বিজেপি ৩ থেকে ৭৭ হল। বাম-কংগ্রেস ৭৬ থেকে শূন্য। তাঁরা এ বারের ভোটে তৃণমূল এবং বিজেপি থেকে সমদূরত্ব রাখার কথা বলছিলেন। প্রচারে অবশ্য সম-বিরোধিতা রাখেননি। তাঁদের কথাবার্তায় বেশির ভাগ সময়েই বিজেপির বিরোধিতা আসছিল আলগোছে জুড়ে দেওয়া শেষ প্যারাগ্রাফের মতো করে। সেটা উল্লেখ করলে তাঁরা উত্তর দিচ্ছিলেন, এটা তো বিধানসভা ভোট! রাজ্যের শাসকের বিরুদ্ধেই তো কথা বলতে হবে!
মুশকিল হল, লোকসভা ভোটেও তাঁদের প্রচার কিন্তু আলাদা ছিল না। সুতরাং, বিধানসভা ভোটের বাধ্যবাধকতা মেনেই কেবল তাঁদের প্রচারের অভিমুখ মমতা-বিরোধিতায় আটকে যাচ্ছে, এটা বোঝানো এমনিতেই কঠিন। বামেরা তা চাননিও। তাঁরা স্পষ্টই বলছিলেন, তৃণমূলকে না সরিয়ে বিজেপিকে রোখা যাবে বলে তাঁরা মনে করেন না। কী ভাবে সম্ভব সেটা? বামেদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনলেই সম্ভব। খুব ভাল কথা। কিন্তু তা হলে ‘আগে রাম, পরে বাম’-এর ঘুরপথ কেন? এইখানে এসে আলোচনাটা গোত্তা খেতে বাধ্য। কারণ ‘আগে রাম পরে বাম’ খাতায়কলমে ঘোষিত পার্টি লাইন নয়, অথচ সেটাই যে মেঠো বাস্তবতা, সেটা আজ আর কারও অবিদিত নেই। ‘আগের বার বিজেপিকে ভোট দিয়ে ভুল করেছি, এ বার ভোট বামকেই দেব’, এ রকম প্রচারভাষ্যও তাই এ বার অনুপস্থিত ছিল না।
অথচ, ২০১৯-এ যখন বামের ভোট রামে যাচ্ছে বলে চর্চা হতে থাকল, তখন অনেকেই ‘রে রে’ করে তেড়ে এলেন। যেন এমন একটা কথা উচ্চারণ করাই পাপ। ভোটের ফল বেরোতে কিন্তু পরিষ্কার হয়ে গেল সবই। দু’বছরের মাথায় দেখা গেল, বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত সত্যের মান্যতা পেয়ে গিয়েছে। রামে যাওয়া ভোট বামে ফিরবে কি না, সেটাই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ রহস্যের গিঁট এখনও খোলেনি, কেন ‘আগে রাম’-এর তত্ত্ব হাজির হয়েছিল আদৌ? ষাঁড়ের শত্রু বাঘে মারার স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু ছিল বলে তো মনে হয় না। কিন্তু শুধু সেটা বললে পাছে শুনতে ভাল না লাগে, তাই তার গায়ে লাগল বৃহৎ ফ্যাসিবিরোধী আদর্শের সুর। ‘আগে রাম’-এর সঙ্গে জুড়ে গেল, ‘পরে বাম’।
বাংলার ভোটাররা আদতে আগে-পরের হিসেবটাই কষেছেন। একটু অন্য রকম করে কষেছেন। “আগের কাজ আগে তো তুমি সারো, পরের কথা ভাবিয়ো পরে আরও”— এই আপ্তবাক্যটি তাঁরা বিস্মৃত হননি।
ঠিক কী লক্ষ্য ছিল এ বার বামেদের? ক্ষমতা দখল করতে পারবেন, এমন নিশ্চয় ভাবেননি। তাঁদের কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছিল, ওঁরা নিশ্চিত ছিলেন যে, মমতা হারবেন এবং বিজেপি আসবে। এক দিকে সেই পথ মসৃণ করার চেষ্টা ওঁরা চালিয়েছেন। পিরজাদাকে জোটে নিয়ে সংখ্যালঘু ভোট ভাগ করার জন্য প্রয়াসী হয়েছেন। স্থানে স্থানে এ বারও নিজেদের ভোট ট্রান্সফার করেছেন। নইলে বেশির ভাগ আসনে জামানত জব্দ হয় না। অন্য দিকে, বিজেপি ক্ষমতায় এলে যাতে বিরোধী পরিসরে নিজেদের ছাপ রাখা যায়, সেই দিকে তাকিয়ে এক ঝাঁক তরুণ মুখকে প্রার্থী করেছিলেন। বিশেষত ঐশী-দীপ্সিতা থাকলে ভবিষ্যতে ওঁদের বিজেপি-বিরোধী মুখ হিসেবে তুলে ধরতে সুবিধা হবে, এই অঙ্ক নিশ্চয় ওঁদের মাথায় ছিল।
নিট ফল কী দাঁড়াল? মমতা-বিরোধিতার পরিসর সম্পূর্ণ ভাবে চলে গেল বিজেপির হাতে। আর বিজেপি-বিরোধিতার পরিসরটি সম্পূর্ণত চলে এল মমতার হাতে। আগামী পাঁচ বছর শাসকের বিরুদ্ধে কিছু বলতে হলেই আখেরে তা বিজেপির সুবিধা করে দেবে, এই গুমোট দুর্গতি বঙ্গবাসীকে উপহার দিয়ে গেল বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট। এ বারের ভোটে বিজেপিকে রুখে দেওয়া গিয়েছে, এটা যত বড় স্বস্তি, বিরোধী রাজনীতির একচেটিয়া আসন তাদের ঝুলিতে গিয়েছে, এটা ততটাই অস্বস্তির। শুধু অস্বস্তিরও নয়, উদ্বেগের, দুশ্চিন্তার।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘আগে রাম’ প্রকল্প তো আংশিক সাফল্য পেল। বিজেপি ক্ষমতায় না এলেও কার্যত একক বিরোধী দল হিসেবে উঠে এল। ‘পরে বাম’-এর ভিত তৈরির কাজ মুখ থুবড়ে পড়ল কেন? উত্তরটা বোধ হয় অজানা নয়। যে তরুণ ব্রিগেডকে মাঠে নামানো হয়েছিল এ বার, তাঁদেরও বিজেপির বদলে মমতা-বিরোধী প্রচার করতেই দেখা গিয়েছে বেশি। ফলে ২০১৯-এর তুলনায় নিজ নিজ আসনে তাঁদের প্রাপ্ত ভোট হয়তো বেড়েছে, কিন্তু ‘আগে রাম’ আর ‘পরে বাম’ প্রকল্পকে জনতার চোখে আলাদা করা যায়নি। যাবেই বা কী করে? নতুন মুখ এসেছিল, নতুন কণ্ঠ এসেছিল, নতুন কথা তো আসেনি! মীনাক্ষী-দীপ্সিতা-ঐশী-সৃজনদের বাগ্মিতা নিয়ে নেট দুনিয়ায় যে উচ্ছ্বাস দেখেছি, সেখানে তাঁদের বক্তব্যের উপজীব্য নিয়ে কাটাছেঁড়া কতটুকু? নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়ে মীনাক্ষী বলে এলেন, তেভাগার নন্দীগ্রামকে রাস্তা-কাটা-নন্দীগ্রাম বানিয়ে কলঙ্কিত করা হয়েছে! সৃজন সিঙ্গুরে বলে এলেন, আপনাদের ভুল আন্দোলনে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে! অর্থাৎ অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া নয়, অতীতের ভুলকে ঠিক প্রমাণ করার তাগিদ থেকেই এখনও মুক্ত নন ওঁরা। জনতার দরবারে ইতিমধ্যেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে যে সব তত্ত্ব, তার মায়া কাটাতে অপারগ। বিজেপি-মমতা ‘সেটিং’-এর যে বয়ান সবাই মিলে লাগাতার আওড়ে গেলেন, এক বারও কেউ ভাবলেন না ২০১৯-এর ভোট দেখার পর এই কথাগুলো বাতিল নোটের মতোই অচল? বলিউডের রাজকুমার বেঁচে থাকলে আজ সিপিএমের উদ্দেশে সংলাপটি শোনাতেন: জিনকে অপনে ঘর শিশে কে হো, উও দুসরোঁ পর পাত্থর নহি ফেকা করতে!
রইল বাকি জনসেবা। গত বছর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই দুঃসময়ে মানুষকে সাহায্য করার যে কাজ বাম তরুণ-তরুণীরা নিরলস ভাবে চালিয়ে গিয়েছেন, তার প্রভাব ভোটে পড়েনি দেখাই গেল। এ নিয়ে তাঁদের অভিমানও কম নয়। কিন্তু একটা কথা তাঁদের মাথায় রাখা ভাল। কোনও রাজনৈতিক দলের জনসেবা কর্মসূচি তখনই ভোটের বাক্সে ফল দেবে, যখন পাশাপাশি তার রাজনীতিটাও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। তা না হলে একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দাতব্য প্রতিষ্ঠান বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তফাত থাকে না। কোভিড, লকডাউন, অর্থনীতির মন্দায় বামেদের কাছে সুযোগ ছিল জনসেবার পাশাপাশি বিজেপি-বিরোধী আন্দোলনকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। বিজেপি-বিরোধিতার হাওয়া বেশ খানিকটা নিজের দিকে টেনে নেওয়ার। সেটা না করে ওঁরা যত বেশি করে মমতার বিরোধিতায় নিমজ্জিত থেকেছেন, তত বেশি করে বিজেপির বিরুদ্ধে খোলা মাঠ পেয়ে গিয়েছেন মমতা। যত বেশি করে প্রচারের সুরে বিজেপি আর বাম কাছাকাছি এসেছে, তত বেশি করে মমতার একক লড়াই গরীয়ান হয়ে উঠেছে।
বাম এবং কংগ্রেসের হাত আজ খালি। শূন্য কিন্তু অসীম সম্ভাবনার আধার। গা-ঝাড়া দিয়ে নিজেদের নতুন করে গড়ার উপযুক্ত সময়। ঔদ্ধত্য আর বাঁধা বুলির কানাগলি থেকে বেরোনোর সময়। ‘৭% হয়েও আমরা কত কাজ করি’ বলে যে তৃপ্তি পাচ্ছিলেন, সেটা থেকে হড়কে নেমে ‘আমরা তো শূন্য তবে আর কথা কেন’ বলে গাল না-ফোলানোর সময়। বামপন্থার প্রয়োজন কিন্তু ফুরোয়নি।