বিজয়িনী: প্যারালিম্পিক্সে স্বর্ণপদক জয়ী অবনী লেখারা। পিটিআই।
টোকিয়ো অলিম্পিক্সের একটি দৃশ্য এখনও আমাদের সবার চোখে ভাসে। ভারতের একদল দুঃসাহসী দামাল মেয়ে একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে বিশ্বজয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে তালে তালে নাচছে। আর তাদের থেকে লক্ষ গুণ বিত্তশালী একদল মেয়ে তখন স্তম্ভিত, হতাশ, পরাজিত। হয়তো ভাবছিল, “এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না।” আর আমরা ভাবছিলাম, যা সিনেমায় দেখেছি তা এত তাড়াতাড়ি সত্যি হল কী করে। আমাদের সেই ডাকাবুকো মেয়েগুলোর বিশ্বজয় এখন সময়ের অপেক্ষা। তাদের এ বার বিশ্বজয় না করতে পারার কান্না থেকে আমরা বুঝেছি যে, এ বারে না হলেও সে দিন আর বেশি দূরে নেই।
এ বারের অলিম্পিক্সের আরও কিছু দৃশ্য আমাদের অবাক করে। কুস্তি প্রতিযোগিতার ফাইনালে পরাজিত হয়ে রবি কুমার দাহিয়ার কান্না আমাদের চমৎকৃত করে। নীরজ সোনা জিতেও ৯০ মিটার পেরোতে হবে বলে পরিশ্রম শুরু করেন। এখন ভারতীয়রা আর রুপো বা ব্রোঞ্জ পেয়ে আহ্লাদিত হন না, আরও বেশি কিছু চান। লাভলিনা এ বার ব্রোঞ্জ পেয়ে পরের অলিম্পিক্সে সোনা পাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আগে যেমন একটি ব্রোঞ্জ পেয়ে আমরা দশ বছর আহ্লাদে আটখানা হয়ে থাকতাম, এখন আর সেই মানসিকতা নেই। এঁরা ‘সোশ্যাল মিডিয়া’-তে বিপ্লব করেন না, বিশ্বের সর্বোচ্চ স্তরে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে সামাজিক ও মানসিক বিপ্লব ঘটান। এটাই হয়তো নতুন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভারত। বর্তমান করোনা আবহে অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এই ঘটনাগুলি আমাদের আশা জোগায়। আমাদের পিছিয়ে থাকার দিন শেষ, একটি রাষ্ট্র হিসাবে আমরা নিশ্চয়ই ঘুরে দাঁড়াব।
টোকিয়ো অলিম্পিক্সের প্রসঙ্গ টানার কারণ, অর্থনৈতিক বা সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থেকেও মনের জোর, পরিশ্রম আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার উপর ভর করে যে কোথায় পৌঁছনো যায়, তার অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে আসে। শুধু আমাদের দেশ কেন? অন্য অনেক অনুন্নত দেশ থেকেও এ রকম উদাহরণ পাওয়া যাবে। আমাদের রানি রামপাল, বন্দনা কাটারিয়া, সবিতা পুনিয়া, দীপ গ্রেস এক্কা, গুরজিত কৌর, নেহা গোয়েল, সুশীলা চানু, সালিমা টেটে-রা কী জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে উঠে এসেছেন, তা আমরা এখন সবাই জানি। তাঁদের পরিবারের লোকজন সামান্য কিছু টাকার বা খাবারের জন্য কোথাও লাইন দেননি। সরকারি অনুদানের জন্য কোথাও ফর্ম ভর্তি করেছেন বলে মনে হয় না। এঁদের পিতা মাতারা নিজেদের পরিশ্রমের সামান্য অর্থে নিজেদের কন্যাকে মানুষ করেছেন, আর পরিশ্রম করে জীবনে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিয়েছেন। সর্বোপরি যেটা দিয়েছেন, তা হল স্বপ্ন দেখতে শেখানো, উচ্চাকাঙ্ক্ষা— যার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ যে কী না করতে পারে, তা প্যারালিম্পিক্স দেখলেও বোঝা যায়। আমাদের দেশের অবনী লেখারা, প্রমোদ ভগত, কৃষ্ণ নাগর, মণীশ নারওয়াল ও অন্য অ্যাথলিটরা অনন্য নজির গড়ে তা প্রমাণ করেছেন।
মানুষের পারা না-পারা আসলে অনেকটাই মানসিক। শুরুর আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতি এক জনের জীবনের গতিপথের কিছুটা নির্ণায়ক নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করা সম্ভব, যদি মনের জোর আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে। এখানে শাসক বা সরকারের দায়িত্ব আছে। মানুষের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরি করা সরকারের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। শুধু খাদ্য ও সামান্য অর্থের সংস্থান যথেষ্ট নয়, তার অনেক বেশি মানুষের পাওনা। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। রাজনৈতিক দলগুলি চায় যে, একটি বিপুল জনগোষ্ঠী তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকুক। যাতে বিভিন্ন সময় এই জনগোষ্ঠীকে তারা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, মাঝে মাঝে ছোটখাটো কিছু সুবিধা দিয়ে। সাধারণ মানুষ যদি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠে, তা হলে সরকারের পরিশ্রম অনেক বেশি। অনেক গঠনমূলক কাজ করতে হবে যার আর্থিক সামর্থ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং ‘এক্সপোজ়ার’ সব সময় শাসকের থাকে না। তার চেয়ে সোজা পথটি, অর্থাৎ সস্তা জনপ্রিয়তার পথ বেছে নেওয়াই ভাল। রাজনৈতিক দলগুলিও নিজেদের স্বার্থে অনুন্নত একটি ‘সিস্টেম’ চালু রাখতে পারে। সমস্যা হল, এতে হয়তো বেশ কিছু দিন ক্ষমতায় থাকা যায়, কিন্তু দেশের বা সেই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি হয় না। মানুষকে স্বাবলম্বী করাটাও শাসকের কর্তব্য।
বর্তমানে অর্থনীতিতে ‘বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স’ বা ‘আচরণমূলক অর্থনীতি’ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। এই বিষয়টি অর্থনীতি ও মনস্তত্ত্বের একটি মেলবন্ধন বলা চলে। ‘বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স’ নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু এর একটি সম্ভাব্য আঙ্গিক নিয়ে একটু আলোকপাত করি। কোনও একটি সময়ে কোনও মানুষ বা জনগোষ্ঠীর আচরণ তার বা তাদের মানসিক গঠন বা মনস্তত্ত্বের উপর নির্ভর করে। কোনও ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী যদি বিশ্বাস করে যে, সে বা তারা উন্নতি করতে পারে, তা হলে তাকে বা তাদেরকে উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তার জন্য যা যা পদক্ষেপ করা উচিত, সেগুলি ঠিক ঠিক করা হলে কোনও না কোনও সময়ে তাদের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু কোনও জনগোষ্ঠী যদি মানসিক ভাবে পরাস্ত হয় বা একটি পরজীবী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়, তা হলে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উত্থান ঘটানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
কোনও অর্থনীতি যখন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যায়, তখন অর্থনৈতিক উদ্দীপক বা স্টিমুলাসের প্রয়োজন হয়। অর্থনীতিতে ‘লো লেভেল ট্র্যাপ’ বা ‘নিম্ন অর্থনৈতিক স্তরের ফাঁদ’ বলে একটি ধারণা আছে, যা আমাদের ‘দারিদ্রের দুষ্টচক্রের’ দিকে ঠেলে দিতে পারে। সেখান থেকে অর্থনীতিকে বার করে আনতে যে ধরনের বৃহৎ অর্থনৈতিক উদ্দীপক বা স্টিমুলাসের প্রয়োজন হয়, তাকে আমরা অনেক সময় ‘বিগ পুশ’ বা ‘বড় অর্থনৈতিক ধাক্কা’ বলে থাকি। চাহিদার ঘাটতি থাকলে চাহিদা বাড়ানো, জোগানের সমস্যা থাকলে জোগানভিত্তিক কিছু দীর্ঘমেয়াদি কড়া পদক্ষেপ করতে হতে পারে। মানুষকে এগুলো সরকারের থেকে দাবি করতে হবে। আমাদের কী পাওয়া উচিত, সেগুলো সম্বন্ধে ধারণা থাকতে হবে। কিন্তু সমস্যা হল, যদি আমরা ‘সাইকোলজিক্যাল লো লেভেল ট্র্যাপ’ বা ‘নিম্ন মনস্তত্ত্বের ফাঁদে’ বা স্তরে চলে যাই, তা হলে আমরা যা পাচ্ছি সেটাই যথেষ্ট মনে হবে, উন্নতি করার স্পৃহা চলে যাবে। মানসিক ভাবে পঙ্গু হয়ে গেলে শাসকের সদিচ্ছা থাকলেও অর্থনৈতিক উদ্দীপকে কাজ না-ও হতে পারে। সেই অবস্থা থেকে অর্থনীতি ও মানুষকে বার করে আনা খুব কঠিন। আমরা যেন ‘মানসিক দারিদ্রের দুষ্টচক্রে’ চলে না যাই। মানসিক দারিদ্রের দুষ্টচক্রের ফাঁদ চারিদিকে ছড়ানো— শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প সর্বত্র। তাই রানি রামপাল, বন্দনা কাটারিয়া, লাভলিনা, অবনী লেখারা-রা যেন আমাদের আদর্শ হয়ে উঠতে পারেন।
অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়