্রতি মাসে ৩.৩২ কোটি টাকা চেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দেয়, অসমের এন‌আরসি-র জন্য একটি টাকাও খরচ করা হবে না। তারা নির্দেশ দেয়, অসমের এন‌আরসি-র দফতর ছাড়তে হবে এবং কোনও সরকারি দফতরে কাজ করতে হবে। কাজেই যত দিন না অসমের এন‌আরসি-র চূড়ান্ত তালিকা অনুমোিদত হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত কোনও কাজ করাও মুশকিল। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে, অসমের এন‌আরসি অফিসে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের ছাঁটাই করা হয়েছে।

Advertisement

প্রায় দু’বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও কাজ কেন এগোয়নি, তার অনেক কারণ। নথিভুক্ত করার কাজটিই আটকে যায় বিবিধ বাধায়, কাগজপত্র ঠিকমতো না থাকার কারণে। আর যাঁদের নাম তালিকায় ওঠেনি, তাঁদের আবেদন বিবেচনা করতে। বিভিন্ন সার্কল অফিসে এল‌আরসি‌আর, ডিআরসিআর, জেলা শাসকদের প্রতিনিধিরা একত্রে অনেকের নথিপত্র যাচাই করে কাজ অনেকটা এগোতে পারতেন। জটিল নথিপত্র নাহয় ফরেনার্স ট্রাইবুনালে পাঠাতেন। সেই কাজ না করায় অসমিয়া, গোর্খা, হরিজন সম্প্রদায়, চা জনগোষ্ঠী-সহ অজস্র পরিবারের ছেলেমেয়ের নাম বাদ গেল; গোটা বিষয়টিও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হল না। এত বড় একটা প্রক্রিয়ার পরও বোঝা গেল না, কোথায় সেই এক কোটি অবৈধ বাংলাদেশি? অসম সরকার এই এন‌আরসি-কে না পারছে গিলতে, না পারছে ওগরাতে। বিজেপি সরকার বলছে, সীমান্তবর্তী এলাকায় ২০ শতাংশ রি-ভেরিফিকেশন করতে। অথচ, তখনকার স্টেট কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা ২৭ শতাংশ রি-ভেরিফিকেশন করে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করেন।

এক দিকে যখন অসমে এন‌আরসি-র কাজ চলছিল, ঠিক তখনই মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মন্দর ‘অসমে ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা ব্যক্তিদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে’, এই যুক্তিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন। ২০১৯ সালের ১৫ মে তিন বছরের বেশি ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা ব্যক্তিদের কিছু শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি। কোভিড-কালে সময়টা তিন বছরের জায়গায় দু’বছর করার ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সেই ব্যক্তিরা আজ নিজের পরিবারের সঙ্গে দিনযাপন করছেন।

তা হলে এই হেনস্থা এবং কোটি কোটি টাকা খরচ করার দরকার কী? তা ছাড়া, ফরেনার্স ট্রাইবুনালে হেরে যাওয়ার পর যাঁদের ‘বিদেশি’ ঘোষণা করা হবে, তাঁদের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার কী করবে? ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠেলে দেওয়া হবে এত মানুষকে? তা হলে কি উদ্দেশ্য সস্তা শ্রম তৈরি করা? সেটা তো কোনও কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি হতে পারে না!

ভারতে করোনা পরিস্থিতিতে বেকারত্বের হার ক্রমশ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে অসমে এন‌আরসি পরবর্তী কাজকর্মের জন্য টাকা খরচ করার কোনও যুক্তি আছে কি? এ কেবল অর্থহীন নয়— অনৈতিক। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যদি নতুন কাউকে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢোকানো হয়, তার মেয়াদ হবে বড়জোর তিন বছর। তার পর তাঁরা জামিনে মুক্তি পাবেনই, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। কাজেই কেন্দ্রীয় সরকার ও অসম সরকারের এখন উচিত, অকাজে সময় ও সম্পদ নষ্ট না করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থনীতিকে মজবুত করার দিকে নজর দেওয়া।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement